ঢাকায় এসে শুনি, এর নাম নাকি দুধচিতই। তবে রসের পিঠার সঙ্গে এর কোনো তুলনাই হয় না। কারণ, এতে মূল উপাদান খেজুরের রসই নেই। এই চিতই আবার পথেঘাটেও খাওয়া হয় নানা উপকরণ সহযোগে। আর সেসব উপকরণ দেখে চক্ষু চড়কগাছ হতে বাধ্য। সর্ষেবাটা, ধনেপাতাবাটা, মাংসের ঝোল মায় শুঁটকি ভর্তা—এ দৃশ্য দক্ষিণবঙ্গের মানুষের জন্য এক বিরাট ধাক্কা। প্রথম প্রথম পথের পাঁচালীর অপুর মতো হাঁ করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া গত্যন্তরই–বা কী ছিল। অবশ্য দিনে দিনে গা–সহা হয়ে গেছে। কারণ, প্রতি শীতে ঢাকা শহরের সব বিত্ত আর বৃত্তের মানুষের জন্য নানা অনুষঙ্গে চিতই খাওয়া এখন রীতি। এ যেন হালের শীতকালীন রসনা-সংস্কৃতি। কোথাও কোথাও আবার ভর বছর মেলে চিতই। পথের খাবার হিসেবে সরব এর অবস্থান। তবে হ্যাঁ, চলতি ধারা যা–ই হোক, দক্ষিণবঙ্গের রসের পিঠা নামক শীতের চিরায়ত এক সুখাদ্যের কাছে তা নস্যি। ইংরেজিতে যাকে বলা যায় ‘ক্ল্যাসিক উইন্টার ডেলিকেসি’।
প্রস্তুতি থেকে পরিবেশন—প্রতিটি ধাপেই রয়েছে অনিন্দ্য পারিপাট্য, অনবদ্য নিষ্ঠা। এ যেন এক নিটোল শিল্পকর্ম। এই পিঠার প্রস্তুত প্রণালিও চিত্তাকর্ষক। ঢাকায় যেটাকে চালের গুঁড়ি বলা হয়, সেটা বৃহত্তর খুলনায় পরিচিত চালের আটা হিসেবে। একটা সময় ছিল, যখন ধান রোদে শুকিয়ে আতপ করে ঢেঁকিতে ভেনে চাল করা হতো। তারপর সেই আতপ চাল ঢেঁকিতেই গুঁড়া করে তৈরি করা হতো আটা। দুপুরে খাওয়ার পর সব কাজ গুছিয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে চালের আটা তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হতো। এখন এত ক্লেশ সইবে কে? যন্ত্র যে জীবনকে সহজ করে দিয়েছে। তাই যন্ত্রেই ভাঙিয়ে নেওয়া হয়। সুপারশপে মেলে তৈরি গুঁড়া। এখানেও কথা থেকে যায়। কলে ভাঙানো আটা আর ঢেঁকিতে ভানা আটার মধ্যে তফাত আছে। কারণ, কলের আটায় জাঁতার গরমে আটার আর্দ্রতা একেবারেই থাকে না। আটা ঝরঝরে হয়ে যায়। যেটা এই পিঠার জন্য উপযুক্ত নয়।
ঢেঁকিতে চালের আটা বা গুঁড়ি করার পর আর্দ্রতা সামান্য কমাতে রোদে দিয়ে নেওয়া হয় বটে, তবে তা যন্ত্রে ভানা আটার মতো রুক্ষ হয়ে যায় না।
