অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী
অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

মৎসমহারাজের জয়গান

তখন আর কতই–বা বয়স। বাবার সঙ্গে হাঁটে যাচ্ছি। বিকেলের দিকে রোদ একটু পড়ে এসেছে। বেশ একটা আলোছায়ার খেলা। এরই মধ্যে বৃষ্টি। কিন্তু এ বৃষ্টি ঠিক গায়ে লাগে না। জাম আর জামরুলের পাতায় স্ফটিক বিন্দুর মতো লেগে থাকে। যেন আঠা দিয়ে মতি বসানো। চুলের ওপর পড়েও ঠিক তেমনই হয়। মনে হয় আকাশ থেকে কেউ হিরের গুঁড়ো ছড়াচ্ছে।
বাবা বললেন, জানিস এই বৃষ্টিকে কী বলে।
—কী?
—ইলশেগুঁড়ি। এই বৃষ্টির গুঁড়ো গায়ে লাগলে তবেই ইলিশ ডিম পাড়ে। আর কিছুদিনের মধ্যেই ইলিশ ধরা বন্ধ হয়ে যাবে।
আরও বেশ কিছু কথা বললেন। যা কতক বুঝেছি তখন, কতক বুঝিনি। মনে আছে একটা ছড়ার কটা লাইন:
ইলশেগুঁড়ি! ইলশেগুঁড়ি
ইলিশ মাছের ডিম
ইলশেগুঁড়ি! ইলশেগুঁড়ি
দিনের বেলায় হিম।

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

বাবা পুরোটা ছড়াই বলেছিলেন। বলেছিলেন বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে লাগলে ইলিশ সত্যিই উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। তখন একটা শব্দ বেশ মনে ধরে ছিল—‘উলসে ওঠে মন’।
বড় হয়ে ছড়াটা অনেকবারই পড়েছি। তবে ইলিশের নামে কেবল আমার নয়, বলার অপেক্ষা রাখে না, আপামর বাঙালির মনই উলসে ওঠে।

সেদিন বাবার আক্ষেপও ছিল, যেমন থাকে অতীত আশ্রয়ী সব বাঙালির। আগের মতো এখন আর ইলিশের স্বাদ হয় না। আগে ইলিশ ভাজলে সারা পাড়ায় সেই সুবাস ছড়াত।
আর সেই সুখাদ্যের ঘ্রাণে শেওড়াগাছ থেকে পেতনি নেমে এসে নাকি সুরে ইলিশের টুকরো চাইত। বদলে তাকে নোড়া পুড়িয়ে ছ্যাঁকা দিলে সে পড়িমরি করে পালাত। সন্ধ্যাবেলা হারিকেনের চারপাশে গোল হয়ে বসে ‘পথের পাঁচালী’র অপুর মতো হাঁ করে মায়ের কাছে এসব গল্প শুনতে শুনতেই আমাদের বড় হয়ে ওঠা।

ইলিশ, ইস্টবেঙ্গল আর ভাগ্যকুলের পরম্পরা

কলকাতার কুমোরটুলিতে জন্ম ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের। বৃহত্তর ময়মনসিংহের টাঙ্গাইলের নাগরপুরের জমিদার সুরেশ চন্দ্র রায়চৌধুরীর অনুরোধে আর যাঁরা এই ক্লাবের প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসেন তাঁদেরই একজন ভাগ্যকুলের জমিদার যদুনাথ রায়। প্রথম কমিটিতেও তিনি ছিলেন। তবে তিনি একা নন, তাঁর পুরো পরিবার বলতে গেল ছিল ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে। এখনো সেই ধারা অব্যাহত রয়েছে। কেবল নামে নয়, পূর্ব বাংলার গর্বের প্রতীক ইলিশ হয় ইস্টবেঙ্গলের প্রতীক। পৃথিবীর আর কোনো ক্লাবের প্রতীক হিসেবে মাছ আছে কি না আমার জানা নেই। তবে একটা সময় পর্যন্ত ইস্টবেঙ্গল ও তার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মোহনবাগানের খেলায়, ইউরোপীয় ঢঙে যেটা এখন কলকাতা ডার্বি বলা হয়, ইস্টবেঙ্গল জিতলে কলকাতায় ইলিশের দাম বেড়ে যেত।

ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের প্রতীক মশালের ‍উপর জোড়া ইলিশ

