মাওয়া ঘাটে ইলিশ সকাল

ইলিশ ভাজা মাওয়া–স্টাইল। ছবি: লেখক
ইলিশ ভাজা মাওয়া–স্টাইল। ছবি: লেখক

লাল শার্ট পরা দশাসই চেহারার মাছবিক্রেতা। ‘বড় ইলিশ নেবেন?’ বলে ধরলেন এক ইলিশ। হাতে ধরা ইলিশটিও তাঁর মতোই দশাসই। ওজন কমসে কম দুই কেজি। দাম কত জিজ্ঞেস করতেই বিক্রেতার জবাব, ছয় হাজার টাকা। আঁতকে উঠলাম। দামাদামির দিকে আর গেলাম না। ক্যামেরায় ক্লিক করতে থাকি। বিক্রেতাও ছয় হাজারি ইলিশ বাগিয়ে পোজ দিতে থাকেন।

এত দামের ইলিশ দেখে না ঘাবড়ালেও চলে। কেননা, সেখানে আরও অনেক বড় আকারের ইলিশ রয়েছে। ইলিশের রাজ্য বলে কথা। পদ্মা নদীর পাড়ে মাওয়া ঘাটের কথা বলা হচ্ছে, যেখানে ভোর হয় ইলিশের গন্ধে। মৎস্যজীবী, আড়তদার, ক্রেতা-বিক্রেতার হই-হট্টগোল, বরফের চাঁই ভাঙার আওয়াজ—ভ্যান, পিকআপ মিলিয়ে একেবারে মহাযজ্ঞ। পদ্মা নদীর পাড়ে পুরান ঘাটে প্রতিদিনই সকালে বসে মাছের এই আড়ত। সেখানে ইলিশ অনিবার্য, তবে বর্ষা মৌসুমে ইলিশ থাকে আগ্রহ আর কেনাবেচার কেন্দ্রে।

ইলিশের নৌকা ঘাটে বাঁধা, ইলিশ চলেছে বাজারের পথে

১৪ জুলাই ঢাকা থেকে যখন রওনা হচ্ছি, তখন ভোর সাড়ে চারটা। ঢাকা-মাওয়া মহাসড়ক ধরে কেরানীগঞ্জ পেরোতে অন্ধকার কাটতে থাকে। মেঘলা আকাশ, তবু দিনের আলো টের পাওয়া যায়। কেরানীগঞ্জ থেকেই বোঝা যায় পদ্মা সেতু নির্মাণের বিপুল কাজের নমুনা। কোথাও ডানে, কোথাও বাঁয়ে সড়ক বাড়ানোর কাজ চলছে। মাটি ভরাটের ট্রাক, বুলডোজারের ছড়াছড়ি। এই কাজের জন্য হয়তো ঢাকা-মাওয়া সড়কের বৃক্ষরাজি কেটে ফেলা হয়েছে। বিরানভূমির অনুভূতি নিয়ে সাড়ে পাঁচটায় পৌঁছে যাই মাওয়ায়।

রূপালী ইলিশ

মাওয়া মোড় থেকে বাঁয়ে গেলে বর্তমান ফেরিঘাট। সেখানে যাব পরে। প্রথম গন্তব্য মোড় থেকে ডান দিকে মাওয়ার বাজারের দিকে। এখানেই পদ্মা নদীর পাড়ে মাছের আড়ত। মূল সড়ক থেকে মাওয়া বাজারের মধ্য দিয়ে সরু রাস্তা চলে গেছে পদ্মা নদী পর্যন্ত। ভিড়ভাট্টা, গর্ত, কাদা ঠেলে পৌঁছাতে হয় মাছের আড়তে। শুরুতে আড়তে না ঢুকে যাওয়া হলো নদীর তীরে। সারি করে বেশ কিছু নৌকা বাঁধা ঘাটে। ছোট নৌকা আর ইঞ্জিনচালিত নৌকা। মাছ নামানো হচ্ছে। চিংড়ির নৌকা যেমন আছে, তেমনি ইলিশ ধরার নৌকা। জাল দেখে তা বুঝে নিতে হবে। পেছনে বিপুল পদ্মা, দূরে বিরাটাকার ক্রেন—পদ্মা সেতুর মহানির্মাণের জানান দিচ্ছে।

