মিট লোফ, চিকেন প্যাটিস, শিঙাড়া, সমুচাসহ নানা পদের বেকারি পণ্য পাওয়া যায় দোকানটিতে
মিট লোফ, চিকেন প্যাটিস, শিঙাড়া, সমুচাসহ নানা পদের বেকারি পণ্য পাওয়া যায় দোকানটিতে

১১২ বছর পার করে দিল ঢাকার এই বেকারি

বেকারি হয়েও কনফেকশনারি নাম ধারণ করে দিব্যি ১১২ বছর পার করে দিল ‘আনন্দ’। নাজিমুদ্দিন রোডের সাতরওজার এই দোকানকে বলা হয় ঢাকার অন্যতম প্রাচীন বেকারি। দেখতে গিয়েছিলেন মাকসুদা আজীজ

কেতাবি সংজ্ঞা মানলে আনন্দকে কোনোভাবেই কনফেকশনারি বলা যাবে না। তাদের মূল পণ্য যে বেকিং আইটেম। এখানে বেকারি ও কনফেকশনারির মৌলিক পার্থক্যটা জানা থাকলে বুঝতে মনে হয় সুবিধা হবে। বেকারির অঙ্গে অঙ্গে থাকে ময়দা–চিনির খাবার, যেগুলোকে চুল্লিতে বেক করা হয়। ওদিকে কনফেকশনারি মূলত চকলেট–ক্যান্ডি–মিঠাই–মণ্ডার দোকান। সে মোতাবেক পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডের সাতরওজার দোকানটির নাম হওয়া উচিত ছিল ‘আনন্দ বেকারি’। অথচ ‘আনন্দ কনফেকশনারি’—এই ভুল নাম নিয়েই বেকিংয়ের মিষ্টি মৌতাতে দিব্বি কাটিয়ে দিচ্ছে বছরের পর বছর। ১১২ বছর বয়সে একই তেজে এখনো চলছে এই দোকান।

পুরান ঢাকার অলিগলিতে বেকারি। হয়তো একটা তিনতলা বাড়ি, তার নিচতলাটা বেকারি। এমনও হয় যে বাড়ির পেছনে অন্দরের উঠান, তার পাশ দিয়ে একটু বেকারির জায়গা। একদম কিচ্ছু না হোক, সরু একটা করিডরের এক পাশে মটকা ফেলে চুলা বানিয়ে বাখরখানির চুল্লি বানিয়ে বসে যায় দোকান। বেকিং বোঝার জন্য পুরান ঢাকার মানুষদের নাকটাও খুব উঁচু। আর এমন এক পরিবেশে এই কনফেকশনারির টিকে যাওয়ার কারণ সম্ভবত স্বাদ। দশকের পর দশক একই স্বাদে রুটি, বিস্কুট থেকে পেটিস বা হটডগ বানিয়ে যাচ্ছে এই দোকান। যেখানে ব্রিটিশদের সূক্ষ্ম বেকিং কৌশলের সঙ্গে মিশেছে বোয়ালমারী থেকে আসা শেখ চান মিয়ার আজন্ম খাদ্যাভ্যাস। 

শতবছর ধরে খাবারের জনপ্রিয়তা রেখেছে আনন্দ কনফেকশনারি

মূল ময়রা শেখ চান মিয়ার নিজ হাতে তৈরি এখনকার কারিগর তাঁর নাতিরা। এ কারণেই হয়তো আনন্দের স্বাদে খুব বেশি বদল আসেনি। একদম যদি নিজ হাতে কাজ না–ও করেন, তিন বেলা পালাক্রমে পাহারা দেন নাতিরা। এই দলের নেতা হচ্ছেন সিদ্দিকুর রহমান। তাঁর তত্ত্বাবধানেই তৈরি হয় মিট লোফ, চিকেন প্যাটিস, সমুচা, লাড্ডু, নানান রুটি আর চানাচুর। নাজিমুদ্দিন রোডের দোকানের পেছনেই কারখানা, এক পাশে একটা অফিস রুম।

এমনিতে দোকানে বসে খাওয়ার উপায় নেই, কিনে চলে যেতে হবে। তবে আজকাল অনেককেই দোকানে দাঁড়িয়ে খেতে দেখা যায়।

বোয়ালমারীর চান মিয়া

উনিশ শতকে ফরিদপুরের বোয়ালমারী থেকে ঢাকায় এসেছিলেন শেখ চান মিয়া। পুরান ঢাকার নর্থব্রুক হলের এক ব্রিটিশ বেকারিতে শিখেছেন বেকারির কাজ। বঙ্গভঙ্গ রদের পর সেই বেকারি উঠে যায়, চলে যান ব্রিটিশ মালিকেরা। কিন্তু সেই জ্ঞানটুকু পুঁজি করে ঢাকায় বেকারির ব্যবসা শুরু করেন চান মিয়া।

উনসত্তরের গণ–অভ্যুত্থানের উত্তাল সময়ে মারা যান চান মিয়া। তাঁর ছেলে তারা মিয়া সেই ধাক্কা সামলাতে সামলাতেই চলে আসে মুক্তিযুদ্ধ। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাদের তাণ্ডবে শহর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় তাঁর পরিবার। যুদ্ধ চলাকালেই ফিরে এসে বেকারি চালুর সিদ্ধান্ত নেন তারা মিয়া (সিদ্দিকুরের বাবা)। দ্বিতীয় প্রজন্ম হিসেবে তিনি যখন ব্যবসার হাল ধরলেন, তখনো উত্তাল ছিল দেশের রাজনৈতিক অবস্থা। পাকিস্তানি আমলে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে খাবার যেত আনন্দ থেকে, স্বাধীনতার পরও টিকে ছিল এই ধারা।

পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডে আনন্দ কনফেকশনারি

১১২ বছরে প্রযুক্তিতেও অনেক বদল এসেছে। আগের মতো কয়লার চুল্লিতে আর বেকিং হয় না। বিশাল চোঙের মতো একটা গ্যাসের চুল্লি আছে। সাধারণ সময়ে এই চুল্লির জাদুকরি বোঝা না গেলেও শবে বরাতের সময় যখন নকশিকাটা কুমির, কচ্ছপ বা মাছের আকারে রুটি হয়, তখন বোঝা যায় এই চুল্লির মুনশিয়ানা। তবে আনন্দের হালুয়াটা আজও হাতেই হয়, পাওয়া যায় সেই শবে বরাতের সময়। ময়ানও এখন বিশাল মিশ্রণযন্ত্রে হয়।

১১২ বছরেও আনন্দ নিজেদের খুব বেশি বিস্তার করেনি। নাজিমুদ্দিন রোড়ের মূল শাখার বাইরে ১৯৯০ সালে কুর্মিটোলায় একটা শাখা, ব্যস এতটুকুই। এর পেছনে আছে খুব বেদনাদায়ক এক গল্প। সিদ্দিকুরের ছোট ভাই ছিলেন আবদুল ওয়াজেদ। নতুন যুগের আনন্দের যেটুকু বিস্তার, সবটাই তাঁর হাত ধরে। কিন্তু ২০০০ সালে হঠাৎ হৃদ্‌যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান ওয়াজেদ। সে ধাক্কা কোনো দিন সামলে উঠতে পারেনি আনন্দ পরিবার। মানুষের ভালোবাসা নিয়ে যতটুকু টিকে আছে, ততটুকু নিয়ে আপাতত সন্তুষ্ট ‘আনন্দ’।