একজন 'অসুন্দরী' বলছি

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আমার গায়ের রং কালো। ভদ্র ভাষায় কেউ কেউ বলেন শ্যামলা। আবার কেউ কেউ গায়ের রংটাকে বলেন ময়লা। যে নামেই বলা হোক, কৃষ্ণবর্ণের ধরনে কোনো পরিবর্তন হয় না। তার ওপর আমি শুকনা গোছের। লম্বার দিক থেকেও কম উচ্চতার। অর্থাৎ ‘সুন্দর’ বা ‘সুন্দরীর’ প্রচলিত ধারণার (যেমন লম্বা, ফরসা, কাটা কাটা চেহারা) সঙ্গে আমি যাই না। এ জন্য লোকে কম কথা শোনায় না। এটা যে বুলিং (অশালীন আচরণ, মানসিক নির্যাতন), বেশির ভাগ মানুষই সেটা মনে করে না।

সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনায় নিজের মনের ক্ষতগুলো যেন জেগে উঠল। ২৩ অক্টোবর প্রথম আলোর অনলাইনের এক খবরে প্রকাশ, রাজধানীর একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে চেহারার ধরনসহ নানা বিষয়ে সহপাঠীদের বুলিং সইতে না পেরে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে ১৫ বছর বয়সী এক কিশোরী। এর আগে ১৭ অক্টোবর নড়াইলের লোহাগড়া থেকে ছয় বছরের শিশু রমজানের লাশ উদ্ধার করা হয়। তদন্তের পর অভিযোগ উঠেছে, শিশুটি নাম ধরে খেপানোয় ক্ষুব্ধ হয়ে স্বজন এক কিশোরী তাকে হত্যা করেছে।


শুধু যে বাংলাদেশেই এমন, তা নয়। ৩০ অক্টোবর বিবিসি অনলাইনের একটি খবরে বলা হয়, স্বামী গায়ের রং নিয়ে স্ত্রীকে সারাক্ষণ কথা শোনানোয় বিয়ের ছয় মাসের মাথায় আত্মহত্যা করেছেন ভারতের রাজস্থানের এক নারী। উন্নত ও মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত কানাডায়ও ১২ বছর বয়সী কিশোর সহপাঠীদের বুলিং সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে। গ্লোবাল নিউজের খবরে বলা হয়, ভারত থেকে ছেলেকে নিয়ে কানাডায় বসতি গড়েছিলেন এক মা। গত ২১ জুন ছেলে আত্মহত্যা করে। এর চার মাস পর মা জানতে পারেন, কানাডার উন্নত স্কুলব্যবস্থাও বুলিংমুক্ত নয়। আর সেই বুলিং সইতে না পেরে তাঁর আদরের সন্তানটি আত্মহনন করেছে।

আমার ছোটবেলাটা যে কী বিভীষিকাময় ছিল! একে তো মেয়েসন্তান, তার ওপর কালো। মনে হয় আশপাশের মানুষের রাতে ঠিকমতো ঘুম হতো না কেমনে এই মেয়ের বিয়ে হবে, ভেবে। অসুখ লেগেই থাকত। ফলে খাওয়ার রুচি ছিল না। শরীর-স্বাস্থ্য অন্য বাচ্চাদের চেয়ে কম ছিল। মা-বাবাকে সারাক্ষণ শুনতে হতো, ‘মেয়েকে খেতে দেন না? সব নিজেরাই খান?’ শুনে আমার মা-বাবা কিছু বলতেন না, শুধু হাসতেন। কিন্তু আমি তো জানি, আমার মা-বাবা আমাকে কতভাবে খাওয়ানোর চেষ্টা করতেন। কোনো দিন একটা কিছু ভালোভাবে খেলে, সেটা খাওয়ানোর জন্য অস্থির থাকতেন। কত চিকিৎসকের কাছে যে নিয়ে যেতেন। সব চিকিৎসকের কাছে আমার মা-বাবার একটা সাধারণ আরজি থাকত, ‘মেয়েটা কেন খায় না? এমন একটা ওষুধ দেন না যেন মেয়েটার মুখে রুচি বাড়ে।’

