কে এই ইন্দুবালা?

দুই বাংলাতেই সাড়া জাগিয়েছে ইন্দুবালা ভাতের হোটেল। আমাদের অনুরোধে সাড়া দিয়ে উপন্যাসটির লেখক কল্লোল লাহিড়ীর সঙ্গে একদিন আড্ডায় বসেছিলেন কলকাতার সাময়িকী সানন্দার সাবেক সম্পাদক ও ফুড ফরিস্তা চ্যানেলের স্বত্বাধিকারী শর্মিলা বসু ঠাকুর। গল্পচ্ছলে জানলেন বইটিতে উল্লেখ করা খাবারগুলোর পেছনের নানা তথ্য।

ইন্দুবালা ভাতের হোটেল উপন্যাস
ইন্দুবালা ভাতের হোটেল উপন্যাস

খুলনার কলাপোতা গ্রামের মেয়ে ইন্দু। কলকাতায় এক দোজবরে মাতালের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। তিন সন্তান নিয়ে অল্পকালেই বিধবা হন। তারপর দেশভাগ, ইন্দুবালার পথচলা, ইন্দুবালা ভাতের হোটেলের সূচনা। কল্লোল লাহিড়ীর ইন্দুবালা ভাতের হোটেল উপন্যাসটি যখন আমার হাতে আসে, একনাগাড়ে পড়ে শেষ করি। লেখার সাবলীলতা তো আছেই, সেই সঙ্গে এই উপন্যাসে আছে এমন এক আখ্যান, যা সর্বজনীন। ইন্দুবালা দেশ-কাল-সময় অতিক্রান্ত এক চরিত্র, যার সঙ্গে আমরা সবাই কিছু না কিছু মিল খুঁজে পাই। যে আমাদের ঐতিহ্যের কথা বলে, সংস্কারের কথা বলে, অতীতকে সম্মান করতে শেখায়। এই মূল্যবোধের ধারণা নতুন প্রজন্মের কাছেও তো জরুরি। এই একাত্মতাই আমার মনে হয় ইন্দুবালার ভাতের হোটেলের সাফল্যের মন্ত্র। লেখক তাঁর অনায়াস ভঙ্গিতে তুলে ধরেছেন আমাদের রান্নাঘরের ইতিহাস। তাই এই উপন্যাসে মূল চরিত্র ইন্দুবালা যতখানি গুরুত্বপূর্ণ, ততটাই গুরুত্বপূর্ণ তাঁর রান্না। রান্নাকে ঘিরে একটা সময়, সংস্কার, ইতিহাস, সম্পর্ক, মনস্তত্ত্বের নিখুঁত চালচিত্র গড়েছেন কল্লোল লাহিড়ী।

শর্মিলা বসু ঠাকুর আলাপচারিতায় লেখক কল্লোল লাহিড়ীর সঙ্গে

ছেলেবেলা

ইন্দুবালা ভাতের হোটেল বইয়ের কথা বলতে গিয়ে নিজের ছেলেবেলায় চলে যান লেখক কল্লোল লাহিড়ী। ‘আমি উদ্বাস্তু পরিবারের ছেলে। আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা এখানেই, এই বাংলায়, বালিতে। গঙ্গার পাড়ে যৌথ পরিবারে। ছেলেবেলায় দেখেছি, মা, ঠাকুরমা, পিসিদের অনেকটা সময় কাটত রান্নাঘরে। রান্নার গল্প, তাঁদের জীবনের গল্প আবার উমনো-ঝুমনোর পিঠা খাওয়ার গল্প সবই গোগ্রাসে গিলতাম, রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে। দেশভাগের পর আমার পূর্বপুরুষদের এই বাংলায় চলে আসতে হলেও ফেলে আসা যাপনের সোনালি স্মৃতি আঁকড়েই এই মানুষগুলোকে বাঁচতে দেখেছি। আমার ঠাকুরমা, কাকা, পিসি, মণি, দিদা, রাঙা, বড়মা, মা, আমার চারপাশের মানুষদের দেখতাম, বর্তমানে থেকেও অতীতে ফিরে যেতেন বারবার। রান্না করতে গিয়ে দেশের পুকুরপাড়ের কাঁচামিঠে আমের স্বাদের তুলনা করতেন, এখানকার লাউশাক, কচু কোনোটাই তাঁদের মনমতো হতো না। আমার শিশুমনের কাছে তাঁদের বর্ণিত গ্রাম, পুকুর, ঘাট সবই অচেনা, অজানা। তবু একটা ছবি ভেসে উঠত আমার মনে। সে ছবি ছিল তৃপ্তির, আরামের, সন্তুষ্টির। অতীতের ভালো থাকার গল্প। একটু বড় হওয়ার পর বুঝতে শিখলাম, এই ছবি আঁকার রঙে মিশে আছে অনেক কান্না, হতাশা, মন খারাপ। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলাম, আমার চারপাশের মানুষগুলো, যাঁদের মাঝে আমি বড় হয়েছি, তাঁরা একটা কষ্টের মধ্যে আছেন। ছিন্নমূল হয়ে বেঁচে থাকার কষ্ট। তাঁদের অস্তিত্বের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জড়িয়ে আছে সেই মাটি, জল, আকাশ, বাতাস, এককথায় তাঁদের শিকড়ের আলিঙ্গন, যা ছেড়ে তাঁদের চলে আসতে হয়েছে, যার অনুপস্থিতি নিয়ত অনুভব করেন তাঁরা। তার মানে এই নয় যে সারাক্ষণ তাঁরা কাঁদুনি গাইতেন। কিন্তু তাঁদের কাজে, ভাবনায় অজান্তেই একটা আক্ষেপের সুর প্রকাশ পেত।

