পরিবেশের যতটা সম্ভব কম ক্ষতি করে বানানো হয়েছে ‘যাত্রা বিরতি’। প্রচলিত আধুনিক ক্যাফের যে চাকচিক্য, রেস্তোরাঁটিতে সেটা নেই। তার বদলে পাবেন বাঁশ–কাঠের এক রেস্তোরাঁ। অনেকটা গ্রামের বাড়ির দাওয়া বা চিলেকোঠার আবহে সেজেছে বনানীর এই রেস্তোরাঁ। ঘুরে এসে জানাচ্ছেন বিপাশা রায়
কেনাকাটা করতে করতে হাঁপিয়ে উঠলে একটু তো জিরোতে মন চায়। এ সময় যদি হাতের কাছেই মিলে যায় দুদণ্ড বিরতির স্থান, তাহলে কী শান্তি! আর এমন ভাবনা থেকেই ফ্যাশন হাউস ‘যাত্রা’ তাদের বুটিক শপের খোলা ছাদে গড়ে তুলেছে ‘যাত্রা বিরতি’।
‘যাত্রা বিরতি’কে শুধু খাবারের দোকান বললে একটু ভুল হবে। যাত্রা বিরতিতে নিয়মিত যাঁরা খেতে যান, তাঁরা জানেন, এ জায়গার সঙ্গে শুধু পেট নয়, আত্মারও সর্ম্পক আছে। আর তাই যাঁরা নিয়মিত যাত্রা বিরতিতে যান, তাঁরাই অনুভব করতে পারেন, এ জায়গায় একটা মায়ার টান আছে।
যাত্রা বিরতিতে বসেই যাত্রা বাংলাদেশ লিমিটেডের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা ইনতেনান মোহাম্মদ জাকির সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি জানান, কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউয়ে যখন যাত্রার কার্যক্রম শুরু হয়, তখন সেই ভবনের ছাদটা ফাঁকা ছিল। যাত্রার পক্ষ থেকে বছরে দুই থেকে তিনটি অনুষ্ঠান সেখানে হতো।
কখনো দর্শনীর বিনিময়ে, কখনো বিনা মূল্যে এসব অনুষ্ঠান উপভোগ করতেন দর্শক। সে সময় যাত্রার কর্ণধার আনুশেহ আনাদিলের মনে হলো, শপিং করতে করতে মানুষ যখন ক্লান্ত হয়ে পড়েন, তখন তাঁর একটু বিরতির প্রয়োজন হয়। সেই ভাবনা থেকেই যাত্রার পুরোনো ভবনের ছাদে যাত্রা শুরু করে অর্গানিক নিরামিষ খাবারের রেস্তোরাঁ ‘যাত্রা বিরতি’।
যাত্রা এখন আর আগের ভবনে নেই। বনানীর আরেকটি পুরোনো বাড়িতে নতুন করে যাত্রা শুরু করেছে তারা। এখানেও অনেকটা পুরোনো রেস্তোরাঁর আদলেই গড়া হয়েছে নতুন যাত্রা বিরতি। একটা পার্থক্য অবশ্য আছে, বড় একটা ছাদজুড়ে ছিল পুরোনো যাত্রা বিরতি। আর নতুন যাত্রা বিরতি ছাদ ছাড়াও আরেকটি তলা নিয়ে গড়ে উঠেছে।
এই তলাতেই মেঝেতে বসে খাবারের আয়োজন। বাঁশ কেটে এই বসার আয়োজন করা হয়েছে। রেস্তোরাঁর মাঝবরাবর ফাঁকা রেখে চারপাশজুড়ে দেওয়া হয়েছে শণের ছাউনি। আমাদের দেশের আবহাওয়া বেশির ভাগ সময় যেহেতু গরম থাকে, তাই বসার জায়গার ওপরে এই ছাউনির ব্যবহার। খড়ের ছাউনি তাপ শোষণ করে।
একইভাবে মেঝেতে রং করার আগে প্রকৃতিবান্ধব রঙের প্রলেপ দেওয়া হয়েছে, যাতে মেঝের তাপ শোষণের ক্ষমতা বাড়ে। আর চারপাশজুড়ে আছে প্রচুর গাছগাছালি। যাত্রা বিরতির প্রতিটি কোণেই আছে পরিবেশবান্ধব জিনিসের ব্যবহার।
ইনতেনান বলছিলেন, যাত্রা বিরতি তৈরির পরিকল্পনা যখন চলছিল, তখন বিভিন্ন স্থাপত্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাঁরা বসেন। তাঁদের কনসেপ্ট নিয়ে কথা বলেন। তখন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাঁদের মনের মতো নকশা করে দিলেও যেসব উপকরণের ব্যবহার করতে বলে, তার সবই দেশের বাইরের তৈরি ছিল।
যাত্রা কর্তৃপক্ষ চেয়েছিল, তাদের শোরুমের মতো খাবারের জায়গাতেও থাকবে দেশীয় জিনিসের ব্যবহার। আরও দুটি বিষয়কে প্রাধান্য দেয় যাত্রা। তা হলো রিসাইকেল ও পরিবেশবান্ধব উপকরণ। সেই ভাবনা থেকে স্থাপত্য প্রতিষ্ঠানের নকশা ঠিক রেখে যাত্রা কর্তৃপক্ষ দেশীয় উপকরণ খোঁজা শুরু করে।