কিন্তু তাঁদের এত চেষ্টার পরও আমি শুকনাই ছিলাম। স্কুলে সহপাঠীরা কত শত উপায়ে যে গায়ের রং আর ধরন নিয়ে আপত্তিকর কথা বলত, সেসব মনে করলেই কেমন যেন বিষণ্ন লাগে। আমি ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নিতে থাকলাম। হাইস্কুলে যে অল্প কজন সহপাঠী কখনো এমন কথা বলত না, কেবল তাদের সঙ্গেই আমার বন্ধুত্ব হলো। অন্যদের আমি এড়িয়ে চলতাম। নিজের মতো থাকতাম। বইপড়া, ছবি আঁকা, লেখালেখি করা, সেলাই করা, বাগান করা—আমার সময় কাটানোর সঙ্গী হয়ে ওঠে। যে কাজগুলো নিজে নিজে করা যায়, সেগুলোই আমার পছন্দ ছিল। মা-বাবার খুব শখ ছিল, আমি গান করব। গানের ক্লাসেও ভর্তি করালেন। আমি কয়েক বছর শিখলাম। পরে এমন একজনকে শিক্ষক হিসেবে পেলাম, যিনি বর্ণবাদী আচরণ করতেন। গান আর আমার ভালো লাগত না। আমি গান শেখাটা ছেড়ে দিলাম। কতবার যে মানুষের কটু কথা শুনে মরে যেতে ইচ্ছা হয়েছে!

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আমি ‘সুন্দর’ না, এটা আমার মনে এমনভাবে প্রভাব ফেলেছিল যে ছোটবেলায় আমি কোনো ছবি তুলতাম না। টেনেটুনেও আমাকে ক্যামেরার সামনে নেওয়া যেত না। এখন মনে হয়, কী বোকাই না ছিলাম আমি। আমার শৈশবের কোনো প্রামাণ্য দলিলই আমার কাছে নেই। কিছু লোকের বাজে কথাকে এত বেশি বিশ্বাস করেছিলাম যে নিজের ওপর আস্থাই রাখতে পারিনি।

কলেজজীবনটাও আমি মোটামুটি এভাবেই কাটিয়েছি। এরপর ভর্তি হলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। অনেকের কাছ থেকেই বাজে কথা শুনেছি। তবে আমার চারপাশে অসম্ভব ভালো ও সুন্দর ভাবনার কিছু বড় ভাইবোনকে পেলাম, যাঁদের কাছে সৌন্দর্যের সংজ্ঞাটাই আলাদা। নিজেকে গুটিয়ে রাখার ধারণা থেকে আমি বেরিয়ে এলাম। ক্যাম্পাসের সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হলাম। নতুন অনেক কিছু শিখলাম। সবচেয়ে বড় কথা, সৌন্দর্য বিষয়ে আমার আগেকার সবকিছু ভেঙেচুরে গুঁড়িয়ে গেল।

আমার কাছে ‘সুন্দরের’ সংজ্ঞা স্পষ্ট হতে লাগল। ‘সুন্দর’ মানে আত্মবিশ্বাসী হওয়া। ‘সুন্দর’ মানে জ্ঞানে–বুদ্ধিতে স্মার্ট হওয়া। আমি নিজেকে এখন ‘সুন্দর’ ভাবি। অবলীলায় ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে অনেক ছবি তুলি। ভালো প্রতিষ্ঠানে কাজ করি। আত্মবিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে যাই। আমি খুব সফল কেউ না। তবে আমি যদি বুলিংয়ের কারণে আত্মহননের পথ বেছে নিতাম, তাহলে তো এটুকু অর্জনও আমার থাকত না। তাই যাঁরা বুলিংয়ের শিকার হয়ে নিজেকে গুটিয়ে ফেলেন, তাঁদের বলতে চাই, জীবন অনেক সুন্দর কিছু নিয়ে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। অনেক মানবিক বন্ধু, স্বজন, কর্মস্থল আপনার জীবনকে রাঙিয়ে তুলবে।

বুলিং বন্ধ করতে হলে আসলে অভিভাবকদেরই আগে নিজেদের বদলাতে হবে। অন্যকে নিয়ে সমালোচনা বন্ধ করুন। অন্যের সন্তানকে নিয়ে আপনার উতলা হওয়ার দরকার নেই। সে সময়টুকু নিজের সন্তানকে দিন। ভালো কাজে ব্যয় করুন। নিজে পৃথিবীর বৈচিত্র্যকে ধারণ করুন। সন্তানকে বৈচিত্র্য উদ্‌যাপন করতে শেখান। বৈচিত্র্য যে সৌন্দর্য, সে ধারণা দেন। তাকে বলুন, পৃথিবীতে কালো, সাদা, বাদামি রঙের মানুষ থাকবে। থাকবে লম্বা, খাটো ও মাঝারি উচ্চতার মানুষ। কেউ পড়াশোনায় খুব ভালো হবে, আবার কেউ খেলাধুলায়। কারও পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো হবে, কারওটা খারাপ। যার যেটা কম থাকে, সেটা নিয়ে সে এমনিতেই চিন্তায় থাকে। তার সেই দুর্বলতায় আঘাত করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আর এভাবেই প্রতিটি শিশু হয়ে উঠবে মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন; যে কখনো অন্যকে বুলিং করবে না, কেউ বুলিংয়ের শিকার হলে তার পাশে দাঁড়াবে।