বাউল কফিলউদ্দিন সরকারের লেখা তুমুল জনপ্রিয় এই গানের প্রথম লাইন পড়ে পরের দুই লাইন গুনগুন করছেন নাকি? গানটি এতটাই মনকাড়া যে প্রথম লাইন শুনলে বা দেখলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে মনের ভেতরে গুমরে ওঠে পরের দুই লাইনে থাকা প্রিয়জনের জন্য বিরহ–যাতনা।
করোনার এই সময় অনেকের জন্যই অসহনীয় হয়ে উঠতে পারে। বিশেষ করে বন্ধুবান্ধব এবং প্রেমিক-প্রেমিকাদের জন্য তো বটেই। আগে যেখানে প্রিয়জনকে সশরীরে না দেখলে দু-এক দিনের বেশি টেকা সম্ভব ছিল না, সেখানে এখন কাটিয়ে দিতে হচ্ছে সপ্তাহের পর সপ্তাহ। অনাকাঙ্ক্ষিত এই ‘লং টাইম, নো সি’ পারস্পরিক সম্পর্কে দূরত্ব তৈরির আশঙ্কাও তৈরি করে প্রবলভাবে। আবার ঘরবন্দী অবস্থায় প্রতিনিয়ত চোখের সামনে থাকা সঙ্গীও (স্বামী–স্ত্রী) চক্ষুশূল হয়ে উঠতে পারেন। এর মূল কারণ করোনাকালের নিদারুণ বাস্তবতা।
মহামারির সময়টা এতই কঠিন যে আপনাকে রোগাক্রান্ত না করেও মানসিকভাবে দুমড়েমুচড়ে দিতে পারে। বিজ্ঞানবিষয়ক সাময়িকী ল্যানসেট-এ সম্প্রতি একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। অতীতের মহামারির প্রসঙ্গ তুলে তাতে বলা হয়েছে, কোয়ারেন্টিন ও মহামারির প্রভাব পড়ে মানুষের ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলোয়। এ সময় অর্থনৈতিক, স্বাস্থ্যগতসহ নানা ধরনের ভয় ও দুশ্চিন্তা মানুষকে ঘিরে ধরে। এর সঙ্গে নতুন রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা। এত কিছুর কুপ্রভাব দূষিত করে দেয় পারস্পরিক সম্পর্কের কোমল রূপ। অনেকে প্রেম-ভালোবাসার সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে যেতে চান। সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার চাপ অনেকে নিতে পারেন না। ফলে জুটি ভেঙে খানখান হয়ে যায়।
অবশ্য একই গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, মহামারির সময়ে মানুষ খুব বেশি আতঙ্কগ্রস্ত হয় বেশ কিছু কারণে। এর মধ্যে আছে সঠিক স্বাস্থ্যগত তথ্য না পাওয়া, প্রিয়জনদের সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগ কমে যাওয়া ইত্যাদি। অর্থাৎ, নিজেকে সুস্থ রাখার তাগিদেই প্রিয়জনদের সঙ্গে থাকা সম্পর্ক উষ্ণ রাখা প্রয়োজন। আর এর জন্য সর্বাগ্রে থাকা চাই নিয়মিত ব্যক্তিগত যোগাযোগ।
করোনাকালে সম্পর্ক যেভাবে থাকবে ঠিকঠাক
● প্রথমেই প্রেমিক-প্রেমিকা বা স্বামী-স্ত্রীর প্রথাগত সম্পর্কের ওপর বন্ধুত্বের প্রলেপ দিন। এক গবেষণায় দেখা গেছে, দাম্পত্য সম্পর্ক তখনই বেশি দিন টিকে থাকে, যখন তার মধ্যে বন্ধুত্ব থাকে। করোনার এই দিনগুলোয় প্রত্যেক মানুষের ওপরই রয়েছে নানাবিধ মানসিক চাপ। সেই চাপ একে-অপরের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিন। বন্ধু হিসেবে একে-অপরের পাশে দাঁড়ান। দেখবেন সম্পর্ক আরও গাঢ় হয়েছে।
