লাল মাংস খেয়ে নিজের ও পৃথিবীর বিপদ ডেকে আনছেন

শরীর ও পরিবেশ উভয়ের কথা ভেবে অনেকেই মাংস বর্জনের কথা বললেও পরিসংখ্যান কিন্তু ভিন্ন কথা বলছে। ছবি: রয়টার্স
শরীর ও পরিবেশ উভয়ের কথা ভেবে অনেকেই মাংস বর্জনের কথা বললেও পরিসংখ্যান কিন্তু ভিন্ন কথা বলছে। ছবি: রয়টার্স

‘মাংসে মাংস বৃদ্ধি/ দুধে বৃদ্ধি বল/ ঘৃতে লাবণ্য বৃদ্ধি/ শাকে বৃদ্ধি মল।’ প্রচলিত এ বচন থেকে খাবার সম্পর্কিত পরামর্শ পাওয়া যায়। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে উল্লিখিত চার খাবারের তিনটিই প্রাণিজ, একটি উদ্ভিজ্জ। সমস্যা হচ্ছে, এই তিন প্রাণিজ খাদ্য শুধু মাংস, শক্তি ও লাবণ্যই নয়, কার্বন নিঃসরণও বৃদ্ধি করে, যা এই পৃথিবীর রীতিমতো গলা চেপে ধরেছে বলা যায়।

আগের তুলনায় মানুষ অনেক পরিবেশসচেতন হয়েছে; তবে তা প্রায়োগিক দিক থেকে তেমন নয়। কথাটি বলতে হচ্ছে সময় ও পরিস্থিতি বিবেচনায়। শুরুতে উল্লিখিত বচনটি যে সময়ের, সে সময়েও মানুষ প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস করে বাঁচতে শুরু করেনি। আজকের যে প্রকৃতি-বিচ্ছিন্নতা, তা এতটা প্রকট হয়ে ওঠেনি তখনো। ফলে তার পক্ষে সে সময় খাদ্যের গুণবিচারই ছিল মুখ্য। শিল্পবিপ্লবের পর আর বিষয়টি এমন থাকেনি। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন শিল্পের জন্ম হওয়ায় জেরবার হয়ে ওঠে প্রকৃতি। মানুষ প্রকৃতি থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে যে উন্নয়নের সূচনা করে, তারই সবচেয়ে বড় শিকারে পরিণত হয়েছে আজ সে। এ অবস্থায় সব দিক থেকে লাগাম টানার আহ্বান জানাচ্ছেন পরিবেশবাদীরা।

এ তো বলার অপেক্ষা রাখে না যে, মাংসের নানা পদের নাম শুনলেই জিবে পানি আসে। কোনটির চেয়ে কোনটি বেশি মজাদার, তা নিয়েও ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলতে পারে তর্ক। কিন্তু এও তো সত্য যে অতিরিক্ত পরিমাণে মাংস খাওয়া মানুষের শরীর ও পৃথিবী—দুইয়ের জন্যই ভীষণ ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। আর তা যদি লাল মাংস হয়, তাহলে তো কথাই নেই।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষিবিষয়ক সংস্থা এফএওর তথ্যমতে, প্রতিবছর সারা বিশ্বে গৃহপালিত প্রাণী থেকে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ ৭ দশমিক ১ গিগাটন বা ৭১০ কোটি টন। আরও ভয়ংকর তথ্য হচ্ছে, এই পরিমাণ হচ্ছে নিঃসৃত মোট কার্বন ডাই–অক্সাইডের ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ। বোঝাই যাচ্ছে, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, জলবায়ু পরিবর্তন ইত্যাদি প্রেক্ষাপটে একে এড়িয়ে যাওয়ার আর কোনো উপায় থাকছে না।

বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে সারা বিশ্বে এখন মাংসের ভোগ কমানোর দাবিটি দিন দিন জোরদার হচ্ছে। সচেতন মানুষ মাংস খাওয়া কমানোর কথাও বলছেন হরহামেশা। কিন্তু এসব বিবৃতির সঙ্গে পরিসংখ্যান ঠিক মিলছে না। এফএওর তথ্যমতে, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে মাথাপিছু দৈনিক মাংস খাওয়ার হার ১৯৭০ সালের তুলনায় ১০ শতাংশ বেড়েছে। আর এর সঙ্গে আছে জনসংখ্যা বাড়ার বিষয়টি। ফলে মোটের ওপর বিষয়টি বেশ ভয়ংকর।

