প্রথম দেখায় প্রেম শুধু গল্প বা সিনেমাতে নয়, বাস্তবেও ঘটতে পারে। মডেল: মুসকান ও আজাদ
প্রথম দেখায় প্রেম শুধু গল্প বা সিনেমাতে নয়, বাস্তবেও ঘটতে পারে। মডেল: মুসকান ও আজাদ

প্রথম দেখায় প্রেম

‘...তারপর হঠাৎ জলের শব্দে আপনার চমক ভাঙবে। নিথর জলে ঢেউ উঠেছে, আপনার ছিপের ফাতনা মৃদুমন্দভাবে তাতে দুলছে। ঘাড় ফিরিয়ে দেখবেন একটি মেয়ে পেতলের একটি ঝকঝকে ঘড়ায় পুকুরের পানা ঢেউ দিয়ে সরিয়ে জল ভরছে। মেয়েটির চোখে কৌতূহল আছে কিন্তু গতিবিধিতে সলজ্জ আড়ষ্টতা নেই। সোজাসুজি সে আপনার দিকে তাকাবে, আপনার ফাতনা লক্ষ করবে, তারপর আবার মুখ ফিরিয়ে ঘড়াটা কোমরে তুলে নেবে।

‘মেয়েটি কোন বয়সের আপনি বুঝতে পারবেন না। তার মুখের শান্ত করুণ গাম্ভীর্য দেখে মনে হবে জীবনের সুদীর্ঘ নির্মম পথ সে পার হয়ে এসেছে, তার ক্ষীণ দীর্ঘ অপুষ্ট শরীর দেখলে মনে হবে কৈশোর অতিক্রম করে যৌবনে উত্তীর্ণ হওয়া তার যেন স্থগিত হয়ে আছে। কলসি নিয়ে চলে যেতে-যেতে ফিরে তাকিয়ে মেয়েটি হঠাৎ বলবে, “বসে আছেন কেন? টান দিন।”’

পাঠক, মেয়েটি কলসি নিয়ে চলে যাওয়ার আগেই ফুরিয়ে যাওয়া কাশের আড়ার ফাঁক দিয়ে শেওলা-ঢাকা ভাঙা ঘাটে উঁকি দিন, দেখুন মেয়েটির শান্ত করুণ মুখে কেমন খেলে গেছে দীপ্ত হাসির আভাস। সেই আভার ভেতরে নতুন সুরের টিউন বাড়িয়ে চলে গেল, ভেতরে একটা পথ চিরে সুর ছড়িয়ে পড়ছে কেবল। নায়কের মুখে আর কোনো কথা নেই। সমূহ কথা, এই সুরের কাছে এসে থেমে গেছে। কেন?

এই গল্পের নায়িকার নাম যামিনী। আর নায়ক, লেখক নিজেই—প্রেমেন্দ্র মিত্র। তাঁদের এই দৃশ্য প্রেম প্রেম ভাব মনে হলেও ওই এক-দুই মিনিটের দেখাতেই যামিনীর প্রেমে পড়েছিলেন লেখক, যামিনীও। তৃতীয় সাক্ষাতে তা স্পষ্ট। এই প্রেমের পরিণতি জানতে প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’ গল্পের কাছে যেতে হবে। এভাবে হয়তো আপনিও একদিন আপনার ‘আমি’কে আবিষ্কার করতে পারেন।

এক পলকের দেখা, তাতেই মন উথাল পাথাল

২.

‘সুবর্ণদহর জলে পাতার নৌকা ভাসিয়ে ফিরে আসার প্রতীক্ষায় তুনাই। তার কুঁকড়ে যাওয়া শরীর। এই চোখ থেকে আড়চোখ লুকোবে বলে শিশুগাছের দিকে মুখ করে গান ধরে। সূর্যমুখী গান। আর আমি ভেসে ভেসে যাওয়া পাতার নৌকার দিকে চেয়ে। গানের সুর জল কাঁপিয়ে পেরিয়ে যাচ্ছে ছায়ামরিচের বন। সেই সুর কীভাবে যেন আটকে ফেলছে আমাকে, হাওয়াকে, জলকে। পৃথিবীর সমস্ত শব্দ, সমস্ত সুর যেন চুপ মেরে আছে তার সুরের ভেতর। বলেছিল, কোনো সুর যদি গুমরে ওঠে বুকের ভেতর, তবে তা থামাতে নেই। চুপচাপ শুনে যেতে হয়। কিন্তু সে জানে না, গুমরে ওঠা মানেই কেঁদে ফেলি বারবার। বলেছে আরও, কারও সুরে যদি কেঁপে কেঁপে ওঠে জল, তবে বুঝে নেবে, ভেতরে ভেতরে নিদারুণ পুড়ে যাচ্ছে সে! আমি তার পুড়ে যাওয়া দেখি। দেখি পুড়ে যাচ্ছে তুনাই, পুড়ে যাচ্ছে জল, পুড়ে যাচ্ছে হাওয়াদের ঘরবাড়ি, মাছেদের প্রেম, পাতার নৌকার চলাচল। গান থামিয়ে দেখে নেয় তুনাই—আমাকে আর পাতার নৌকা। নোঙরের আগেই নৌকা ভেসে গেছে নিরুদ্দেশের দিকে। তুনাইর পুড়ে পুড়ে যাওয়া বুক আর আমার মধ্যে এই সুনসান নির্জনতায় একটি পথ খুলে যায়, বিশ্বাসের।’