তারপর বেশ আয়োজন করে কোনো এক শীতসাঁঝে করা হতো পিঠা। তার জন্য আগে ধুয়েমুছে সর্ষের তেল দিয়ে ব্যবহারের উপযোগী করে রাখা হতো পিঠার ছাঁচ। আমরা বলি খোলা। একটা খোলার মধ্যে চারটা ছাঁচে চারটা করে পিঠা হয়। খোলার আকার বড় হলে পিঠার আকারও বড় হয়। ছাঁচ নতুন হলে ধুয়ে সেটায় তেল মাখিয়ে (রন্ধনশিল্পের আধুনিক ভাষায় গ্রিজিং) খড়ির চুলায় কিছুক্ষণ তাতিয়ে নেওয়া হয়। খোলা পুরোনো হোক বা নতুন, পিঠা করার সময় মাঝে মাঝেই চলবে তেল মাখানো।
সন্ধ্যা বা রাতের অন্য কাজ মিটিয়ে তবেই শুরু হতো এই পিঠা বানানো। হারিকেন কিংবা কুপির আলোয়। মাটির উনুনে, খড়ির আগুনে। চালের আটা আগেই সুন্দর করে চেলে রাখা হতো। তার সঙ্গে প্রয়োজনমতো লবণ আর নারকেল কোরা মিশিয়ে তাতে পরিমাণমতো পানি দিয়ে তৈরি হতো গোলা। এই প্রক্রিয়াকে এখন অনেকেই ব্যাটার বলতে অভ্যস্ত। এভাবে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের রান্নার নিজস্ব পরিভাষা।
পড়া ফাঁকি দিয়ে চাদর বা সোয়েটার জড়িয়ে কনকনে শীতের রাতে উনুনের পাশে বসে ছোটদের অধীর অপেক্ষা। এসব সন্ধ্যায় বাবারাও কেন যেন কিছুটা থাকতেন আশকারা দেওয়ার মুডে। পিঠা তৈরি হলে রসে দেওয়ার আগে খাওয়া হবে। একটা উত্তেজনাও আছে—পিঠা ফুলছে কি না ঠিকমতো। যেগুলো ঠিকঠাকমতো ফুলবে, সেগুলো দেওয়া হবে রসে। অন্যগুলো আগেই খাওয়া হবে। না, অন্য কিছু নয়, কেবল খেজুরের ঝোলাগুড় দিয়ে। সেই গুড়ের সুঘ্রাণ আর গরম পিঠার সৌরভ মিলেমিশে অদ্ভুত মৌতাত বুনত শীতের কুয়াশাময় রাতে।
বিদেশি সব চ্যানেলের বদৌলতে নানা দেশের নানা ধরনের পিঠা বা প্যানকেকের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটছে। এসব পিঠা খেতে হয় ক্যারামেল, চকলেট সস বা মধু দিয়ে। সেসব যে চেখে দেখার সৌভাগ্য হয়নি, তা নয়। কিন্তু খেজুরের নতুন রসে তৈরি ঝোলাগুড় দিয়ে এই চিতই খাওয়ার মজাই আলাদা। এ স্বাদ কালজয়ী।
ধীরে ধীরে রাত গভীর হতো। পিঠা বানানোর ফাঁকে ফুলকো পিঠাগুলো ফেলা হতো রসে। তার আগে তৈরি করতে হয়েছে রস। এ আরেক হৃদয়গ্রাহী শিল্পকর্ম। প্রথমে খেজুরের রস জ্বাল দিয়ে ঘন করে নিতে হবে। এতে অতিরিক্ত কোনো মিষ্টি দেওয়া হয় না। যোগ হয় কেবল নারকেলের দুধ। ঘন রসে নারকেলের দুধ মেশানোর পর তার রং; আহা, নয়ন জুড়ায়! নারকেলের দুধ মেশানোর পর তা আরেক প্রস্থ জ্বাল দিয়ে ঠান্ডা করে তবেই তার মধ্যে গরম পিঠা ভেজানো হয়।
