উচ্ছল তরুণী থেকে মা হয়ে ওঠার গল্প

সদ্য মা হয়েছেন মৃদুলা, কোলে সন্তান শরীফ মাহরুস মুনতাসির
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

এই যে ছবিটি দেখছেন, এটা খুবই মিষ্টি একটা ছবি। মায়াবী। সন্তানকে আদর করছেন তার মা। এর থেকে সুন্দর ছবি আর হয় না। সবাই মন্তব্য ঘরে লিখবেন—ওয়াও। দারুণ ছবি। আহা! কী সুন্দর। কিন্তু কখনো কি মনে হয়েছে, সুন্দর এই ছবিটার পেছনে আছে ১০ মাস ১০ দিনের একটা ভয়ংকর যাত্রার গল্প? হয়তো না। কারণ, সন্তান জন্মদানের পর সব ক্রেডিট গিয়ে পড়ে বাবার ওপর। সবাই তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কারণ, এখনো এই সমাজে বংশবৃদ্ধিই মূলকথা। বাবার, পরিবারের, চাচার, মামার, খালার, ফুফুর সবার বংশের বাতির জন্য একটা সন্তান চাই, বিশেষ করে ছেলে। তাতে এই সন্তান পৃথিবীতে আনার সবচেয়ে ভার বহনকারী মানুষটি মরে গেলেও কিছু যায় আসে না। সন্তান আগমনের পর আনন্দের ঝলকে সবাই ভুলেই যায় সেই গর্ভধারিণীর কথা। আজ সেই মানুষটির কথা বলব, যিনি নিভৃতে একটা লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে জীবন-মরণের সন্ধিক্ষণ থেকে সন্তানকে পৃথিবীতে নিয়ে আসেন। তিনি মা।

কতজন মায়ের সন্তান জন্মদানের এই লম্বা প্রক্রিয়ার অসহ্য যন্ত্রণাকাতর সফরের খবর নিয়েছেন? আমিও এর ব্যতিক্রম ছিলাম না। কখনো ভাবনায়ও আসেনি, এই সফর কেমন হয়। কিন্তু আমার নিজের স্ত্রীর গর্ভধারণের প্রথম দিনটি থেকে যে সফর আমরা দুজন শুরু করেছিলাম, তার অভিজ্ঞতায় পৃথিবীর সব মায়ের পায়ে আমার মাথা ঠেকাতে ইচ্ছা করে। এখনো মনে পড়ে, প্রথম যেদিন চিকিৎসকের কাছ থেকে আমাদের আনন্দের সংবাদটি পাই, শরীরজুড়ে শিহরণ বয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সামনে আমাদের জন্য যে একটা কঠিন পথ পড়ে আছে, আমরা কেউই তখন তা বুঝতে পারিনি।

কয়েক দিন যেতে না যেতেই শুরু হলো বমি। বমি তো বমি, যেন সব উগরে দেবে। এর সঙ্গে আছে ক্ষুধামান্দ্য। খেতে পারছে না। খেতে ভালো লাগে না। কিন্তু খেতে হবে। ধীরে ধীরে মানসিক ও শারীরিকভাবে তুমুল পাল্টে যেতে শুরু করল ও। তিরিক্ষি মেজাজ। দুজনে কখনো যেখানে জোরে কথা বলা হয়নি, সেখানে কথা–কাটাকাটি হয়ে যায় ঘন ঘন। একজন তরুণী ধীরে ধীরে মা হতে শুরু করছে। রোমাঞ্চকর হয়ে ওঠার বদলে যাত্রাটা আমাদের কাছে হয়ে উঠল বিষণ্ন আর বিরক্তিকর। তবু আমরা হাল ছাড়ি না। নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকি। দুজনকে বোঝার চেষ্টা করি। আমাদের অভিনন্দনের জোয়ারে ভাসিয়ে দেয় নানাজন। শুকনো ঠোঁটে ‘ওয়েলকাম’ জানাই আমরা। এর মধ্যে আমাদের দুজনের মধ্যেকার সম্পর্কের সুতাটা কখন যেন ভয়ংকর রকমের টান টান হয়ে ওঠে। একটুতেই ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম।