এই ইলিশের দাম হাঁকা হয়েছিল ছয় হাজার টাকা

জেলেরা নৌকা থেকে ইলিশ নামিয়ে আড়তের দিকে দিচ্ছেন দৌড়। দু-তিনটা নৌকায় তাজা চিংড়ি। বললাম, কেনা যাবে? কেনা যাবে। তবে দাম শুনে আগ্রহে ভাটা পড়ল। আড়তে ঢোকার আগে এক কাপ চা খেয়ে নেওয়া। চা-দোকানি জহিরুল ইসলাম বললেন, ‘পানি বাড়ছে, তাই মাছ ধরা পড়ছে কম। পদ্মার ইলিশ আরও কম।

 মেঘনা থেকেও আসছে ইলিশ।’

চলছে ইলিশ ভাজা

মাছের বাজারে

এবার আড়তে ঢোকার পালা। জেলেদের মাছ নিলাম হচ্ছে—যে বিক্রেতা বেশি দাম ডাকতে পারছেন, তিনি নিয়ে যাচ্ছেন খাঁচাভর্তি মাছ। অ্যালুমিনিয়ামের বড় থালায় থরে থরে সাজানো হচ্ছে সেই সব মাছ। রুপালি ইলিশগুলো ছড়াচ্ছে তাদের রূপের ছটা। শুক্রবার, ছুটির দিন। তাই ঢাকা থেকে অনেকেই এসেছেন মাওয়ার তাজা মাছ কিনতে। শুধু ইলিশ নয়, নদীর পাঙাশ, চিংড়ি, আইড়, রিঠা, বাইলা, টাটকিনি—নানা রকম মাছ। তবে সেদিন নদীর রুই-কাতলা, বোয়াল একটু কমই দেখা গেল।

তেরছা করে ইলিশ মাছ কাটার বিশেষ কৌশল দেখা যায় মাওয়ায়

মাওয়ার এই আড়তে ঢোকামাত্রই দু-একজন আপনার পেছনে পেছনে ঘুরতে থাকবেন। এমনভাবে কথা বলবেন, যেন আপনি নিত্যকার ক্রেতা। তাঁদের একজনকে সঙ্গে নেওয়া যায়। তবে কেনার ব্যাপারে সচেতনতা সবার আগে। মাওয়ায় কি শুধু নদীর টাটকা মাছই বিক্রি হয়? উত্তরটা নেতিবাচক। আড়তের সামনের দিকে কিছু দোকানে চাষের পাঙাশ, চাষের পাবদা, পুকুরের রুই-কাতলা, হিমাগারের ইলিশেরও বেচাকেনা চলে।

লেজ ভর্তা

মাছের দাম চাওয়া হবে ইচ্ছামতোই। দরদাম করতে হবে ভালোভাবে। আবার চাইলে ডাকে, মানে নিলামেও অংশ নেওয়া যায়। অভিজ্ঞতা বলে, এ কাজে না যাওয়াই ভালো। তবু ডাকের একটা জায়গায় দাঁড়ালাম, একের পর এক মাছবিক্রেতা দাম ডাকছেন, তারপর একজন কিনতে পারলেন। জানা গেল আড়তদারের কাছ থেকে কত দামে বিক্রেতা মাছ কিনলেন। এরপর চাইলে ওখানেই বিক্রেতার কাছ থেকে মাছ কেনা যায়, তিনি কিছু লাভে বিক্রি করতে পারেন। কত টাকা লাভ দিলেন, সে ব্যাপারে আপনার একটা স্বচ্ছ ধারণা থাকবে। মাঝারি আকারের এক হালি পদ্মার ইলিশের দাম ২ হাজার ৪০০ থেকে ৪ হাজার টাকা পর্যন্ত দেখা গেল। বড় ইলিশের হালি ৫-৬ হাজার থেকে ১০-১২ হাজার টাকা; এমনকি আরও বেশি দেখা গেল।