এই সুনসান নির্জনতায় খুলে যাওয়া পথের নামও হয়তো প্রেম। প্রথম দেখায় কিশোরবেলার প্রেম। এখানেও নায়ক গল্প কথক ‘আমি’। দুজনে এক হওয়ার আগে তুনাইর সঙ্গে সেই ‘আমি’র দূরত্ব বেড়ে গেছে। আর প্রেম? সে প্রসঙ্গে পরে বলছি।

৩.

একটু দেখা, না-কথা, কথা, মন ও শরীর পেরিয়ে দুজনকে হেঁটে যেতে হয় অচিন পথের দিকে। এই পথে যেতে যেতে একজন আরেকজনের হৃদয়ে মিলিয়ে যাবে। যেন দুজনকে আর আলাদা করে চিনতে না পারা যায়। পরিণতি যাই হোক, এই যাত্রার নামই হয়তো প্রেম।

কেন এই প্রথম দেখায় প্রেম? কেন প্রথম দেখাতেই জীবনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া, বহুদিন একসঙ্গে থেকে যাওয়া, না-যাওয়া—এসব হয়তো মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ব্যাখ্যা করতে পারবেন।

বাস্তবে সাহিদ ও ঋতুর (ছদ্মনাম) প্রথম দেখার প্রেমটা এমনই। সাহিদের বর্ণনায়, তাঁদের প্রথম দেখায় প্রেমের শুরু ১৯৯২ সালে। ছোট ভাইকে স্কুলে পৌঁছে দিতে গিয়ে অনেকটা বেকার জীবনে সাহিদের সঙ্গে দেখা নার্সিং ইনস্টিটিউটের ছাত্রী ঋতুর। একজনের মুচকি হাসি, আরেকজনের মুখে ফুটে উঠেছিল সেদিন। স্কুল ছুটির ঘণ্টা বাজা অবধি গুটুর গুটুর কথা। ঘণ্টা বাজলেই যেন তাদের ঘরে ফেরার পথ দীর্ঘ হয়ে ওঠে। এভাবে পথ হেঁটে যেতে যেতে তারা হৃদয়ে হৃদয় মিলিয়ে ফেলেন। অতঃপর ১৯৯৫ সালে দুই পরিবারের সম্মতিতে বিয়ে। সংসারে এখন এক ছেলেসহ তারা তিনজন। দীর্ঘ ২৮ বছর পরও তারা সেই প্রথম দেখায় প্রেমের কথা মনে করেন। মনে করতে চান জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।

সে আমার মন কেড়েছে

সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে সারওয়ারের কবিতা ও গদ্য পড়েই তার ভাবনার সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন নুসরাত (ছদ্মনাম)। সেখানেই টুকটাক কথা। মেসেঞ্জারে লেখা ছোট্ট টেক্সট ‘হুমম’–এর ভেতরেই যেন অনেক কথা শুনতে পেয়েছিলেন নুসরাত। সারওয়ারের লেখা পড়েই বুকের ভেতর কেমন একটা হাওয়া ঢুকে পড়ত। প্রথম দেখা বইমেলায়, ক্ষণিকের জন্য। সেই দেখাতেই উসকে ওঠে হাওয়া।

নুসরাত বলেন, প্রথম দেখাতেই তিনি সারওয়ারের প্রেমে পড়েছিলেন। দুজন দুই শহরের মানুষ। দেখা তো দূর, ফোনেও কথা হতো খুবই কম। একদিন সাহস করে বলেন, ‘ভালোবাসি।’ ফোনের ওপারে মানুষটি সম্মানের সঙ্গে জানিয়েছিলেন, তা গ্রহণে সীমাবদ্ধতার কথা। বছর যায়; সীমানা ডিঙিয়ে দুজন একই ভাবনা ভাবতে থাকেন। হৃদয়ে হৃদয় মেলাতে খুব বেশি দিন হাঁটতে হয়নি তাদের। গাঁটছড়া বাঁধেন ২০১৫ সালে। দুজনের আদরে এখন বড় হচ্ছে তাদের মেয়ে। যেন হিসাব মেলাতে না পারেন, এমন অসংখ্য যুগ তারা একসঙ্গে থেকে যেতে চান কবিতা-প্রেম-বিষাদ ও আনন্দে।