মা মৃদুলা ও বাবা নাসরুল্লাহর সঙ্গে ছোট্ট শরীফ মাহরুস মুনতাসির

এভাবে তিনটি মাস কেটে যায়। ১০ মাসের প্রথম অধ্যায় পেরিয়ে আমরা দ্বিতীয় অধ্যায়ে ঢুকে পড়ি। তত দিনে আমরা কিছুটা ধাতস্থ। কিছুটা পরিণত। রাস্তায় কোথায় কাঁটা আছে আর কোথায় ঘাস, তার খবর কিছুটা পাই। দ্বিতীয় অধ্যায়ের শুরুটা একটু ভালো কাটে। আমার এক বন্ধু, যাকে আমি ভাইসাব বলে ডাকি, একদিন বললেন, ‘খুব সাবধানে থাকতে হবে। (স্ত্রী) যদি গরম পানিও ঢেলে দেয়, হাসিমুখে বলতে হবে, লাভ ইউ।’ কথাটা টনিকের মতো কাজ করল। সেদিন থেকে গরম পানি ছিটালেও হাসিমুখে বলেছি, ‘লাভ ইউ।’ এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

দ্বিতীয় অধ্যায়ে শুরু হলো নির্ঘুম রাত কাটানোর পালা। ধীরে ধীরে তরুণীটি বুঝতে পারে, তার ভেতরে ক্রমেই বড় হচ্ছে আরেকটি সত্তা। সারা দিন অফিস করে এসে রাতে খাওয়ার পর শরীর আর মানে না। বিছানায় গা এলাতেই ঘুমিয়ে পড়ি। কিন্তু হঠাৎ কখনো ঘুম ভেঙে গেলে দেখি, একজন বসা। তিনি ওই তরুণী। চোখ থেকে দরদর করে পানি পড়ছে। আমারও আর ঘুম আসে না। বসে থাকি। তাঁর গায়ে, মাথায় হাত বোলাই। জিজ্ঞাসা করি, ‘কী হয়েছে?’ কোনো উত্তর আসে না। দুজন বসে থাকি। এই বেদনার উপশম হয় কিসে, খোঁজার চেষ্টা করি। কিন্তু মিথ্যেই এই খোঁজা। এর কোনো উপশম নেই। শুরু হলো আমাদের ঘুমহীন রাত কাটানো। এরই মধ্যে তাঁর ভেতরে অলৌকিক অস্তিত্ব ক্রমেই বাড়তে থাকে। এই অস্তিত্ব যত বড় হতে থাকে, তত মায়ের অস্বস্তি বাড়তে থাকে। হঠাৎ একদিন যেন নড়ে উঠল সেই অস্তিত্ব। আবারও একবার শিহরিত হলাম আমরা। কিন্তু সব শিহরণ যেন ঢাকা পড়ে যায়, রাতের যন্ত্রণাকাতর সময়গুলোতে।