● করোনার কারণে প্রেমিক-প্রেমিকা বা ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সঙ্গে আপনার সশরীরে দেখা বন্ধ হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু তাই বলে প্রযুক্তির এই যুগে সেই অজুহাতে কেউই আর দূরে থাকতে পারেন না। নিয়মিত ফোনে কথা বলুন প্রিয়জনদের সঙ্গে। চোখের দেখা দেখতে ভিডিও কল দিতে পারেন। এভাবে দূরে থেকেও একে-অন্যের কাছাকাছি থাকতে পারবেন।
● প্রিয়জনকে চিঠি লেখার অভ্যাস করতেই পারেন। ভাবছেন তো, কে পৌঁছে দেবে সেই চিঠি? ই-মেইল তো আছে। কাগজ-কলমের বদলে কি-বোর্ড দিয়েই লিখে ফেলুন ভার্চ্যুয়াল চিঠি। পাঠিয়ে দিন প্রিয়জনের ঠিকানায়। আর উত্তরের অপেক্ষায় থাকুন। চিঠির উত্তরের অপেক্ষাও কিন্তু মধুর।
● ইন্টারনেটভিত্তিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে অনেকেই একটু খেয়ালি থাকেন। হয়তো আপনি ব্যস্ত ছিলেন তাই প্রিয়জনের ফোন ধরতে পারলেন না, অথবা আপনার ফোনে ওয়েটিং পেলেন কেউ। অন্তত প্রিয়জনদের ব্যাপারে এসব ক্ষেত্রে সচেতন থাকুন। আপনি তাঁকে অবহেলা করছেন, এমন অনুভূতি জন্মাতে দেবেন না। ফিরতি কল দিন বা টেক্সট করুন। এতে আপনার একাকিত্ব যেমন দূর হবে, তেমনি তা আপনার প্রিয়জনের মনেও ভালো লাগার অনুভূতি তৈরি করবে।
● অন্য পক্ষের কথা মন দিয়ে শুনুন। বিচার করতে যাবেন না। তার প্রতি সহানুভূতি দেখান। মনে রাখবেন, করোনা সবার জন্যই একই ধরনের মানসিক চাপ তৈরি করেছে। তার শিকার যেমন আপনি, তেমনি আপনার প্রিয়জনও। সুতরাং কথা বলুন ও শুনুন মন খুলে। সবকিছুর জন্য কারণ খুঁজতে যাবেন না। বন্ধুর মতো সাদরে গ্রহণ করুন।
● সংগত কারণেই সবার বাড়িতেই এখন মিনি অফিস ঘাঁটি গেড়েছে। নিজের অফিসের কাজ করার সময় যে সমর্থন সঙ্গীর কাছে আশা করেন, তার ক্ষেত্রেও ওই সমর্থনটুকু দিন। বাসার গৃহস্থালি কাজ ভাগাভাগি করে নিন। সব কাজ আরেকজনের ঘাড়ে চাপিয়ে দেবেন না। দুজন যে দুজনের পাশে আছেন, সেটি দৃশ্যমান করে তুলুন।
● একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, সম্পর্ক টিকিয়ে রাখাটা যুদ্ধ নয়। সুতরাং এতে কোনো জয়-পরাজয়ের ব্যাপার নেই। ঝুট-ঝামেলা হতেই পারে। সে ক্ষেত্রে সমঝোতার পথে হাঁটুন। নেপোলিয়নের মতো যুদ্ধজয়ী সমরবিদ হওয়ার প্রয়োজন নেই আপনার। প্রিয়জনের সঙ্গে মিটমাটের পথে হাঁটুন। তার কিসে মন ভালো হয়, তা নিশ্চয়ই জানা আছে। তা একটু সারপ্রাইজ দিয়ে দিন না! প্রিয়জনের মুখে হাসি তো ফুটবে!
● সব শেষে নিজের জন্যও সময় রাখুন। আপনি নিজে মানসিকভাবে যতটা সুস্থ থাকবেন, প্রিয়জনের সঙ্গে সম্পর্ক ততটাই ভালো থাকবে। সুতরাং নিজেকে সময় দিন। মনে শান্তি পাবেন, এমন কাজ করুন। সেটা হতে পারে একটা বই পড়া বা দুই ছত্র লেখা বা ভালো কোনো সিনেমা দেখা বা যোগাসন করা।
মোদ্দা কথা, নিজের মনকে প্রশান্ত রাখুন। তাতে মনের মানুষও ভালো থাকবে।
তথ্যসূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস, বিবিসি, লস অ্যাঞ্জেলস টাইমস, জন হপকিন্স মেডিসিন, টাইমস অব ইন্ডিয়া ও মেন্টাল হেলথ ফাউন্ডেশন, ইউকে