বিশ্বে আছে চা–বিষয়ক নানা রীতি
বিশ্বে আছে চা–বিষয়ক নানা রীতি

চা নিয়ে চাট্টি কথা

জেন–জি আর মিলেনিয়ালরা যতই কফিতে মজুক, বাঙালির চা–প্রেম ফিকে হওয়ার নয়। চায়ের কাপ ছাড়া ঝড় ওঠানোর অবকাশ আর কোথায়? আমার তো মনে হয়, পুরো বিশ্বেই আদৃত এক পানীয় চা। এই চা খেতে হয় তরিবত করে। আছে চা পানের নানা সহবত। দেশে দেশে সেসব রীতিনীতি আবার আলাদা। চা পানের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি আর রীতি নিয়ে নাহয় দু–চার কথা বলাই যায়।

চীন

চায়ের জন্মভূমি চীন। বিশাল এক দেশ। আবহাওয়ার তারতম্যের কারণে চায়ের ধরনেও বৈচিত্র্য থাকবে। চীনে কত ধরনের যে চা আছে, তার ইয়ত্তা নেই। আর আছে চা–বিষয়ক নানা রীতি। এর মধ্যে বিশেষ পরিচিত হলো ‘চা দাও’। এটা ‘টাও’ বা ‘দাও’ মতবাদীদের তৈরি এক রীতি। একে শিল্পই বলতে হবে, যেখানে আছে সম্প্রীতি, পূর্ণতা আর উপভোগের সম্মিলিত ভারসাম্য।

চীনে কত ধরনের যে চা আছে, তার ইয়ত্তা নেই

এবার একটা সহবতের কথা বলা যাক। ধরা যাক, চীনে আপনি কোনো মিটিংয়ে গেছেন কিংবা অতিথি হিসেবে গেছেন কোথাও; কোনো এক ফাঁকে চা আসবেই। কিন্তু সেই চায়ে ভুলেও চুমুক দেওয়া যাবে না, যতক্ষণ না সেখানে উপস্থিত বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিটি কাপে ঠোঁট ছোঁয়াচ্ছেন।

জাপান

জাপানি সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো চা। চা উৎসব তো সেখানে দীর্ঘদিনের প্রথা। জাপানিদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উপলক্ষও চা। তাই আকছারই আয়োজিত হয় চা উৎসব। আবার অতিথিকে স্বাগত জানাতেও তারা চা দেয়। জাপানে চায়ের কাপ ধরার একটা রীতি আছে। বিশেষ করে কোনো অনুষ্ঠানে বা চা-কেন্দ্রিক আয়োজনে কাপ দুই হাত দিয়ে ধরতে হয়। এই চা খাওয়ার সময় আওয়াজ করে ফুঁ দিয়ে খাওয়াটাই নিয়ম। কারণ, তাতে কেবল চা ঠান্ডা হয় না, স্বাদও নাকি বাড়ে। তাদের প্রিয় হলো ‘মাচা চা’।

মাচা চা

যুক্তরাজ্য

বিশ্বব্যাপী চা জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে ব্রিটিশদের অবদানকে খাটো করে দেখা চলে না। এই উপমহাদেশে তারাই চায়ের বিস্তার ঘটিয়েছে। ইউরোপের মধ্যে কেবল ব্রিটিশরাই সবচেয়ে বেশি চা পান করে। আর উৎপাদনে তারা দ্বিতীয়। ক্রিকেট, ফিশ অ্যান্ড চিপস আর রাজপরিবারের মতো ব্রিটিশদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ চা। যুক্তরাজ্যে এখনো প্রতিদিন ১৬ কোটি কাপ চা পান করা হয়ে থাকে।

