আমি সারা জীবন দেখেছি আমার মা কাজ করেন। আমার মা নীলুফার মঞ্জুর, ঢাকার সানবীমস স্কুলের অধ্যক্ষ। আমার বয়স পঞ্চাশ, কিন্তু আজ পর্যন্ত এক দিনও দেখিনি, মা কাজ ছাড়া আছেন। আমার বা আমার বোন মুনিজে মঞ্জুরের জন্য এটাই স্বাভাবিক। অনেকের জন্য স্বাভাবিক হচ্ছে যে তাঁদের মা কাজ করেন না।
আমার স্ত্রী সামিয়া হক, তিনি নিজেও একজন কর্মজীবী মা, আমাদের তিন মেয়ে, এক ছেলে। আমার ছেলেমেেয়রা সানবীমস স্কুলে পড়ছে, আমি চাইব ওরাও যেন কর্মজীবী হয়। কাজ করবে না—এই অবস্থা যেন না আসে। মা কর্মজীবী হওয়ায় আমি কর্মজীবী নারীদের প্রতি সংবেদনশীল হয়েছি। অনেক কিছুর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে বাংলাদেশে একজন নারীকে কাজ করতে হয়। সংসার, সন্তানের অসুখ, পারিবারিক নানা ঝঞ্ঝা—সব সামলিয়ে তাঁকে কাজে আসতে হয়, সেসবের প্রভাব যেন কাজের ক্ষেত্রে না পড়ে।
মায়ের কাছে থেকে যেহেতু আমি শিখেছি মানুষের বিষয়ে সংবেদনশীল হতে, কিছুটা হলেও আমাদের প্রতিষ্ঠানে সেটা প্রতিফলিত করার চেষ্টা করি। সব সময় পারি না। ব্যক্তিগত উপলব্ধি থেকে আরেকটি কাজ আমরা করার চেষ্টা করেছি অ্যাপেক্সে, কোনো নির্দিষ্ট কাজ নারীর বা কোনো নির্দিষ্ট কাজ পুরুষের—এই ভাবনা থেকে বের হয়ে এসেছি। আমাদের কারখানায় যেসব বিভাগে আগে শুধু পুরুষেরা কাজ করতেন, পরে সেসব বিভাগে নারীদেরও নেওয়া হয়েছে। তাঁরা অনেক ভালো করছেন সেখানে। নারী–পুরুষের মধ্যে লিঙ্গ দিয়ে কাজের ক্ষেত্রে কোনো বিভাজন না করার মানসিকতা তৈরিতে আমার মনে হয় আমার মায়ের অবদান অনেক। তিনি কোনো দিন আমাদের বুঝতে দেননি, এটা ছেলের কাজ, এটা মেয়ের কাজ। এটা তিনি কোনো দিন বলেননি, এই চর্চাও করেননি।
মায়ের একটা গুণের কথা বলতেই হবে, আমার মা খুব অন্যের কথা ভাবেন, সবাইকে সন্তুষ্ট করতে চান। বাস্তবে সব সময় সেটি করা সম্ভব না। কীভাবে যেন সব সময় অন্যের মনের ভালো–মন্দ সবকিছু বুঝতে পারেন। সেই কষ্ট খারাপ লাগা লাঘব করার চেষ্টা করেন। ওই সবাইকে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে,সবার মনমতো করে করতে না পারলে মাঝেমধ্যে অন্যের থেকে আঘাত পান মনে। মা কষ্ট পাচ্ছেন দেখলে ছেলে হিসেবে আমার খুব কষ্ট হয়। তবে মায়ের এই গুণের জন্য সন্তান হিসেবে গর্ববোধও করি।
সানবীমস স্কুলে ৯০০ জন ছাত্রছাত্রীকে তিনি নিজের বাচ্চা বলেন। তিনি যখন বলেন ‘আমার বাচ্চারা’, তখন বুঝে নিতে হবে আমাদের দুই ভাইবোনের কথা বলা হচ্ছে না। স্কুলের বাচ্চাদের বলেন আমার বাচ্চারা। স্কুলের কোনো বাচ্চার যেকোনো বিষয়ে তিনি বিচলিত হন। সারাক্ষণ তাদের কথা ভাবেন। একটি কথা না বললেই নয়, কোনো বৈষয়িক জিনিস আমার মাকে মুগ্ধ করতে পারে না। শুধু ভালো ব্যবহার দিয়ে সহজে আমার মায়ের মন জয় করা যায়। আমার নানার সঙ্গে আমার মায়ের খুব সখ্য ছিল। নানা সব সময় বলতেন, এমনভাবে জীবনযাপন করবে, যাতে সব পরিবেশে একই রকম আচরণ করতে পারো। মানুষের অবস্থান ভেদে ভেদাভেদ করবে না। নানার এই কথা মা সারাজীবন মনে রেখেছেন। সবার সঙ্গে মেশা, ভালো ব্যবহার করা মায়ের থেকে শেখার চেষ্টা করেছি। মা কখনো আমাকে তুলে খাইয়ে দিয়েছেন, সেটা মনে পড়ে না। এটা আত্মনির্ভরশীল করেছে।
যত চাপই আসুক না কেন, কোনো অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি আমার মা।
মায়ের স্কুলে আমি পড়তাম। সেখানে মা ছিলেন অধ্যক্ষ। গাড়ি স্কুলের গেটে পৌঁছা পর্যন্ত তিনি ছিলেন আমার মা—গাড়ি থেকে নেমেই তিনি হয়ে যেতেন প্রিন্সিপাল মিসেস মঞ্জুর। স্কুলে ‘মিসেস মঞ্জুর’ ই ডাকতাম। এটাতেই আমরা অভ্যস্ত ছিলাম। আমার সন্তানেরাও তাতেই অভ্যস্ত। আমার বাবা মঞ্জুর এলাহীর বিভিন্ন পরিচয় আছে, কিন্তু অনেক জায়গায় তিনি আমার মায়ের পরিচয়ে পরিচিত হতেন, এখনো হন।
মায়ের একটা অসাধারণ প্রতিভার কথা বলতেই হবে, সানবীমস থেকে যতজন শিক্ষার্থী এখন পর্যন্ত বের হয়েছেন, পড়ছেন, সবার নাম ও ব্যাচ মা অনায়াসে বলে দিতে পারেন। কোনো দিন ভুল হয় না। এটা দেখে সত্যি আমি বিস্ময় বোধ করি। ৭০ বছর বয়স পার হয়েছে তাঁর। কিন্তু নিরন্তর নিজের মতো করে কাজ করে চলেছেন। মায়ের অন্য রকম একটা বিষয়ে আগ্রহ আছে। কাগজ খুব পছন্দ করেন—উপহার কী পেলেন তার থেকে কোন মোড়কে দিল, সেটি তাঁর কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সেসব এমনকি সংগ্রহও করেন। আমাদের স্কুলের রিেপার্ট কার্ড থেকে শুরু করে ছোটবেলায় জন্মদিনে যে উপহারগুলো পেয়েছি েসগুলোর মোড়ক, এমনকি আমার বিয়ের উপহারের কাগজের মোড়কগুলো বাড়িতে পাওয়া যাবে।
আজকে আমি যতটুকু আসতে পেরেছি, সেটার পেছনে যদি কারও একক কৃতিত্ব হয়ে থাকে, আমি
মনে করব সেটা আমার মায়ের। তিনি যে আমাদের জন্য কত বড় অনুপ্রেরণা, সেটা যথেষ্ট বলা হয়নি তাঁকে। মা দিবসে নয়, সব দিনে তাঁর স্বীকৃতির কথা অনুভব করি।
লেখক: অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।