অর্থাৎ খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে অধিকাংশ মানুষের ইচ্ছার সঙ্গে কার্যক্রমের সমন্বয় নেই। অনেকেই হয়তো সত্যি সত্যি মাংস খাওয়া কমাতে চান, কিন্তু কার্যত তা পারেন না। কিন্তু নিজেদের স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা বিবেচনা করলে তা পারা উচিত। এ ক্ষেত্রে একটি গবেষণাপত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সাময়িকী ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ জানাচ্ছে, যেসব প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মাংস খান, তাঁদের মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি থাকে। এসব মানুষ পরিবেশকেও ঝুঁকির দিকে ঠেলে দেন।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয় যৌথভাবে পরিচালিত ওই গবেষণায় দেখা গেছে, একই বয়সের প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মধ্যে যাঁরা গড় মানের চেয়ে দিনে ৫০ গ্রাম বেশি মাংস খান, তাঁদের মৃত্যুঝুঁকি অন্যদের তুলনায় ৪১ শতাংশ বেশি থাকে।

আর পরিবেশের ক্ষতিটি বিবেচনায় নিলে তা আরও ভয়াবহ রূপ নেয়। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের পিএনএস জার্নালে প্রকাশিত ওই গবেষণায় জানানো হচ্ছে, ১০০ গ্রাম সবজি থেকে যে পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ হয়, ৫০ গ্রাম মাংস থেকে তার চেয়ে ২০ গুণ কার্বন নিঃসরণ হয়। মোটাদাগে বাস্তুসংস্থানের সব হিসাবকে বিবেচনায় নিয়ে গবেষকেরা এই উপসংহারে পৌঁছেছেন যে, লাল মাংস খাওয়ায় সবজির তুলনায় ৩৫ শতাংশ বেশি ক্ষতি হয় পরিবেশের।

দৈনিক খাদ্যতালিকায় সবজির পরিমাণ বাড়ালে তা পৃথিবীকে বাঁচাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ছবি: রয়টার্স

এসব হিসাব পুঙ্খানুপুঙ্খ না জানলেও মাংস যে শরীর ও প্রকৃতি দুইয়ের জন্যই ক্ষতিকর, তা মোটাদাগে সচেতনমাত্রই জানেন। কিন্তু তারপরও কেন মাংসের ভোগ দিন দিন বেড়েই চলেছে? এর পেছনের কারণও হচ্ছে ওই শরীর। আরও ভালো করে বললে বলতে হয়, ক্যালোরির কথা। কারণ, ৫০ গ্রাম মাংস থেকে যে পরিমাণ ক্যালোরি আসে, তার সমপরিমাণ ক্যালোরির জোগান পেতে হলে প্রচুর সবজি খেতে হবে। কিন্তু মাংসের ভোগ কমাতে গিয়ে অধিকাংশ মানুষই হিসাবটি করেন না। ফলে শারীরিক নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয় তাঁদের। আর এ কারণেই তাঁরা আবার ফিরে আসেন মাংসের কাছেই।

কথা হচ্ছে, মাংস খাওয়া কতটা কমালে পৃথিবী কী হারে উপকৃত হবে? বিষয়টি নিয়ে চলতি বছরের শুরুর দিকে গবেষণা করেছিলেন জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দল গবেষক। তাঁরা দেখেন, নিরামিষভোজীরা আমিষাশীদের তুলনায় বছরে ৩০ শতাংশ কম কার্বন নিঃসরণ করেন। আর দুধ ও ডিম খাওয়াও যদি বন্ধ করা হয়, তাহলে এ হার আরও বেড়ে যায়।

এক হিসাবে দেখা গেছে, প্রতিদিনের খাবারের দুই-তৃতীয়াংশই যদি উদ্ভিজ্জ উপাদান দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়, তাহলে শুধু খাবার থেকে হওয়া কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ বছরে ৬০ শতাংশ কমে যাবে। আর পুরো মাত্রায় নিরামিষভোজী হয়ে গেলে তো কথাই নেই। তখন এ হার ৮৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে আসে।

তবে মোদ্দাকথা হচ্ছে, খাদ্যাভ্যাস বদলানো এতটা সহজ নয়। পরিবেশসচেতনতা দিন দিন বাড়লেও তাই শুধু খাবার থেকে হওয়া কার্বন নিঃসরণের হারে ঠিক লাগাম পরানো যাচ্ছে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাতারাতি মাংস খাওয়া বন্ধের উদ্যোগ নেওয়াই কাল হয়ে দাঁড়ায়। এ কারণে বিষয়টি সহনীয় মাত্রায় নামিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়াই ভালো, যাতে তা টেকসই হয়। অর্থাৎ, ‘আজকেই শেষ, কাল থেকে মাংস খাব না’, এমন সিদ্ধান্ত না নিয়ে, মাংস খাওয়ার পরিমাণ ধীরে ধীরে কমানোটাই ভালো। আর খাদ্যাভ্যাস বদলানোর যেকোনো সিদ্ধান্ত কার্যকরের আগে পুষ্টিবিদের শরণ নিলে শরীর ভেঙে পড়ার আশঙ্কাও আর থাকে না।