ব্রিটিশরা প্রথাগতভাবে দুধ আর চিনিসহযোগে চা পরিবেশন করে

ব্রিটিশরা প্রথাগতভাবে দুধ আর চিনিসহযোগে চা পরিবেশন করে, সঙ্গে বিস্কুট আর কেকও থাকে। সেখানে বিকেলের চা–ও কিন্তু বেশ জনপ্রিয় ঐতিহ্য। তখন আবার বদলে যায় অনুষঙ্গ। বিস্কুট আর কেকের জায়গা নেয় স্কোন, স্যান্ডউইচ বা অন্য কোনো স্ন্যাকস। তবে চা পরিবেশন করতে গিয়ে চিনি দিয়ে নাড়ার সময় টি-পটে কোনো শব্দ করা চলবে না। এটাই সহবত। ব্রিটিশদের কাছে চা আসলে একটু আয়েশ করার সময় কিংবা বিশ্রামেরও। এ জন্যই ‘টি টাইম’ কথাটার উৎপত্তি।

ভারতীয় উপমহাদেশ

আমাদের এই উপমহাদেশে অনানুষ্ঠানিক জাতীয় পানীয়ে পরিণত হয়েছে চা। বাঙালির চা পানের কোনো উপলক্ষ লাগে না। বাঙালি রাস্তায়ও চা খায়, আবার হালের লাউঞ্জেও চলে চা। গরম পড়লেও চা, শীত–বৃষ্টিতেও চা। আড্ডার দোসর এই চা। শোকেও চা, উৎসবেও চা; প্রেমেও চা, বিরহেও চা। অতিথি আপ্যায়নেও আমাদের সবচেয়ে জনপ্রিয় পানীয় চা। একটা সময় মনে করা হতো, লাল চা খায় গরিব মানুষ। আর বড়লোকের চা মানে তাতে জমিয়ে দুধ, মালাই ইত্যাদি দেওয়া। আর এখন তো চায়ের কত বৈচিত্র্যই না উদ্ভাবন করেছে বাঙালি। এই দুধ চায়েরই কত ধরন। সম্প্রতি বেশ জনপ্রিয় হয়েছে ‘তন্দুরি চা’। এখন তো নানা মসলাও যোগ করা হচ্ছে। কাঁচা মরিচ দেওয়া তেঁতুল চা, মাল্টা চা, ওভালটিন চা, গাজর চা, নানা ধরনের মসলা চা। আর আদা চা তো আছেই। গ্রিন টিও হালে স্বাস্থ্যসচেতন বাঙালির হৃদয় জয় করেছে।

বাঙালির চা পানের কোনো উপলক্ষ লাগে না

মরক্কো

মরক্কোর পুদিনা চা আবার বেশ জনপ্রিয়। তারা বলে টুয়ারেগ। এতে চিনি দেওয়া হয় যথেষ্ট। অতিথি আপ্যায়নের পূর্বশর্তই এই চা। লম্বা কাচের গ্লাসে পরিবেশন করা হয়। আর দেওয়া হয় তিনবার। তারা বলে, প্রথমবার হলো জীবনের মতো মধুর, দ্বিতীয়বার প্রেমের মতো শক্তিশালী আর তৃতীয়বার মৃত্যুর মতো তিক্ত।

তুরস্কে কাচের ছোট গ্লাসে পরিবেশন করা হয়

তুরস্ক

তুর্কিরাও চা–সংস্কৃতিতে পিছিয়ে নেই। ছোট যে পাত্রে চা তৈরি করা হয়, তার নাম ‘চায়দানলিক’। আর কাচের ছোট গ্লাসে পরিবেশন করা হয়, সেটার নাম ‘ইনচে বেলে’। তারা মূলত লাল চা খায়। এক গ্লাস পানি ও ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি টার্কিশ ডিলাইটের সঙ্গে পরিবেশন করা হয় এই চা। একটু উঁচু থেকে চা ঢালা সেখানে একটা রীতি।

বিশ্বের দেশে দেশে চায়ের রয়েছে এ রকম নানা সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও রীতি।

তথ্যসূত্র: হামিংবার্ড টি রুম, নিউওরলিনস টি কোম্পানি, টুইনিংস, ক্যামেলিওস, কন্ডে নাস্ট ট্রাভেলার ইন্ডিয়া, ইউরোনিউজ, টেবিলরুম, দ্য টি কিচেন