বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই রঞ্জনের (ছদ্মনাম) আচরণে পরিবর্তন দেখা দিয়েছিল। কেমন যেন আনমনা ভাব। আগে সে মা–বাবার সামনেই টেলিফোনে কথা বলত, এখন বেশির ভাগ সময় আলাদা ঘরে গিয়ে ফিসফিস করে কথা বলে। বাসায় ফেরে দেরি করে। আগের চেয়ে একটু বেশি ফিটফাট হয়ে আর সুগন্ধি মেখে বাইরে যায়। বোঝাই যায় সে প্রেমে পড়েছে। মা-বাবা চিন্তায় পড়ে গেলেন। রঞ্জনের মা–বাবা শিক্ষিত, সন্তানের প্রেমে পড়া নিয়ে তাঁরা উদ্বিগ্ন না, উদ্বিগ্ন কার সঙ্গে প্রেম করছে, সেটা নিয়ে। খোঁজ নিয়ে দেখা গেল এক সহপাঠীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছে রঞ্জন। মেয়েটির কোনো কিছুই রঞ্জনের মা–বাবার পছন্দ না। সামাজিক অবস্থান, সৌন্দর্য, বয়স বা মেয়েটির স্থায়ী ঠিকানা—সবকিছুতে তাঁদের আপত্তি। অথচ রঞ্জন মেয়েটির প্রতি যথেষ্ট দায়বদ্ধ। শুরু হলো জটিলতা, মা–বাবার সঙ্গে রঞ্জনের প্রায়ই কথা–কাটাকাটি হতে লাগল। রঞ্জনের পরীক্ষার ফল খারাপ হতে লাগল। কিছুতেই ওই তরুণীকে মেনে নেবেন না মা–বাবা। আর রঞ্জনও এই সম্পর্ক ছাড়বে না। মেয়েটির পরিবার রঞ্জনকে অপছন্দ না করলেও এত জটিলতা তারাও এড়িয়ে চলতে চায়।
এমন সমস্যা অনেক পরিবারেই ঘটে থাকে। ছেলে বা মেয়ের যেকোনো ধরনের প্রেম বা আবেগীয় সম্পর্ককে বাবা-মায়েরা ভয় পান। তাঁরা সন্তানকে কঠোর শাসন করেন, মুঠোফোন কেড়ে নেন, ঘরে আটকে রাখেন। কখনো সন্তানের বিশেষ বন্ধু বা বান্ধবীটিকে শাসান বা তাদের মা–বাবাকে নালিশ করেন। কেউ কেউ মারধরও করেন। এমন আচরণ সন্তানের জন্য কোনো সুফল বয়ে আনে না। কিশোর বা তরুণ বয়সী ছেলেরা প্রেম করলে মা-বাবা ভাবেন পড়ালেখা বুঝি গোল্লায় গেল। আর মেয়েসন্তান প্রেমে পড়লে তার নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে মা-বাবা উদ্বিগ্ন হয়ে যান। পাশাপাশি যার সঙ্গে প্রেম করছে, তার সামাজিক অবস্থান, বংশপরিচয়, রুচি, বয়স, চেহারা, ব্যক্তিগত অভ্যাস ইত্যাদি নিয়েও মা–বাবার মধ্যে দুশ্চিন্তা কাজ করে।
এই দুশ্চিন্তা থেকে বাবা-মায়েরা উত্তেজিত হয়ে পড়েন। বিষয়টি কখনো কখনো সন্তান ও মা–বাবার মধ্যে ব্যক্তিত্বের সংঘাত তৈরি করে। আবার কখনো দেখা যায়, বাবা বা মায়ের একজন বিষয়টি মেনে নিচ্ছেন কিন্তু আরেকজনের তীব্র আপত্তি, তখন শুরু হয় ত্রিমুখী সমস্যা।
মনে রাখতে হবে, তরুণ বয়সটিই ভালো লাগার বয়স, ভালোবাসার বয়স। কখনো এটি সত্যিকারের প্রেম, কখনো আবার নিতান্তই সাময়িক মোহ। মোহ সহজেই কেটে যায়। আর প্রেম কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী হয়। প্রেমে পড়লে কেউ কেউ মা–বাবার কাছে তার সম্পর্কের বিষয়টি সরাসরি বা আকারে-ইঙ্গিতে বলার চেষ্টা করে। কেউ আবার বিষয়টি লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করে। বাবা-মায়েদের উচিত হবে এ সময় অস্থির না হয়ে, ঠান্ডা মাথায় বিষয়টি নিয়ে সন্তানের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করা।
সন্তান যাকে ভালোবাসে, আপনার তাকে পছন্দ না–ও হতে পারে। আপনি ভাবছেন আপনার সন্তানের জীবনে তার প্রেমিক বা প্রেমিকা নেতিবাচক ভূমিকা রাখবে। আপনার সন্তানের সঙ্গে ভবিষ্যতে সে মানিয়ে নিতে পারবে না। হতেই পারে আপনার পারিবারিক সংস্কৃতির সঙ্গে সন্তানের ভালোবাসার মানুষটির রুচিবোধ ও সংস্কৃতির বিস্তর ফারাক। আপনার অভিজ্ঞতা হয়তো সত্যিটাই ভবিষ্যদ্বাণী করছে। কিন্তু তাই বলে এমন কোনো আচরণ করবেন না, যাতে আপনার সন্তান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসব বিষয়ে মা–বাবার হঠকারী ও উত্তেজিত আচরণের কারণে সন্তানের পড়ালেখা বাধাগ্রস্ত হতে পারে। সন্তানের সঙ্গে বিরোধে জড়ালে সে হতাশ হয়ে মানসিক সমস্যায় ভুগতে পারে। সন্তানের মধ্যে দেখা দিতে পারে মাদকাসক্তি বা আত্মহত্যার প্রবণতা। তাই এসব বিষয় মাথায় রেখে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে।
