যাঁরা জানেন তাঁরা আমার সঙ্গে বিতর্ক করবেন বটে। বলবেন, রাজশাহী কিংবা চাঁপাইনবাবগঞ্জে তো সারা বছরই খাওয়া হয় কলাইয়ের রুটি। সেটা অস্বীকার করি না। গ্রীষ্ম-বসন্ত কিংবা অনন্ত ছাড়াই বর্ষা—সব ঋতুতেই রাজশাহীতে কলাইয়ের রুটি খেয়েছি। কিন্তু শীতের মতো সুস্বাদু হয়নি সেসব। খেয়েছি মানে বিপদে পড়েই খেয়েছিলাম। কিন্তু শীতকালে খেয়েছি মনের আনন্দে। শিল্পের জন্য শিল্প যেমন, তেমনি শীতকালে রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জে কলাইয়ের রুটি স্বাদের জন্য খাওয়া। সে খাওয়ায় পেটও ভরে, মনও ভরে।
প্রথম যখন রাজশাহীতে কলাইয়ের রুটি খাই, সেই বয়সে যখন অ্যাডভেঞ্চার থাকে শরীর ও মনে, তখনো এ রুটির চেহারা দেখে খুব একটা পাত্তা দিইনি। রুটি এমন খটখটে শুকনা হবে কেন? কিন্তু দু–একবার খেয়ে যখন চক্ষুর বিবাদ ভঞ্জন হলো আর জিবের আড় ভাঙল, তখন নিজের প্রতি একধরনের করুণা হলো এত দিন না খাওয়ার জন্য।
প্রথম প্রথম আমরা খেতাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল বিশাল গাছগুলোর নিচে মাটির তাওয়া নিয়ে বসা ‘খালা’দের দোকানে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বিশাল এলাকার খোলা হাওয়ায় বিশাল বিশাল গাছের নিচে যে খালারা বসতেন মাষকলাইয়ের আটা, মাটির তাওয়া, কাঠের খড়ি, তাজা বেগুন, খাঁটি শর্ষের তেল আর মরিচ-পেঁয়াজ নিয়ে; সে খালাদের মনও ছিল বিশাল। গরম-গরম রুটি ভেজে দিয়ে তাঁরা এক হাতেই বানাতেন পোড়া বেগুনের ভর্তা। তাতে ইচ্ছেমতো শর্ষের তেল ঢেলে নেওয়া যেত। নেওয়া যেত ইচ্ছেমতো কাঁচা মরিচ আর পেঁয়াজের কুচি। তারপর সেগুলো মেখে গরম-গরম রুটি খাওয়ার মধ্যে যে রোমাঞ্চ ছিল, তা কি আর কোথাও খুঁজে পেয়েছি? পেয়েছিলাম একবার; ভারতের ডুয়ার্সের হাতিপোতা বাজারে মোমো খেতে গিয়ে। সে কথা থাক। আজ বরং কলাইয়ের রুটির কথা হোক।
শীতের দিনেই আমরা দল বেঁধে খেতে যেতাম কলাইয়ের রুটি। এটা চলত ফাল্গুন-চৈত্র মাস পর্যন্ত। এরপর সেই খালারা আর আসতেন না। এখন অবশ্য সে অবস্থা নেই। মোটামুটি স্থায়ী দোকানে সারা বছর পাওয়া যায় কলাইয়ের রুটি এবং অন্যান্য অনুষঙ্গ। আজ থেকে বছর কুড়ি আগে আমরা শুনতাম, রাজশাহী উপশহরে হাঁসের মাংস দিয়ে গরম-গরম কলাইয়ের রুটি খাওয়ার চল হয়েছে। দু–একজন খেয়ে এসে গল্পও করত। ক্যাম্পাস থেকে উপশহর বেশ খানিকটা দূর হওয়ায় যাওয়া হয়নি হাঁসের মাংসসহযোগে কলাইয়ের রুটি খেতে। মনে পড়ে না, ক্যাম্পাসজীবনে হাঁসের মাংস দিয়ে রুটি খেয়েছি। সেটা খাওয়া হয়েছে আরও কিছু পর, যখন বন্ধুদের সঙ্গে ক্যাম্পাসের দুপুর আর বিকেল দাপিয়ে বেড়ানো বয়স চলে গেছে, যখন চাকরি–বাকরি করে কর্ম উপলক্ষে অথবা স্রেফ ছুটি কাটাতে যেতাম মাঝেমধ্যে রাজশাহীতে।