তৃতীয় অধ্যায়ে এসে ক্রমেই অলৌকিক অস্তিত্ব একটা মানবপ্রাণে রূপলাভ করতে থাকে। তার সঙ্গে বাড়ে ব্যথা, যন্ত্রণা, অনিশ্চিত এক যাত্রার ক্লান্তি। রাত আর দিনের অস্বস্তির সঙ্গে বাড়ে চিকিৎসকদের নানা অনিশ্চয়তার কথা। দুশ্চিন্তা, শারীরিক অবসন্নতা, মানসিক বিষণ্নতায় আড্ডাবাজ এক তরুণী ক্রমেই হয়ে পড়ে মিইয়ে যাওয়া এক মানুষ। শেষ তিন মাসের অধ্যায়টি যেন আরও বেশি জেঁকে ধরে আমাদের। অলৌকিক অস্তিত্ব ক্রমেই একজন মানবশিশুতে রূপান্তরিত হয়। তার পা–হাতের অবয়ব আমরা টের পাই। কিন্তু তার চলন–বলন আর পা ছোড়াছুড়িতে তরুণীর প্রাণ ওষ্ঠাগত। খাওয়ার সুযোগ নেই। খেতে ইচ্ছে করে না। তবু খেতেই হবে। খেলে মনে হয়, সব গলার কাছে আটকে আছে। রাত যেন আমাদের কাছে হয়ে ওঠে কঠিন সময়। আমরা দুজনই ভোরের জন্য অপেক্ষা করি। রাত কেন ফুরায় না। রাত হলে ঘুম আসে। কিন্তু ঘুমানোর জন্য শুতে গেলে দম বন্ধ হয়ে আসে। আর বসে থাকলে ঘুমে, ক্লান্তিতে শরীর ঝিমিয়ে পড়ে। এ এক অদ্ভুত পীড়ন। ক্রমেই পেট বাড়তে থাকে। পেটের ওজন এতটাই, যেন পুরো পৃথিবী নিয়ে হাঁটতে হয় তাঁকে। একটা মানবশিশুর জন্মদানে এত ভার বইতে হয়! তরুণীর সহ্যক্ষমতার বাইরে চলে যায় পরিস্থিতি। কখনো কখনো মনে হয়, পেট কেটে বের করে ফেলি এই অলৌকিক অস্তিত্বকে। কখনো কখনো দেখেছি, মধ্য রাতে হু হু করে কাঁদছে তরুণী। তাকে কী আশ্বাস দেওয়া যায়। বলি, শুয়ে পড়ো। গুমরে কেঁদে ওঠে। বলে, নিশ্বাস নিতে পারি না। সব আটকে আসে। আমরা দুজনেই কাঁদি। উচ্চ স্বরে। বাচ্চাদের মতো।

এমন করে করে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এসে পড়ে। নিশ্চয়তা আর অনিশ্চয়তার দোলাচলে যে তরুণী একটা তেলাপোকা দেখেও ভয় পায়, সে আত্মীয়স্বজন সবাইকে ছেড়ে জলচোখে রওনা দেয় অস্ত্রোপচারকক্ষের দিকে। অনেক কাঁচি চালাচালি আর কাটাকুটির পরে হঠাৎ সেই অলৌকিক সত্তার চিৎকার শোনা যায়। বাইরে অপেক্ষমাণ বাবা, দাদা, চাচা, খালা, মামারা উচ্চ স্বরে আলহামদুলিল্লাহ পাঠ করেন। নরম তোয়ালে মোড়ানো সেই অলৌকিক মানবশিশুকে নিয়ে আসেন নার্স। সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ে। কেউ ভিডিওকলে দেখতে চায়। কেউ শিশুর ছবি তোলে। ফেসবুকে নবজাতকের ছবি আর অভিনন্দনের জোয়ার বয়ে যায়।

কিন্তু কারও মনে পড়ে না ১০ মাসের যন্ত্রণাকাতর রাস্তা পাড়ি দেওয়া সেই তরুণীর কথা। যন্ত্রণায় এখনো যে কুঁকড়ে পড়ে আছে অস্ত্রোপচার টেবিলে। আমি অপেক্ষা করি, সেই আড্ডাবাজ তরুণীর জন্য। যে সবকিছু ফেলে কেবল মা হওয়ার লড়াইয়ে মাত্র জিতে এসেছে। আমি তার চোখে তাকাই। তার জল মুছে দিই। সেই রাতের মতো আবারও দুজন কাঁদি। তার পায়ে আমার রক্তকমল বিছিয়ে দিই। আমার শির ঠেকাই। ‘মৃদু’ (মৃদুলা) তুমি মা হয়েছ। এর থেকে বড় সারপ্রাইজ আমাদের জন্য আর কী হতে পারে!