সন্তানের করণীয়
তারুণ্যে কোনটা প্রেম আর কোনটা মোহ, সেটা অনেকেই বুঝতে পারেন না। ভালোবাসার পরিবর্তনও ঘটতে পারে। তাই সম্পর্কের শুরুতেই কঠোর না হয়ে বিষয়টিকে ধৈর্য ধরে মোকাবিলা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, প্রেমের ক্ষেত্রে পারস্পরিক দায়বদ্ধতার পাশাপাশি সামাজিক দায়বদ্ধতাও রয়েছে। এই সামাজিক দায়বদ্ধতার অন্যতম অংশীদার মা–বাবা ও পরিবার। তাই মা–বাবার যুক্তিগুলোও ভেবে দেখতে হবে। একতরফা না ভেবে নিজের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করার আগে মা–বাবার সঙ্গে আলোচনা করতে পারেন। আপনার মা–বাবা কেন আপনার ভালোবাসার মানুষটিকে মানতে পারছেন না, সেটা বোঝার চেষ্টা করুন। অনেক সময় প্রেমে পড়লে মানুষ সঙ্গীর ভুলগুলোকে এড়িয়ে চলতে থাকে। সেটা না করে বুঝতে চেষ্টা করুন, আপনি এই সম্পর্কটাকে স্থায়ী রূপ দিতে পারবেন কি না। অযৌক্তিকভাবে প্রেমিক/প্রেমিকার সব বিষয় আপনি মেনে নিচ্ছেন কি না, ভাবুন। মা–বাবা যেসব যুক্তি দেখাচ্ছেন, সেগুলো ঠিক কি না, বুঝতে চেষ্টা করুন।
বাবা ও মায়ের করণীয়
সন্তানের ভালোবাসার মানুষ ও তার পরিবার নিয়ে নেতিবাচক, বিদ্রূপাত্মক মন্তব্য করবেন না।
সন্তানের প্রতি নির্দয় হবেন না। তাকে মারধর করা, ঘরে আটকে রাখা, মুঠোফোন কেড়ে নেওয়া থেকে বিরত থাকুন।
সন্তানকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল করবেন না। যেমন ‘এই সম্পর্ক ত্যাগ না করলে আমি আত্মহত্যা করব,’ ‘এই সম্পর্ক চালিয়ে গেলে তোমার বাবা হার্ট অ্যাটাক করবে।’—এই জাতীয় কথাবার্তা বলবেন না।
সন্তানের বয়স যদি প্রেমের বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের উপযোগী না হয়, তাহলে তাকে বুঝিয়ে বলুন। উপযুক্ত বয়স হওয়া পর্যন্ত সময় নিতে বলুন।
সন্তানের অনুভূতিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিন। সন্তানকে ভালোবাসা আর মোহের সংজ্ঞা ও পার্থক্য বুঝিয়ে বলুন। যাতে সে বুঝতে পারে যে সে সত্যিই প্রেমে পড়েছে, নাকি মোহগ্রস্ত হয়ে গেছে।
সন্তান যদি শিক্ষার্থী হয়, তবে তাকে পড়ালেখার দিকে মনোযোগী হতে বলুন। ক্যারিয়ারের জন্য পড়ালেখাও যে গুরুত্বপূর্ণ, সেটা বুঝিয়ে বলুন।
উত্তেজিত হবেন না। প্রেমে পড়লে মানুষের কেমন ভালো লাগা কাজ করতে পারে, সেটা বুঝে আপনার সন্তানের সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপ করুন। এ বয়সে প্রেমে পড়লে অনিরাপদ শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি থাকে। সেটা মাথায় রেখে সন্তানের সঙ্গে কথা বলুন। বয়স বিবেচনা করে তাকে যৌন বিষয়ে বিজ্ঞানসম্মত ধারণা দিন।
আপনার সন্তান তার ভালোবাসার মানুষটিকে কোনো বিপদে ফেলছে কি না, সেদিকে নজর দিন। সন্তান নিজেও কোনো বিপদে পড়ছে কি না, সেটাও খেয়াল করুন।
নিজেকে প্রশ্ন করুন, কেবল নিজের সামাজিক মর্যাদা বা ব্যক্তিগত ধারণার কারণে আপনি সন্তানের ভালোবাসার মানুষটিকে মেনে নিতে পারছেন না, নাকি আপনি যুক্তিবোধ দিয়ে বিশ্বাস করেন আপনার সন্তান এই সম্পর্কটির জন্য উপযুক্ত নয়। প্রয়োজনে পরিবারের অন্য সদস্যের সঙ্গে আলোচনা করুন। সন্তানের শিক্ষক বা বন্ধুদের সঙ্গেও আলোচনা করতে পারেন। কেবল নিজের ব্যক্তিগত ধারণা আর অপছন্দের কারণে সন্তানের জীবনকে জটিল করে তুলবেন না।
সন্তানের আস্থা অর্জন করুন। যাতে তারা আপনার কাছে তাদের প্রেম ও এর জটিলতা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করে।
সবাই একই সাংস্কৃতিক কাঠামোর মধ্যে থাকে না। ভিন্নতাকে মেনে নিতে চেষ্টা করুন।
আপনি যদি যৌক্তিকভাবেই মনে করেন এ সম্পর্ক সন্তানের জন্য প্রকৃতপক্ষেই অমঙ্গলকর হবে, তবে সেটা যুক্তি দিয়েই সন্তানকে বুঝিয়ে বলুন। প্রয়োজনে পরিবারের অন্য সদস্য, সন্তানের শিক্ষক বা মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে পারেন।