সেই সন্ধ্যাগুলো ছিল অন্য রকম। রাজশাহী তখন ঝাঁ–চকচক করছে। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের চোখঝলসানো দোকান বসে গেছে স্টেশন রোডে। আমরা তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের বিশাল সেসব জারুল আর কড়ইগাছের নিচে খালাদের খুঁজে ফিরতাম। কিন্তু ক্লান্ত বিকেলগুলো কানে কানে বলত, ক্যাম্পাসে এখন আর খালাদের আসতে দেওয়া হয় না। আমরা বন্ধুরা, যারা তখনো রাজশাহীতে থাকে আর আমি মিলে যেতাম কুমারপাড়ার মোড়ে। একেবারে বড় রাস্তার ওপরে বিছানো টেবিল-চেয়ারে বসে পড়তাম ঘন হয়ে। ফুটপাতের ওপাশের দোকানে গলা উঁচু করে অর্ডার দিতাম—মামা, বেশি ঝাল দিয়ে ভর্তা আর রুটি দেন। রাস্তার ধুলো উপেক্ষা করে আমরা যখন বেশি ঝাল দিয়ে বেগুন ভর্তা খেতে বসি, তখন বন্ধু বলে, হাঁসের মাংস দেন মামা।
আমার সংবিৎ ফেরে। না, যখন রাজশাহী ছেড়েছি, তখন এই স্থায়ী দোকানগুলো ছিল না এ রাস্তায়। স্টেশন রোডে দু–একটা দোকান ছিল বটে। কিন্তু কুমারপাড়া মোড়ে ছিল না। খেয়াল করে দেখলাম, এখানে যে কয়েকটা দোকান ছিল, তাদেরই একটা ভোল পাল্টে কলাই রুটি, ভর্তা, হাঁসের মাংস খাওয়ানোর ব্যবস্থা করেছে। খারাপ নয় বিষয়টা।
রাস্তার ধুলো উড়ছে। আমরা ঝাল ঝাল হাঁসের মাংস দিয়ে গরমাগরম কলাইয়ের রুটি খেয়ে চলেছি। ঝাল এতটাই যে রাজশাহীতে ডিসেম্বরের শীতে শরীরের প্রতিটি রোমকূপ দিয়ে কুলকুল করে জল বেরিয়ে চলেছে। মাথার চুল প্রায় খাড়া হয়ে গেছে। কে ভ্রুক্ষেপ করে! ইতিমধ্যে তিনজনে ছয়খানা রুটি উড়িয়ে দিয়েছি। তিন বাটি হাঁসের মাংস। তিন বাটি বেশি ঝাল আর শর্ষের তেল দিয়ে বানানো পোড়া বেগুনের ভর্তা। এবার আরও দুখানা রুটির অর্ডার করা যায়। করা হলো। পুরো একখানা করে, অর্থাৎ আগের দুখানা এবং নতুন করে একখানা, মোট তিনখানা করে কলাইয়ের রুটি খাওয়া একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যায় বলে দুখানা রুটির অর্ডার। যাতে বেশি হয়ে না যায়। আবার দুই বাটি হাঁসের মাংস!
ডিসেম্বরের হিম পড়ে জ্যাকেট ভিজেছে ওপরে। আর ঝালের চোটে শরীর ভিজেছে জ্যাকেটের নিচে। বিল এল। সে নিয়ে থোড়াই কেয়ার করি আমরা খেতে গিয়ে? কিংবা করেছি কখনো? কিন্তু বিল দিতে গিয়ে একটু থমকাতেই হলো। এত কম বিল আসবে সেটা ভাবা কঠিন ঢাকায় থাকা মানুষের পক্ষে।
এখন ঢাকার শ্যামলী, মিরপুরেও পাওয়া যাচ্ছে কলাইয়ের রুটি আর হাঁসের মাংস। কুষ্টিয়া শহরেও খেয়ে এসেছি এ অমৃত গত ডিসেম্বরে। এসব জায়গায় যাঁরা কলাইয়ের রুটি বানান, তাঁরা রাজশাহী বা চাঁপাইনবাবগঞ্জেরই মানুষ। ফলে রুটি এবং এর গুণাগুণ নিয়ে ঘাবড়ানোর কিছু নেই। শুধু ঝালটা একটু কম দেন, এই যা। ভবিষ্যতে যাঁরা খাবেন তাঁদের জানিয়ে রাখি,
কলাইয়ের রুটির সঙ্গে আদি ও অকৃত্রিম অনুষঙ্গ হলো মরিচের ভর্তা অথবা বেশি করে ঝাল দিয়ে পোড়া বা সেদ্ধ বেগুনের ভর্তা।
হাঁসের মাংসের ঝোল দিয়েও খেতে পারেন। সেটাই এখন দস্তুর হয়েছে। তবে অবশ্যই ঝাল হতে হবে। মোট কথা ঝাল ছাড়া কলাইয়ের রুটি খাওয়া ঠিক জমে না।
রুটি খেয়ে সঙ্গে সঙ্গে পানি খাবেন না। তাতে রুটি ফুলতে শুরু করবে আর আপনি অস্বস্তিতে পড়তে থাকবেন। কাজেই খাওয়া শেষ করার আধা ঘণ্টা পর পানি খাবেন।
মনে রাখতে হবে, কলাইয়ের রুটি কোনো ফেন্সি ফুড নয়। এটি রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জের সাধারণ মানুষের খাবার। বেশ ভারী খাবার।