প্রেমের কথা বলতে গিয়ে জানলাম সে আরেকজনকে ভালোবাসে

পাঠকের কাছ থেকে মনোজগৎ, ব্যক্তিজীবন ও সন্তান পালনের মতো সমস্যা নিয়ে ‘পাঠকের প্রশ্ন’ বিভাগে নানা রকমের প্রশ্ন এসেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশন অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক মেহতাব খানম নির্বাচিত একটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন এবার

মেহতাব খানম

প্রশ্ন: আমার বয়স এখন ১৯ বছর। গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। গ্রামের একটি স্কুল থেকে ২০১৯ সালে এসএসসি পরীক্ষা দিই। কারমাইকেল কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিকে বসেছি।

অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকেই আমার এক বান্ধবীকে খুবই ভালো লাগত। এখনো লাগে। তার সামনে গেলেই শরীর কাঁপা, কথায় জড়তা, লজ্জা পাওয়া ইত্যাদি ঘটতে থাকে। তাকে নিয়ে মনের মধ্যে অন্য রকম একটা জগৎ তৈরি করেছিলাম। সেই জগতে আমার ভাবনার গভীরতা ছিল বিশাল, তাকে নিয়ে নিত্যনতুন স্বপ্ন দেখতাম।

অনেক চেষ্টা করেও তাকে আমার মনের কথা বলতে পারিনি। এর যথেষ্ট কারণও ছিল। প্রথমত, আমি ক্লাসের ফার্স্ট বয় ছিলাম, আমার পড়াশোনার গতি বজায় রাখার পাশাপাশি পরিবারের স্বপ্ন পূরণে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম। দ্বিতীয়ত, বড় ভাইয়ের অনুপ্রেরণা, সামাজিক প্রতিবন্ধকতার (প্রেম করা ভালো নয়) কারণে আমি নিজের মনের অবস্থা ব্যক্ত করতে পারিনি। দশম শ্রেণি পর্যন্ত তাকে দূর থেকেই ভালোবেসে যাই। তার আচরণও আমার কাছে ইতিবাচক মনে হয়েছিল। তাই সিদ্ধান্ত নিই, সব প্রতিবন্ধকতা দূর করে এসএসসি পরীক্ষার পর আমার মনের কথা খুলে বলব। কলেজে ভর্তির আগে তার সঙ্গে কথা বলা বা দেখা করা বেশি হয়ে ওঠেনি। আমাদের যা কথা বা দেখা হতো, সব ক্লাসরুমের ভেতরেই। কিন্তু তার প্রতি আমার আবেগ, অনুভূতি, ভালো লাগা একটুও কমেনি। একদিন আমার মনের কথা তাকে বলে দিই। কিন্তু তার কথায় বুঝতে পারি, তত দিনে সে অন্য কারও হয়ে গেছে। অন্য একটি ছেলের সঙ্গে সে প্রেমের সম্পর্ক গড়েছে। সম্প্রতি তাদের বিয়েও হয়েছে। এখন আমি কলেজে পড়ি। একটু হলেও বাস্তবতা বুঝতে শিখেছি। তাকে ভুলে থাকার চেষ্টা করেছি, মনকে অনেক বুঝিয়েছি, নিজের মনের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে যাচ্ছি। কিন্তু আমি ব্যর্থ। আবেগ, দুর্বলতার জায়গাটির কাছে সবকিছু হেরে যাচ্ছে।

এখনো তার কথা আমার মনে পড়ে। তাকে একটি পলক দেখার জন্য প্রতিনিয়ত আমার মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে। অস্থিরতা কাটাতে পারি না। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, আমার মনের অবস্থা কি কখনো ভালো হবে না? কীভাবে ভালো করতে পারি? কত দিন সময় লাগবে?

