এক. বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই বছরের জুনিয়র মেয়েটির প্রেমে পড়ল আকাশ (ছদ্মনাম)। একদিন সাহস করে ভালোবাসার কথা বলে ফেলল মেয়েটিকে। কিন্তু মেয়েটি জানাল তার পক্ষে এই ভালোবাসা গ্রহণ করা সম্ভব নয়। এরপরও আকাশ হাল ছাড়ে না, অনেকভাবে সেই মেয়ের মন পাওয়ার চেষ্টা করে। কিছুতেই কিছু হলো না, বছর না ঘুরতেই মেয়েটি অন্য একটি ছেলের সঙ্গে প্রেম করা শুরু করল। প্রত্যাখ্যাত হয়ে আকাশ পড়ালেখা প্রায় ছেড়ে দিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা কমিয়ে দিল। নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করল। তার এই অবস্থা দেখে বন্ধুরা তাকে নিয়ে হাসাহাসি করতে লাগল। এতে আকাশের রাগ বাড়তে লাগল, একটুতেই তার মেজাজ খারাপ হওয়া শুরু করল।
দুই. উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্রী স্বপ্না (ছদ্মনাম)। সে পছন্দ করে তার এক বান্ধবীর বড় ভাইকে। একদিন সে দীর্ঘ এক প্রেমের বার্তা পাঠাল তাকে। সেই ভাইটি বেশ রূঢ়তার সঙ্গেই সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করল। এই প্রত্যাখ্যানে স্বপ্নার রাগ বাড়তে লাগল নিজের ওপর। একদিন একগাদা ঘুমের ওষুধ খেয়ে ফেলল। হাসপাতালে চার দিন থেকে তারপর সে সুস্থ হলেও বিষণ্নতায় ভুগতে লাগল।
প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে আকাশ আর স্বপ্নার মতো আচরণ করে থাকে অনেকেই। কেউ ‘ভাবুক’ হয়ে ওঠে, কেউবা শিশুদের মতো আচরণ করতে থাকে। কেউ নিজের ক্ষতি করে, কেউ ঝুঁকে পড়ে মাদকের মতো ক্ষতিকর বস্তুর দিকে। আবার অনেকে রাগের মাথায় হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে এমন কিছু করে ফেলে যা সবার জন্যই ক্ষতিকর। কেউবা ‘প্রতিহিংসা’ প্রদর্শন করে! এর কোনোটিই কিন্তু সঠিক পথ নয়।
ফ্রয়েডের তত্ত্ব অনুযায়ী মানুষের আচরণ আর মানসিক প্রক্রিয়া পরিচালিত হয় ‘ইড’, ‘ইগো’ আর ‘সুপার ইগো’র মাধ্যমে। আমাদের সব কামনাবাসনার চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করে ইড। এটি কেবলই আমাদের তৃপ্ত করতে চায় যেভাবেই হোক না কেন। আমাদের নৈতিকতার মধ্যে বেঁধে রাখতে চায় সুপার ইগো। এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে ইগো। এই ভারসাম্য রক্ষা করাকে বলা যেতে পারে ইগো ডিফেন্স মেকানিজম।
মানুষ যখন ইডের মাধ্যমে পরিচালিত হয় তখন সে কেবল চায়, যেনতেন প্রকারে নিজের চাওয়াটাকে পেতে। না পেলে তার মধ্যে পাশবিক প্রবৃত্তি মাথাচাড়া দেয়। প্রতিহিংসা আর নিষ্ঠুরতার পেছনে থাকে ইডের প্রভাব। ফলে প্রেমে ব্যর্থ হয়ে যদি কেউ আগ্রাসী হয়ে ওঠে, নিজের প্রতি বা অপরের প্রতি—তখন তার সুপার ইগো পরাজিত হয়, এলোমেলো হয় ইগো ডিফেন্স। এতে সে মানবিক গুণাবলি হারাতে থাকে। কে কীভাবে ইগোকে সুরক্ষা (ডিফেন্স) করবে, কীভাবে ইডের প্রভাববলয় থেকে নিজেকে রক্ষা করবে তা নির্ভর করে তার শৈশবের বিকাশ, পারিবারিক পরিবেশ, সামাজিক শিক্ষা, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এবং তার সমাজ ও সংস্কৃতির ভৌত কাঠামোর ওপর। পাশাপাশি আশপাশের মানুষের আচরণও তাকে অনেকটা প্রভাবিত করে।
