আবদুল গফুর মানিকের ১২ বছরের মেয়েটি জীবনানন্দ দাশের ‘রূপসী বাংলা কবিতা’ মুখস্থ করেছে। আর দেড় বছর বয়সী মুনতাহা এখন দেয়ালে চিত্রকর্ম করে প্রতিদিন। কিন্তু এসব দৃশ্যে অনুপস্থিত থাকেন তাদের বাবা। সংযোগহীন সম্পর্ক দেয় শূন্যতার অনুভব। কিন্তু চাইলেই তো সম্ভব নয় প্রিয়জনকে স্পর্শ করে থাকা। প্রয়োজন ও পরিবর্তনের সঙ্গে বদলেছে মানুষের ছুঁয়ে থাকার ধরন।
নোয়াখালীর মাইজদীর আবদুল গফুর প্রায় দুই দশক ধরে থাকেন সৌদি আরবে। নিজে যাওয়ার পর একে একে নিয়ে গেছেন পরিবারের আরও চার সদস্যকে। ২০০৭ সালে বিয়ে করেছেন। তিন সন্তানের জনক গফুর বলছিলেন, ভাবুন, যদি ভিডিও কলের সুযোগ না থাকত, তাহলে একদিন দেশে ফিরে হয়তো নিজের সন্তানের সঙ্গে আমার আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচিত হতে হতো। এখন তাঁর বড় মেয়েটি কবিতা মুখস্থ করে অপেক্ষা করে বাবার জন্য। মুহূর্তে তাঁর চারপাশ হয়ে যায় পরিবার ও দেশময়।
প্রথম আলোর প্রতিবেদন বলছে, প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকের সংখ্যা ১ কোটি ২৫ লাখ। হাজার হাজার মাইল দূর থেকে প্রিয়জনকে অদৃশ্য স্পর্শে ছুঁয়ে থাকার ইচ্ছেটুকু অন্তত এভাবেই পূরণ হয় এই মানুষদের। তবে মানবিক এই সম্পর্কের গল্পটি আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয় কর্মজীবী স্বামী-স্ত্রীর জীবনে।
মো. আজিজুল হক ঢাকা মেডিকেলের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক। তিনি নিজে করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। সুস্থ হয়ে আবার করোনার ডিউটি করছেন ফলে তাঁকে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হয়। এদিকে তাঁর চিকিৎসক স্ত্রী শারমিন আক্তার আছেন ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। ফলে এই দম্পতির প্রতিদিনের সব খবর আদান-প্রদান, সংসারের হিসাব, সন্তানের তদারকি, মা–বাবার ডায়াবেটিসের ওষুধের খবরটিও নিতে হলে নির্ভর করতে হয় ইন্টারনেটের ওপর।
২০১৫ সালের এক জরিপে উঠে এসেছে, বাংলাদেশে তরুণ ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর বিষয়ে নানা তথ্য। সেখানে বলা হচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সংযুক্ত ৮২ শতাংশই তরুণ। যাদের ৯৫ শতাংশ দিনে একবার হলেও ইন্টারনেট ব্যবহার করেন।
এর মধ্যে ৩৮ শতাংশ মাল্টিমিডিয়া ও বিনোদনের জন্য ব্যবহার করেন ইন্টারনেট। গত পাঁচ বছরে যে সংখ্যা আরও বহুগুণ বেড়েছে। আর এতে নির্ভরতা এসেছে বয়স্ক মানুষেরও। এই সেদিনও যে মানুষটি একটি স্মার্টফোন ব্যবহার করতে সংকোচ বোধ করতেন, এখন তিনি অবলীলায় ভিডিও কল করেন দূরে থাকা নাতনিকে। তবে প্রযুক্তিনির্ভরতা এখন অনেকখানি বদলে দিয়েছে মানুষের সম্পর্কের গল্প। কেউ কেউ অভিযোগ করছেন, ইন্টারনেটের ব্যবহার যেমন দূরত্ব কমিয়ে দিচ্ছে, আবার ভুল ব্যবহার দূরত্ব তৈরিতেও ভূমিকা রাখছে। এর উত্তর একটিই, মানুষের প্রয়োজন ও তাঁর বিবেচনাই তাকে গুরুত্বের কথা মনে করিয়ে দেয়।
পূর্ববর্তী প্রজন্মের মানুষেরা বহু প্রিয়জনকে শেষবার দেখার সুযোগ পাননি। তেমন কষ্ট আর এখন বয়ে বেড়াতে হয় না মানুষকে। হাতের ভেতর থাকা মুঠোফোনটি তাকে মুখোমুখি করে দেয় বহুদিনের না–দেখা প্রিয় মানুষের। এমনকি এই মাধ্যমের জন্যই খুঁজে পাওয়া যায় কয়েক দশক আগে হারিয়ে যাওয়া বন্ধুদেরও। যেমন সেদিন রাতে আট বন্ধুর দেখা হলো দুই যুগ পর। রাজধানীর এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১৯৯৪ এসএসসি ব্যাচের এই মানুষগুলো এখন ভিন্ন ভিন্ন মহাদেশে আছেন। তবু তাঁরা ঘুচিয়ে দিলেন সময়ের ব্যবধান। একজন শোনালেন সদ্য শেখা বাঁশির সুর। কেউ গাইলেন গান। হেঁড়ে গলায় একজন চেঁচিয়ে বললেন, বন্ধু তোকে মনে পড়ে। আর এই আবেগের দৃশ্যটি আমাদের কাছে ধরা পড়ল ইন্টারনেটের সুবাদে। প্রিয়জনের মুখ দেখতে পেলে রঙিন হয়ে ওঠে মানুষ।