এ তো গেল প্রথম দেখায় প্রেমের সফল পরিণতির কথা। কিন্তু ব্যবসায়ী পরিবারের সোমানি ও জয়ার (ছদ্মনাম) প্রেমের শেষটা অন্য রকম। তাদের স্মৃতিতে এখন জমা হয়ে আছে পুরোনোর চুরমার। ২০১৬ সালের কথা। প্রথম দেখাতেই প্রেমে পড়েছিলেন দুজনে। একে অপরকে পুরোটা চেনার আগেই হয়তো বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তারা। শুরুতে পরিবার বাধা দিলেও পরে মহাধুমধামে বিয়ে হয়। কিন্তু তাদের ঘরের পাশে একবারের বেশি কোকিল ডাকেনি কখনো। তার আগেই দুজনের পথ আলাদা হয়ে গেছে।

৪.

পাঠক, যদি নিজের ‘আমি’কে খুঁজে পান, তাহলে দেখবেন, এই একজন আমি একলা হয়ে ধীরে, নিঃশব্দে পৃথিবীর পথে হেঁটে যাচ্ছে। হঠাৎ বুকের ভেতরে জেগে ওঠে তার পুরোনো প্রেমের ঘাই। ভুলোমনে ডেকে ওঠে, তুনাই তুনাই...।

প্রথম দেখার আকর্ষণই প্রেমে পরিণত হয়

আহমেদ হেলাল

সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা

প্রথম দেখাতে প্রেম হতেই পারে। গবেষকদের মতে প্রথম দেখায় প্রেম একটি ‘পজিটিভ ইলিউশন’ (ইতিবাচক মায়া)। অনেকটা এমন, পারস্পরিক বোঝাপড়া আর সময় গড়ানোর পর প্রেমটি পাকাপোক্ত হলেও মূল বিক্রিয়াটি ঘটে গিয়েছিল প্রথম দেখায়! বিক্রিয়া বলার কারণ, প্রেমে পড়লে মস্তিস্কে রাসায়নিক কিছু পরিবর্তন ঘটে। প্রথম দেখার পর তাৎক্ষণিক যে আকর্ষণ তৈরি হয়, সেটাই পরবর্তী সময়ে প্রেমে রূপ নেয়। যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনস্তত্ত্বের অধ্যাপক স্টেনবার্গ আশির দশকে ভালোবাসার ত্রিভুজ তত্ত্ব ব্যাখা করতে গিয়ে বলেন, প্রেমের উপাদান তিনটি—অন্তরঙ্গতা (ইন্টিমেসি), আবেগ আর আগ্রহ (প্যাশন) ও প্রতিশ্রুতি (কমিটমেন্ট)। প্রথম দেখাতেই যদি অন্তরঙ্গতা আর আবেগ তৈরি হয়, তবে পরবর্তী সময়ে দায়বদ্ধতা সৃষ্টি হলে ভালোবাসা পরিণতি পেতে বাধ্য। প্রথম দেখাতে আকর্ষণ করে বলেই আবেগ উত্সারিত হয়। আবেগের বশবর্তী হয়ে দ্বায়বদ্ধতার সৃষ্টি হয়। ২০১৭ সালে নেদারল্যান্ডে ৪০০ জন নারী-পুরুষের ওপর গবেষণা করে দেখা গেছে, প্রথম দেখাতে আকর্ষণবোধ তৈরি হয় বলেই পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে সম্পর্ক তৈরি হয়। এই গবেষণাতে দেখা যায়, নারীদের তুলনায পুরুষদের মধ্যে প্রথম দেখাতে প্রেমে পড়ার হার বেশি। তবে শেষ পর্যন্ত গবেষকরা বলেন, প্রথম দেখায় ‘প্রকৃত’ প্রেম তৈরি হয় না, বরং সেখানে তীব্র আকর্ষণবোধ তৈরি হয়, যেখান থেকে অন্তরঙ্গতা, আবেগ আর দ্বায়বদ্ধতা একত্র হয়ে ‘প্রকৃত’ প্রেমের জন্ম নেয়। কোনো কোনো গবেষক এটাকে বলেছেন ‘ইম্প্রেশন ফর্মেশন’। এই ইমপ্রেশন ফর্মেশন কিন্তু জরুরি। তাই প্রথম দেখাতে প্রেম হতেই পারে। কিন্তু সেই প্রেম টিকিয়ে রাখতে আর সফল করে তুলতে চাই অন্তরঙ্গতা, আবেগ-আগ্রহ আর দ্বায়বদ্ধতা। তাই প্রথম দেখায় ভালো লাগার পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে দেখুন, বুঝুন, জানুন— ভালোবাসার সব উপাদানের মিশেল সম্পর্কটিতে আছে কি না।