আমার কাকা দারুণ ভালো চপ বানাতে পারতেন। শিখেছিলেন তাঁর মায়ের কাছে। কাজ করতেন চিরুনি কারখানায়, যেটা তাঁর পেশাই হতে পারে না। বিকেলবেলা একটা চায়ের দোকানে চপ বানাতেন। বিকেলে চা খেতে বসলেই আমার আজও সেই কথা মনে পড়ে। নোয়া মুন্ডির কাকিমা অসাধারণ কচুবাটা করতেন। আমার মা ঘটি। বসিরহাটে বড় হয়েছেন। বসিরহাট কলেজে পড়াশোনা করেছেন। এ কারণে ঘটি ঘরানাও মিশেছে আমাদের হেঁশেলে। নবদ্বীপ, নোয়া মুন্ডি, উত্তর চব্বিশ পরগনা, মুর্শিদাবাদ নানা দেশের নানা স্বাদ এসে মিশেছে আমাদের রান্নাঘরে। মায়ের পিসি, আমার মাঝের হাটের দিদার বিয়ে হয় বাঙাল বাড়িতে। এই দিদার বাড়ি যাওয়া মানেই আমাদের সকালের জলখাবারে থাকত চিংড়ির হলুদ গালা ঝোল আর ভাত। একটা অন্য রকম সকাল। আমাদের রুটিনের বাইরে। ছেলেবেলায় যা রুটিনের বাইরে, তাতেই তো মজা। আবার আমার মায়ের ঠাকুরমা খেজুরপাতার জিরানো আঁচে কুমড়ো ফুলের মিঠা বড়া, পাটিসাপটা বানাতেন। আমার স্মৃতিজুড়ে এমন নানা মানুষ, অঞ্চল, দেশ এবং একটা মস্ত সময়। সেই বেড়ে ওঠাই আমার লেখার রসদ।’

বইয়ের রেসিপি অনুসরণ করে রান্না করেছিলেন শর্মিলা বসু ঠাকুর

ইন্দুবালা কে?

লিখতে বসলেই একটা চরিত্রকে ভাবতে হয়। লেখকের মাথায় ঘুরছিল এমন একটা চরিত্র, যে অনেকগুলো সময়ের মধ্যে দিয়ে বাঁচছেন। আর তাঁর জীবনের সিংহভাগজুড়ে রান্নাঘর। এই রান্নাঘর আঁকড়েই তাঁর বেঁচে থাকা। এটা ভাবতে গিয়ে কল্লোল লাহিড়ীর মনে হলো এই উপন্যাসের মূল উপকরণ হতে পারে খাবার। আমরা যখন খেতে বসি, তখন তো শুধুই খাই না, কোথায় খাচ্ছি, কোন পরিবেশে খাচ্ছি, কী খাচ্ছি, কার হাতের রান্না খাচ্ছি, কোন বয়সে খাচ্ছি, এমন হাজারো উপাদান জুড়ে যাচ্ছে আমাদের খাওয়ার সঙ্গে, রান্নার সঙ্গে। তৈরি হচ্ছে বিশাল ক্যানভাস, যেখানে ইতিহাস, ভূগোল, সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি জুড়ে জুড়ে যাচ্ছে। ইন্দুবালা এই হাজারো উপকরণকে ধরে রাখে তাঁর রান্নার মাধ্যমে। নোঙরের মতো। ইন্দুবালা তাই কোনো একজন বিশেষ মানুষ নয়, আবার অবশ্যই একজন কেউ।

মানকচুবাটা

রান্নাবান্না ও খাওয়াদাওয়া

বইটি নিয়ে গল্প করার সময় লেখক জানালেন, আমি একদম রাঁধতে পারি না। আমি আর আমার দাদা—আমরা দুই ভাই। একবার মায়ের অসুস্থতার সময়ে আমাদের রান্নাঘর সামাল দিতে হয়েছিল। সেটাই আমার ট্রেনিং পিরিয়ড বলা যেতে পারে। ভাত, ডাল, ডিমের ঝোল, মাছের ঝোল, চা—এসব করতে পারি। তার বেশি কিছু না। কিন্তু আমি রান্নার গল্প শুনতে, রান্নার ইতিহাস জানতে, নানা ধরনের খাবার চেখে দেখতে খুব ভালোবাসি। আর ভালোবাসি বাজার করতে। আসলে একজন মানুষের জীবনে তার ছেলেবেলার প্রভাব খুব গভীর। আমাদের বাড়ির কাছেই ছিল জেলেপাড়া। যাতায়াতের পথে বাড়ির দাওয়ায় বসে জেলেদের জাল বোনা দেখে বুঝতে পারতাম কখন ইলিশ ধরার সময়, কখন চিংড়ি। ভরা বর্ষায় গঙ্গার জল ফুলেফেঁপে উঠলে মা বলতেন যা তো কচু তুলে আন। কচুগাছের গোড়ায় ডেঁয়ো পিঁপড়ে মানেই কচুর রস খাবার লোভে তারা জড়ো হয়েছে। আমার জীবনে এসব ছোট ছোট ঘটনা, স্মৃতি অনেকটা জায়গা করে নিয়েছে, তৈরি করেছে এক সম্পন্ন বাতাবরণ। আমি কম খাই, কিন্তু খেতে ভালোবাসি। চিংড়ির হলুদগালা ঝোল আর গরম ভাত আমার খুব প্রিয়। আর ভালোবাসি পায়েস। গুড়, চিনি কোনো বাছবিচার নেই।