অথচ ঢাকায় এই রসের দেখা মেলা ভার। বিকল্প তাই গুড় (সে গুড়েও তো এখন বালি! নানা রাসায়নিক মিশিয়ে তৈরি পদার্থে খেজুরের গুড়ের নির্যাস বা এসেন্স মিশিয়ে নলেন গুড় তৈরি হচ্ছে)। আর তা গুলে তাতে নারকেল কোরা মিশিয়ে জ্বাল দিয়ে তৈরি তরলে পথের পাশের কোনো এক খালার দোকান থেকে কিনে আনা চিতই ভিজিয়ে দুধের সাধ ঘোলে মেটাচ্ছে নগরবাসী।
পিঠা তৈরির গোলা বা ব্যাটারের ঘনত্ব আর কাঠের আগুনের তাপের রসায়ন ঠিকঠাকমতো হলেই পিঠাগুলো ফুলে উঠবে ঠিকঠাক, নচেৎ নয়। তার মধ্যে রসও ঢুকবে না। আবার কী পরিমাণ রসে কতটা পিঠা দিলে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে, সে হিসাবটাও জরুরি। দক্ষ রাঁধুনির এসব নখদর্পণে। তাই পরিবারের সদস্য, পরিজনদের সংখ্যা হিসাব করেই পিঠা বানানো হয়েছে। রসের মধ্যে পিঠা ফেলা শেষ হলে ভালো করে মুখ লাগিয়ে সারা রাত ঘরের সাধারণ তাপমাত্রায় রেখে দিতে হয়। রাতভর সেই অমৃত তরলে সাঁতরে ক্লান্ত পিঠাগুলো হাবুডুবু খেতে খেতে একসময় নেতিয়ে পড়বে। রসের ভারে ফেটে চৌচির হবে। তাদের নরম দেহবল্লরি হবে আরও মোলায়েম।
পরদিন সকালে কুশায়ার আস্তরণ ভেদ করে সূর্যের দেখা মিলবে। প্রশ্বাসে ধোঁয়া বেরোনো শীতসকালে উঠান বা বারান্দায় সূর্যের দিকে পিঠ করে বসে খাওয়া হবে তুলতুলে পিঠা। সঙ্গে সেই অমৃত রস। বিদেশি শেফরা আবার এই ধরনের প্রগাঢ় তরলকে সস আখ্যা দিয়ে থাকেন। যদিও সস নামক শব্দে এই রসের দ্যোতনা সঠিক প্রতিভাত হয় না। পিঠা চামচ দিয়ে কেটে মুখে দিলে গলে যায় আপনা-আপনি। এর সঙ্গে সরপড়া দুধ কয়েক চামচ দেওয়া গেলে তো কথাই নেই। অনাবিল সৌরভে ম–ম করে অন্দর আর বাহির। অতুল্য এই স্বাদ একবারেই স্বর্গীয়।
শীত এলেই বেয়াড়াপনা করে স্মৃতি। নাসারন্ধ্র অতীত হাতড়ে ঠিকই সামনে আনে সেই হারানো সুঘ্রাণ। মেদুর হয় নগর-ঘেরাটোপে বন্দী মন। তখন ব্যর্থ আয়োজন চলে দুধচিতইয়ের। সকালে তা ছদ্ম আয়েশে গলাধঃকরণ করতে করতে গল্পের ঝাঁপি খুলে বসেন স্মৃতিকাতর জ্যেষ্ঠ নাগরিক; যাতে কিছুটা হলেও শিকড়ের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে পারে কেক, পেস্ট্রি, টার্ট, ডোনাট খাওয়া হালের প্রজন্ম।
পরিতাপের বিষয়, আমাদের এই অনন্যতা ধরে রাখার কোনো চেষ্টাই যেন নেই। তবু এখনো গ্রামের কোনো কোনো বাড়িতে হয়তো প্রতি শীতে সমান যত্নে তৈরি হয় রসের পিঠা। শহর থেকে গ্রামে বেড়াতে গেলে কোনো দাদি বা নানি পরম মমতায় রূপায়িত করেন পরম্পরার শিল্প: অমৃত সুধারসে জারিত জাদুগোলক।