মো. আল-আমিন, রংপুর

উত্তর: এত সুন্দরভাবে নিজের আবেগ ও চিন্তাগুলো গুছিয়ে লেখার জন্য ধন্যবাদ।

বয়ঃসন্ধিকালে যখন আমাদের শরীর ও মনের বড় ধরনের পরবর্তনগুলো হয়, তখন বিপরীত লিঙ্গের কারও প্রতি অত্যন্ত দুর্বল বোধ করা খুব স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া। সেই সময়ে মেয়েটির প্রতি প্রবল আকর্ষণ ও ভালোবাসার অনুভূতি ভেতরে থাক‌লেও তুমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করেছ এই ভেবে যে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে গেলে পড়ালেখা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, বড় ভাইকে হতাশ করা হবে এবং সমাজও এটিকে ভালো দৃষ্টিতে দেখবে না। কাজেই তোমার কাছে যে জোরালো যুক্তিগুলো ছিল, তার ভিত্তিতে তুমি মেয়েটিকে সেই মুহূর্তে প্রেমের প্রস্তাব দেওয়াটা সঠিক মনে করোনি। নিজেকে আলাদা রেখে তুমি একা একাই ওর প্রতি তীব্র অনুভূতিটি ক্রমাগত লালন করে গেছ বলে কল্পনার জগৎটি অনেক প্রসারিত হয়েছে। তাকে ঘিরে এই একতরফা চিন্তাগুলো থেকে নিজেকে সরাতে চেষ্টা করোনি এবং তুমি বিশ্বাস করতে চেয়েছ যে সে–ও তোমাকে মনে মনে ভালোবাসছে। ওকে বলবে কি না, এ দ্বিধা কাটাতে বেশ খানিকটা সময় লেগেছে। এর মধ্যেই মেয়েটি অন্য কাউকে পছন্দ করেছে এবং সম্পর্কও তৈরি করেছে। হয়তোবা এ কারণে এখন তুমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারছ না বলে নিজেকে দোষারোপও করে ফেলেছ।

কারও সম্পর্কে ভালোভাবে না জেনে আমরা যদি দূর থেকে শুধু ভালোবাসতেই থাকি, তাহলে তার ভালো দিকগুলোই শুধু চিন্তা করি। কিন্তু যদি তার সঙ্গে ভালোভাবে পরিচিত হই এবং একটি বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে, তখন তার ভালো-মন্দ সব সম্পর্কে আমাদের একটি ধারণা তৈরি হয়। যদি আগে অন্তত তার বন্ধু হতে পারতে, তাহলে হয়তো ওর পছন্দ–অপছন্দ এবং দোষ–গুণগুলো সম্পর্কে অবগত হতে পারতে। তুমি অত্যন্ত ভদ্র ও সংযমী একটি মানুষ বলে নিজেকে নিবৃত্ত করে রেখেছ। খুব ভালো হয় যদি তুমি সেই সময়ে নেওয়া সিদ্ধান্তটিকে বর্তমানে শ্রদ্ধা করতে পারো। তোমার কাছে বড় ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসা, নিজের ভবিষ্যৎ গড়ে নেওয়া সেই সময়ে যে প্রাধান্য পেয়েছে, সেটি কিন্তু প্রশংসারও দাবি রাখে।

অনেক সময় বয়ঃসন্ধিকালে প্রেমের সম্পর্কে অনেক টানাপোড়েন হয় বলে লেখাপড়ায় ক্ষতিও হয়ে যায়। যেহেতু আবেগের জায়গাটি খুব বেশি করে থাকে, সেই কারণে অনেক সময় সম্পর্ক ভেঙেও যায়। নিজেকে প্রশ্ন করতে পারো যে আগে প্রস্তাবটি দিলে সে যে সাড়া দিতই, এর কোনো প্রমাণ তোমার কাছে আছে কি না। যদি প্রত্যাখ্যাত হতে, তাহলে ভাঙা মনটিকে কীভাবে ঠিক করতে সেই আবেগের বয়সটিতে। তুমি অবদমন করতে পারতে কি না, তা কিন্তু কেউ জানে না।

আমার অনুরোধ এই যে জোর করে মেয়েটিকে ভুলে থাকার চেষ্টা কোরো না। কারণ, আমাদের মনোজগতের ধর্মই হচ্ছে, যাকে জোর করে ভুলতে চাই, সেই মানুষের কথা বারবার মনে পড়ে। সেটি না করে বরং ওর প্রতি তোমার যে পবিত্র অনুভূতিটি এখনো রয়েছে, সেটির প্রতি পরিপূর্ণ সম্মান রক্ষা করে তোমার অত্যন্ত সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎকে সাহস নিয়ে মোকাবিলা করার সংকল্প গ্রহণ করো। হয়তোবা আজ থেকে কিছুদিন পর তুমি নিজেকে নিয়ে গর্বিত হতে পারবে, যখন দেখবে স্বপ্নপূরণের পথে তুমি অনেকটাই এগিয়ে গেছ। নিজেকে সম্পূর্ণ ক্ষমা করে দিতে চেষ্টা করলে খুব ভালো হয়।

পাঠকের প্রশ্ন, বিশেষজ্ঞের উত্তর

পাঠকের প্রশ্ন পাঠানো যাবে ই–মেইলে, ডাকে এবং প্র অধুনার ফেসবুক পেজের ইনবক্সে।

ই–মেইল ঠিকানা: adhuna@prothomalo.com

(সাবজেক্ট হিসেবে লিখুন ‘পাঠকের প্রশ্ন’)

ডাক ঠিকানা

প্র অধুনা, প্রথম আলো, প্রগতি ইনস্যুরেন্স ভবন

২০–২১ কারওয়ান বাজার, ঢাকা ১২১৫। (খামের ওপর লিখুন ‘পাঠকের প্রশ্ন’)

ফেসবুক পেজ: fb.com/Adhuna.PA