এবার ভাগ্যকুলের জমিদারদের ইলিশ পরম্পরার প্রসঙ্গে আসা যাক। আজও শারদীয়ায় ইলিশ-পরম্পরা রক্ষা করে চলেছেন তাঁরা। ভাগ্যকুলের রায়েরা এখনো পুজোর দিনগুলোতে ইলিশ খেয়েই কাটান বলে জানা যায়। তাদের ইলিশের নানা মেনুর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো, ইলিশের ডিমের ভাপা। পেঁয়াজ আর কাঁচা মরিচ দিয়ে মাখো মাখো ডিমভর্তা। জনৈক খাদ্যরসিক আবার একে কেভিয়ারের সঙ্গে তুলনা করেছেন।

তবে ভাগ্যকুলের জমিদারই হোক আর সাধারণ মানুষ, নতুন উদ্ভাবনে বাঙালির জুড়ি মেলা ভার। এ ক্ষেত্রে ভর্তার কথা আসে সবার আগে। বাঙালির আরেক উদ্ভাবন ইলিশের মাথা আর লেজভর্তা। এটা মাওয়া ঘাটের রন্ধনশিল্পীদের আবিষ্কার। আর তা নাকি চেটেপুটে খাওয়ার মতো সুস্বাদু।

ইলিশে দৈবের বশে

সিন্ধু প্রদেশ জয় করে দিল্লি ফেরার পথে মারা গিয়েছিলেন খেয়ালি সম্রাট মোহাম্মদ বিন তুঘলক। এই মৃত্যুতে ছিল তাঁর খেয়ালিপনা। কারণ, নদীপথে যাওয়ার সময় তাঁর হঠাৎ মাছ খেতে ইচ্ছে হয়েছিল। এখন সুলতানের ইচ্ছে বলে কথা। তাই তাঁকে যথেচ্ছ মাছ খাওয়ানো হলো। আর তাতেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন এবং পৃথিবীর মায়া কাটালেন। কিন্তু কী মাছ খেয়ে তাঁর পরপারের অতিথি হতে হয়েছিল, তা কোনো ইতিহাসবিদ লিখে যাননি। তবে আমাদের একমেবাদ্বিতীয়ম সৈয়দ মুজতবা আলীর ধারণা, ইলিশে দৈবের বশে তুঘলকের প্রাণবায়ু নিঃশেষ হয়েছে।

খেয়ালি সম্রাট মোহাম্মদ বিন তুঘলক

তবে ইলিশ খেয়ে মোহাম্মদ বিন তুঘলকের মৃত্যু হোক বা না হোক, আরেক নবাব ইলিশকে মহিমান্বিত করে রেখে গেছেন এক পদ সৃষ্টির অনুঘটক হয়ে। তিন নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ। তিনি ইলিশও খাবেন আবার পোলাও। কিন্তু সেটা একসঙ্গে হতে হবে। তাঁর হেঁশেলে বাবুর্চিরা সব পূর্ব বাংলার। ফরমাশ পেয়ে তাঁরা নবাবের জন্য দস্তরখান সাজিয়ে দিলেন সেই ইলিশ পোলাওয়ে। যার নাম হলো মাহি পোলাও। এখনো টিকে আছে মুর্শিদাবাদে।

আলী ও ইলিশ

সৈয়দ মুজতবা আলী

সৈয়দ মুজতবা আলী মনে করেন, ইলিশের আকর্ষণ ঐন্দ্রজালিক। ইলিশের কথা উঠলে মানুষের হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। তাঁর কথাই ঠিক। কারণ, হিতাহিত জ্ঞান যে থাকে না সে প্রমাণ তিনি নিজেই দিয়েছেন। এক পাঞ্জাবি অধ্যাপকের সঙ্গে খাওয়া নিয়ে আলোচনায় তিনি ইলিশের পক্ষে। সরু চালের ভাত আর গঙ্গার ইলিশই শ্রেষ্ঠ খাবার। আর অধ্যাপক বেচারা বিরিয়ানির দিকে। এরপর মুজতবা আলী রেগে গিয়ে নাকি ওই অধ্যাপকের সঙ্গে সাত দিন কথা বলা বন্ধ রেখেছিলেন।

মুজতবা আলী ছিলেন নিদারুণ রসনাবিলাসী। স্বাদ আর সহবত জানতেন। তাই পান থেকে চুন খসলে বিলক্ষণ বিরক্ত হতেন। একবার এক দাওয়াতের টেবিল সাজানো হয়েছে একাধিক মাংসের পদের সঙ্গে ইলিশ মাছ। আর তা দেখে বেজায় চটলেন তিনি। উঠে পড়লেন টেবিল থেকে। কারণ, তাঁর কথা হচ্ছে, ইলিশের সঙ্গে অন্য কিছু যায় কীভাবে? পরে অনেক বুঝিয়ে–সুঝিয়ে তাঁকে খাওয়ানো সম্ভব হয়।

ইলিশ তাঁর কাছে অমৃত। একটা আস্ত ইলিশ মাঝবরাবর ফেড়ে মসলা মাখিয়ে কলাপাতায় মুড়ে ভাপে সেদ্ধ করলে যেটা দাঁড়াবে তা স্বর্গীয়। এই পদ যেমন স্বাস্থ্যকর তেমনই উপাদেয়। একা আড়াই-তিন কেজির মাছ খেলেও কিছু হবে না। এই পরামর্শও তাঁর।

ইলিশ যখন পণ্যদূত

প্রচারণায়ও নানাভাবে ব্যবহৃত হয়েছে ইলিশ। ইলিশের কথা এলে আমার সবার আগে মনে আসে একটি বিজলিবাতির বিজ্ঞাপন। একসময় ব্যাপক জনপ্রিয় হয়েছিল ‘মাছের রাজা ইলিশ। আর বাত্তির রাজা ফিলিপস।’

বেশ আগে পশ্চিম বাংলায় একটি বিজ্ঞাপন ছিল ‘দু হাজার টাকার ওপরে সোনার জিনিস কিনলে একটি ইলিশ মাছ ফ্রি।’

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

এখানেই শেষ নয়। বরং আরও আগের কথা। এক থিয়েটার কোম্পানির মালিক দর্শক টানতে শো শেষে একটি করে ইলিশ দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে বিজ্ঞাপন দেন। তাতে লেখা ছিল ‘অভিনয় দেখিতে আসিবার সময় গৃহিণীকে বিশেষ করিয়া বলিয়া আসিবেন যেন শেষ রাত্রে উনানে আগুন দিয়া তৈল প্রস্তুত রাখেন। অভিনয় দেখিবার পর, বাড়ি গিয়া গরম গরম ইলিশ মাছ ভাজা খাইয়া মন-রসনা তৃপ্তি সাধন করিবেন।’

একসময় এটাও বলতে শোনা গেছে ‘মাইরের সেরা পুলিশ, মাছের সেরা ইলিশ।’
১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচনে জনপ্রিয় হয়েছিল একটি ছড়া ‘ইলিশ মাছের তিরিশ কাঁটা, বোয়াল মাছের দাড়ি/ ইয়াহিয়া খান ভিক্ষা করে/ শেখ মুজিবের বাড়ি।’

ইলিশ ও গোপাল ভাঁড়

ইলিশ নিয়ে কথা হবে আর সেখানে গোপাল ভাঁড় থাকবে না, তা কি হয়? একবার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র গোপাল ভাঁড়কে বললেন, গোপাল তুমি যদি নদীর পাড় থেকে এক জোড়া ইলিশ কিনে সোজা রাজদরবারে চলে আসতে পারো, কারও কোনো প্রশ্নের মুখের না পড়ে, তাহলে তোমাকে পুরস্কৃত করা হবে।

অলংকরণ: রাজীব

শুনে তো গোপাল এককথায় রাজি। কারণ, এ আর এমন কী কঠিন কাজ। অতএব রাজার চ্যালেঞ্জ নিয়ে গোপাল ঠিকই এক জোড়া ইলিশ কিনে কানকোর মধ্যে দিয়ে রশি ঢুকিয়ে হাঁটা ধরলেন রাজবাড়ির দিকে। তবে তার আগে নিজের ধুতিটা তুলে মুখ ঢেকে নিলেন। রাস্তায় তাকে দেখে কেউ আর টুঁ শব্দটি করল না। বরং কেউ হেসে গড়াল। কেউ আবার গম্ভীর হলো। মেয়েরা যে যেখানে ছিল মুখ ফেরাল। অনেকে কানাঘুষা করল, ‘দেখো, দেখো, পাগল আবার ইলিশ কিনেছে।’

ইলিশের তেল, কমলবাবুর মশকরা আর উতোরচাপান

ইলিশের তেলের কথা এলে কমলকুমার মজুমদারের প্রসঙ্গ আসতে বাধ্য। তিনি অবশ্য পদ্মার ইলিশকে পাত্তা দিতে নারাজ। তাঁর মতে পদ্মা নয়, গঙ্গার ইলিশই উপাদেয়। এর কারণ হিসেবে তাঁর ব্যাখ্যা, আরে গঙ্গার ইলিশ দুই শ বছর কোম্পানির (ব্রিটিশের) তেল খেয়েছে না। তেলতেলে তো হবেই। তাই স্বাদ হবে না কেন।
সাহিত্যিক লীলা মজুমদারের সাফ কথা, কাঁচা ইলিশের ঝোল রাঁধুক তো ঘটিরা! চাপানেও কম যান না আরেক লেখিকা জ্যোৎস্না দত্ত, ঘটিদের উদ্ভাবন দই ইলিশ। পূর্ববঙ্গে তো দইয়ের চলই নেই।

ইলিশের পুষ্টিগুণ

দারুণ পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ

ইলিশ দারুণ পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ। প্রতি ১০০ গ্রাম ইলিশে আছে ২১ দশমিক ৮ গ্রাম প্রোটিন, ২৪ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি, ১৮০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ৩ দশমিক ৩৯ গ্রাম শর্করা, ২ দশমিক ২ গ্রাম খনিজ ও ১৯ দশমিক ৪ গ্রাম চর্বি। এ ছাড়া আছে নানা ধরনের খনিজ, খনিজ লবণ, আয়োডিন ও লিপিড। ইলিশের খাদ্যশক্তির পরিমাণও অন্যান্য প্রাণিজ প্রোটিনের চেয়ে বেশি। ১০০ গ্রামে ২৭৩ কিলোক্যালরি। ইলিশে ভিটামিন এ ও ডি রয়েছে। আছে অ্যামাইনো, ভ্রূণের উপযুক্ত বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। আর হৃদ্‌রোগ হ্রাসে ইলিশের তেল অত্যন্ত উপকারী। কারণ, এতে রয়েছে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড। আর এই ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিডের ইপিএ আবার করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে সক্ষম। তাহলে জমিয়ে ইলিশ খাওয়া যেতেই পারে।

এই লকডাউনে নদী দূষণ থেকে রেহাই পাওয়ায় ইলিশের আকারও অন্যবারের তুলনায় বেশ বড়সড়ই হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়োজন, ইলিশ মঙ্গলের প্রতীক। শাস্ত্রেও রয়েছে তাঁর গুণবর্ণন, ‘ইল্লিশো মধুর/ স্নিগ্ধো রোচনো/ বহ্নিবর্জনঃ/ পিত্তিকৃৎ কফকৃৎ/ কিঞ্চিল্লঘু ধর্মোহ নিলাজহঃ।’ এর অর্থ, ইলিশ মাছ স্বাদে মধুর, রুচিবর্ধক, বলবর্ধক, অম্ল দূর করে, পিত্ত দূর করে, বাত কমায়; আর তা পুষ্টিকরও।

ফেলনা নয় কিছুই

ইলিশের কিছুই ফেলনা নয়। ইদানীং ইলিশের আঁশ সুন্দর করে পরিষ্কার করে চিপসের মতো করে ভেজে খাওয়া হচ্ছে। ইলিশের যকৃৎ তো আগে থেকেই খাওয়ার চল রয়েছে। যেটাকে বলা হয় লুকা। আর এই লুকার পাতুড়িও হয়। আবার লুকার তেল দিয়ে মুড়ি মেখে খাওয়া কোনো কোনো অঞ্চলের ডেলিকেসি। ইলিশ মানুষকে সত্যিই বিহ্বল করে। এ যেন স্বর্গের অপ্সরা! ঋষির ধ্যান ভাঙাতে ওস্তাদ। এখানেই বলে রাখি, ইলিশের কাঁটা অন্য মাছের তুলনায় আলাদা। আর একটা এক কেজি ওজনের ইলিশের শরীরে অন্তত ১০ হাজার কাঁটা থাকে।

তথ্যঋণ:
ইলিশ পুরাণ, দিগেন বর্মন
ভোজন শিল্পী বাঙালী, বুদ্ধদেব বসু
মছলিশ, আলপনা ঘোষ
পাক-প্রণালী, বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায়
বাঙালি চার সহস্র বছরের খ্যাদ্যাভাস ও খাদ্যাচার: বিবর্তন ও অনুসন্ধান, প্রবন্ধ শুভদীপ বোয়াল, সপ্তডিঙা, বিশ্বকর্মাপূজা সংখ্যা ২০১৯।