কাজটা একটু কঠিনই ছিল। বিদেশি স্থাপত্য উপকরণের জায়গায় ব্যবহার করা হলো খড়, বাঁশ, বাঁশের চিক, গামছার মতো উপকরণ। রেস্তোরাঁর কিছু জায়গায় যাত্রার পুরোনো জিনিসপত্রও পুনর্ব্যবহার করা হয়েছে।
যেমন পুরোনো যাত্রার কিছু ব্যবহৃত কাচ ছিল, যা যাত্রা বিরতিতে প্রয়োজনমতো কেটে পুনর্ব্যবহার করা হয়েছে। আছে পুরোনো ভাঙা প্লাস্টিকের ঝুড়ি।
সবজি কুড়ানোর উপকরণ দিয়ে তৈরি হয়েছে ল্যাম্পশেড। এমনভাবে পুরোনো অনেক জিনিসেরই ব্যবহার হয়েছে।
রিসাইকেল, দেশীয় উপকরণের পাশাপাশি এই রেস্তোরাঁয় দেশীয় ঐতিহ্যেরও দেখা মিলবে। যেমন দ্বিতল ছাদের বসার স্থানে সিলিংজুড়ে আছে গামছার ঝালর।
তিব্বতি ঐতিহ্য আর গ্রামবাংলার বিয়ের ঐতিহ্য থেকে এসেছে গামছার এমন ব্যবহারের ভাবনা। ঘরের আদলের বসার স্থানের চারদিকে দেয়াল না রেখে বাঁশের চিক ব্যবহার করা হয়েছে। মেঝেতে আঁকা আছে আলপনা।
দেশীয় ঐতিহ্যগুলো যখন মানুষের চোখের সামনে এভাবে ধরা দেবে, তখন স্বাভাবিকভাবেই মানুষের কাছে এর গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে, মনে করে যাত্রা কর্তৃপক্ষ।
দিনের আলো এখানে যেমন মনের প্রশান্তি আনে, তেমনি রাতে ল্যাম্পশেডের আঁধারি আলো সৃষ্টি করে মায়াবী এক আবহ। আলোর বিষয়টি যাতে বেশি আরোপিত মনে না হয়, সে জন্য যাত্রার সব জায়গায় এমন আলোকসজ্জা।
শুধু আলোকসজ্জাতেই নয়, যাত্রা বিরতির কোনো জায়গাতেই অতিরিক্ত আরোপিত কিছু দেখতে পাওয়া যায় না। কারণ, যাত্রা সব সময় মিনিমালিস্টিক জীবনযাপনে বিশ্বাস করে, যার প্রভাব যাত্রা বিরতিতেও দেখা যায়। তাই আলাদা কোনো আসবাব রেস্তোরাঁটিতে চোখে পড়বে না।
এখানে মেঝেতে বসেই খাবার খেতে হয়। তবে বাইরে বড় দুটি টেবিল–বেঞ্চও আছে। আয়ুর্বেদশাস্ত্র অনুযায়ী মেঝেতে বসে খাবার গ্রহণ শরীরের জন্য উপাদেয়। সে জন্য মেঝেতে খাবারের আয়োজন রাখা হয়েছে।
যাত্রা বিরতিতে পরিবেশিত হয় ভেজ আইটেম বা নিরামিষ খাবার। স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, এমন কোনো পদ এখানে রাখা হয় না। তাদের তালিকা থেকে অর্ডার করার পর চোখের সামনেই তৈরি করে দেওয়া হয় সেই খাবার। বাড়িতে যেমন ঘরের মানুষের রান্না আপনি নিশ্চিন্ত মনে খেয়ে থাকেন, এখানেও খাবারের সেই নিশ্চয়তা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়।
নতুন যাত্রার নিচতলায়ও এখন রেস্তোরাঁর আয়োজন রাখা হয়েছে। খাওয়ার জায়গার পাশে বড় খোলা উঠান থাকবে, এমন ভাবনা তাদের অনেক দিন ধরেই ছিল। সেই স্বপ্ন এবার বাস্তবে রূপ নিয়েছে। এই জায়গায় বাঁশের মোড়া আর টেবিল পেতে খাওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
নিচতলার রেস্তোরাঁ অংশ কাচে ঘিরে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত করে রাখা হয়েছে। অনেক ক্রেতা আসেন, যাঁরা ওপরে উঠতে পারেন না, আর ভবনটিতে যেহেতু লিফট নেই, তাই নিচের এই আয়োজন। এখানে একটা টানা খোলা জায়গা রাখা আছে, যেখানে মোড়া পেতে বসে খাওয়া যায়, আবার অনুষ্ঠান হলেও উপভোগ করা যায়।
তবে যাত্রা বিরতির ভিড়টা খোলা ছাদেই জমে বেশি। মজার ব্যাপার হলো যাত্রা বিরতির ছাদে খুব গরম বোধ হয় না, আর ঠান্ডা–বৃষ্টির দিন হলে তো কথাই নেই, রেস্তোরাঁর রূপ হয়ে ওঠে আরও মোহনীয়।
প্রকৃতির সঙ্গে খাবারের জায়গার এমন মেলবন্ধন এ শহরে আর কটি মেলে বলুন!
(লেখাটি বর্ণিল বসত নভেম্বর ২০২৪–সংখ্যায় প্রকাশিত)