প্রেমে ব্যর্থ হয়ে কেউ একজন সফল প্রেমিককে অনুকরণ করতে থাকে (আইডেন্টিফিকেশন), কেউ বা নিজের চেয়ে দুর্বলতর কোনো ব্যক্তির ওপর নিজের রাগ–ক্ষোভ ঝাড়তে থাকে (ডিসপ্লেসমেন্ট) আবার কেউ উদাসী ভাবুক হয়ে যায় (সাবলিমিশন)। কেউ বা প্রেমে ব্যর্থ হওয়ার বিষয়টি ভুলে থাকতে চেয়ে সেটাকে অস্বীকার করা শুরু করে (ডিনায়াল)। কেউ নিজের বৈশিষ্ট্যগুলো আরেকজনের মধ্যে খুঁজে নেয় (প্রজেকশন)। কেউবা উল্টোটাই বলা শুরু করে যে কখনোই কাউকে প্রেম নিবেদন করেনি (রিয়্যাকশন ফর্মেশন)। অনেকে বিষয়টিকে যুক্তিবোধ দিয়ে মেনে নেয়, মনের কষ্ট কাটিয়ে উঠতে আবার নতুন কারও সঙ্গে প্রেম করতে সচেষ্ট হয় (র্যাশনালাইজেশন)। এগুলো সবই হচ্ছে নিজের ইগোকে সুরক্ষা করার প্রক্রিয়া বা ইগো ডিফেন্স মেকানিজম। যা মানুষের ‘ইড’ আর ‘সুপার ইগো’র মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে। এর কোনো কোনোটি ইতিবাচক আবার কোনোটি নেতিবাচক।
প্রেমে ব্যর্থ হলে নেতিবাচকভাবে নিজের ইগোকে সুরক্ষা না করে (যেমন রাগ করা, নিজের ক্ষতি করা, আরেকজনের ওপর আগ্রাসী হয়ে যাওয়া, প্রতিহিংসায় জ্বলতে থাকা) ইতিবাচকভাবে বিষয়টিকে মোকাবিলা (যেমন: যুক্তিবোধ দিয়ে বিষয়টি ব্যাখ্যা করা, সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রাখা, নিজের দৈনন্দিন কাজগুলো করতে পারা) করতে হবে। একই সঙ্গে আশপাশের মানুষজনের আচরণ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সবকিছুকে বিবেচনায় এনে আচরণকে পরিশীলিত করতে হবে।
প্রেম আবেগের একটি বহিঃপ্রকাশ। মার্কিন মনোবিজ্ঞানী এবং কর্নেল ইউনিভার্সিটির হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক রবার্ট জে স্টার্নবার্গ ভালোবাসাকে তিনটি উপাদানের মধ্যে ভাগ করেছেন। সেগুলো হলো, কারও প্রতি বিশেষ আবেগীয় আকর্ষণ, অন্তরঙ্গতা ও একটি দায়বদ্ধতা। আবেগীয় আকর্ষণ থেকে প্রেম নিবেদন করা যেতেই পারে কিন্তু সেটা সফল প্রেম হবে কি না, তা নির্ভর করে পারস্পরিক অন্তরঙ্গতা আর দায়বদ্ধতার ওপর।
মার্কিন টিভিব্যক্তিত্ব, লেখক ও মনোবিজ্ঞানী ফিলিপ ম্যাকগ্রো, যিনি ড. ফিল হিসেবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরিচিত—তিনি বলেছেন, মানুষের অন্যতম প্রধান একটি ভয় হচ্ছে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ভয়। মানুষ সব সময় অপরের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে চায়, আর এই চাওয়াটা প্রকট হতে থাকে যখন সে সত্যি সত্যি প্রত্যাখ্যাত হয়। আর প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হলে তা মানুষের মন ও শরীর উভয়ের ওপরই চাপ ফেলে। তীব্র মানসিক চাপে পড়ে যায় আর নেতিবাচক আবেগগুলো তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়।
প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হলে সেটাকে মানিয়ে নেওয়ার জন্য যা যা করা করা উচিত বলে গবেষকেরা মনে করেন তা হচ্ছে: