চলার পথটাই যেন রানওয়ে। দুই পাশে দাঁড়িয়ে আছে নানা আকৃতির সারি সারি উড়োজাহাজ। মেট্রোরেলে যখন আগারগাঁও পার হন, একবার হলেও নিশ্চয়ই বিমানবাহিনী জাদুঘরের মাঠে সাজিয়ে রাখা এই উড়োজাহাজগুলোর দিকে চোখ পড়েছে।
বিমানবাহিনীর এই জাদুঘর দেখতেই ২৭ ফেব্রুয়ারি বিকেলে মেট্রোরেলে করে চলে গেলাম আগারগাঁও। টিকিটের মূল্য ৫০ টাকা। সাজিয়ে রাখা উড়োজাহাজগুলোর মধ্যখান দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে যুদ্ধবিমানগুলো দেখছিলাম। শিশুদের জন্য ছিমছাম একটা পার্কও এখানে আছে।
যেতেই বিশাল একটা উড়োজাহাজে চোখ আটকে গেল। মূল পার্ক থেকে একটু দূরেই এই উড়োজাহাজটির অবস্থান। উড়োজাহাজটাকে ঘিরে দেখি, মানুষের বেশ ভিড়, ভেতরে প্রবেশমূল্য ১০০ টাকা। যিনি টিকিট দিচ্ছেন, তাঁর কাছে ভেতরে কী আছে—জানতে চাইলে অবাক করে দিয়ে বললেন, ‘উড়োজাহাজের ভেতর ক্যাফে আছে। জায়গাটা ছোট তো, তাই টিকিটের ব্যবস্থা।’
উড়োজাহাজের ভেতর রেস্তোরাঁ! ঢুকতেই ১০০ টাকা! নিশ্চয়ই দেখার মতো কিছু হবে। সাতপাঁচ না ভেবে টিকিট কেটে চলে গেলাম বিমানটির একদম কাছে। ঝকঝকে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলাম ওপরে। গিয়েই তো চক্ষু ছানাবড়া। এত সুন্দর ছিমছাম, দেখে মনে হচ্ছিল যেন উড়োজাহাজের বিজনেস ক্লাসে এসে পড়েছি। রেস্তোরাঁটির নাম হারকিউলিস ক্যাফে। উড়োজাহাজটির সত্যিকার নাম থেকেই এই নাম। মাত্র তিন বছর আগেও আকাশে উড়ে বেড়াত হারকিউলিস।
২০০১ সালে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে যুক্ত হওয়া ছাই রঙের এই উড়োজাহাজটির ইতিহাস যেন নামের চরিত্রটির সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। শক্তিশালী, আদর্শবাদী এবং পরোপকারী গ্রিক বীর হারকিউলিসের সব বৈশিষ্ট্যই যেন উড়োজাহাজটির রয়েছে। বিভিন্ন দুর্যোগে ত্রাণ বয়ে নিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে নানান মানবিক মিশনেও উড়োজাহাজটিকে কাজে লাগানো হয়েছে। ২০১৫ সালে নেপালের ভূমিকম্পে বাংলাদেশের সাহায্য নিয়ে গিয়েছিল হারকিউলিকস। ২০২১ সালে শেষ হয় হারকিউলিকসের ২০ বছরের দীর্ঘ কর্মজীবন।
ককপিট বাদে উড়োজাহাজজুড়েই বসার জায়গা। সবকিছুই বেশ সাজানো-গোছানো। সেখানে বসে মজাদার নাশতার সঙ্গে খাওয়া যাবে চা-কফি, আইসক্রিম, নানা রকমের জুস। নাশতা করতে করতে ককপিটে চোখ পড়লে আকাশে উড়ে যাওয়ার কল্পনাতেও ডুবে যেতে পারবেন। রিসেপশনের পেছনের দেয়ালে বেগুনি রঙের ঝলমলে বাতিতে লেখা, ‘হারকিউলিস ক্যাফে’। সত্যিকার উড়োজাহাজের মতোই বদ্ধ জায়গা। কোনো খোলা জানালা নেই, তারপরও ভেতরকার আবহ বেশ আরামদায়ক। উড়োজাহাজের ছোট্ট গোলাকার জানালা দিয়ে বাইরেটা দেখতে হলে একটু যেন কষ্টই করতে হবে।
রিসেপশনে সাজিয়ে রাখা হয়েছে বেশ কয়েক ধরনের নাশতা। রয়েছে খাবারের মেনু। অতিথিরা সেখান থেকে বেছে নিতে পারবেন পছন্দের খাবার। রেস্তোরাঁর ম্যানেজার সাজ্জাদ বলছিলেন, ‘ককপিট, ইঞ্জিন—সবকিছুই আছে। কিন্তু যেহেতু এটি আর উড়বে না সেহেতু মানুষকে আনন্দ দিতেই উড়োজাহাজর ভেতর এই রেস্তোরাঁর আয়োজন।’
খাবার তৈরি এবং পরিবেশনের জন্য রেস্তোরাঁয় কাজ করছেন সাত-আটজন কর্মী। খাবারগুলো কি উড়োজাহাজের ভেতরেই তৈরি হয়? জানতে চাইলে সাজ্জাদ বলেন, ‘যেহেতু বদ্ধ জায়গা, তাই উড়োজাহাজের ভেতর রান্নার ব্যবস্থা নেই। বাইরে পাশেই রান্নাঘর আছে, সেখান থেকে খাবার আনানো হয়।’
রেস্তোরাঁ ঘুরে দেখতে দেখতে ককপিটের দিকে গেলাম। দেখি ছোট্ট একটা শিশু তার বাবার সঙ্গে উড়োজাহাজ চালানোর চেষ্টা করছে। আর পেছন থেকে ছবি তুলছে মা। শিশুটির চোখেমুখে তীব্র উত্তেজনা। মন ভালো করা একটা দৃশ্য। কে বলতে পারে, আজকের এই ছোট্ট শিশুটির উড়োজাহাজও হয়তো সত্যিই একদিন উড়ে যাবে দূর আকাশে।