একটা টোটকা তথ্যও জানা গেল। বৃহস্পতি, শুক্র ও শনিবার মাছের দাম একটু বেশিই থাকে। শুক্র, শনিবার আর সরকারি ছুটির দিনগুলোতেও তাই। কারণ ‘অতিথি’ ক্রেতাদের আনাগোনা বেশি থাকে। আবার মাছের আমদানি কম হলে দাম চড়া—আর সেটা নির্ভর করে নদীর ওপর।

মাছ যত বড়ই হোক, মাওয়ার এই আড়তে সেটা কেটে নেওয়ার ব্যবস্থা আছে। এই সময়ে ইলিশসহ অন্যান্য মাছ বরফ দিয়ে আনাই বুদ্ধিমানের। ভোর পাঁচটার আগে যে আড়তের দৌড়ঝাপ, বিকিকিনি শুরু হয়, সেটা শেষ হয়ে যায় সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যেই। আটটার পর সেখানে শুধুই মাছের গন্ধ, আঁশ ইত্যাদি।

দ্মার ইলিশের টাটকা স্বাদ

মাওয়ায় গেলে ইলিশ না খেয়ে আসা যায় না। আড়তে গিয়েছিলাম মাওয়া মোড় থেকে ডান দিকে। মাওয়া মোড় থেকে বাঁ দিকে লৌহজংয়ের পথে কিছুদূর গিয়ে ডানে বাঁক নিলেই মাওয়া ফেরিঘাট আর লঞ্চঘাটের রাস্তা। এখানেই অনেকগুলো রেস্তোরাঁ। সবগুলোরই মূল আকর্ষণ ইলিশ। অন্য খাবার যে নেই তা নয়। এই দোকানগুলো দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে। সকালের সুবিধা হলো, তখন রেস্তোরাঁগুলোও আড়ত থেকে ইলিশ কিনে নিয়ে আসে। ডিপ ফ্রিজে রাখার আগে চাইলে সেগুলো ভেজে নেওয়া যায়। সামনেই কাটবে। আবার আগে কাটা টুকরাও থাকে।

তিন-চারটা দোকান দেখে একটা দোকান বেছে নেওয়া হলো এবার। বাড়িতেও ইলিশ ভাজা হয়, কিন্তু মাওয়ার ইলিশ ভাজার স্বাদই আলাদা। তাজা মাছ একটা কারণ। আরেকটা হলো মাছ কাটার পদ্ধতি। এখানে একটু তেরছা করে মাছের টুকরা কাটা হয়। এরপর তেল, মসলা, ভাজার পদ্ধতি তো আছেই। ইলিশের টুকরা, ডিম, মাথা ও লেজ ভাজি খাওয়া যায়। বছরখানেক হলো যুক্ত হয়েছে ‘ল্যাঞ্জা ভর্তা’। মানে ইলিশের লেজের ভর্তা। লেজটা ভেজে খুন্তি বা স্টিলের বড় চামচ দিয়ে গরম কড়াই বা তাওয়ার ওপরই খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মাছ আলাদা করা হয়। এরপর যতটুকু পারা যায় হাত দিয়ে কাঁটা বেছে বেশি করে পেঁয়াজ, মরিচ, লবণ, দিয়ে ভর্তাটা বানানো হয়। ইদানীং মাওয়ার দোকানগুলোতে গোটা ইলিশ ভাজিও পাওয়া যাচ্ছে।

চলছে মাছের বিকিকিনি

আড়তে যেমন দরদাম চলে ইলিশ কেনা নিয়ে, এখানেও তা চলে। খাোয়ার আগেই দাম করে নেওয়া ভালো। প্রতি টুকরা ইলিশ ভাজা ৮০, ৯০ বা ১০০ টাকা, ডিম ভাজা ১০০ টাকা (কয়েকটা কিনলে দাম একটু কম পড়ে), ১টা লেজ ভর্তা ৫০-৬০ টাকা (আগে বানানো ভর্তা ২০ টাকা করে), ইলিশের মাথা ও লেজ ভাজা ৭০ টাকা এবং গোটা ইলিশ ভাজা সাত-আট শ থেকে শুরু করে হাজার-বারো শ, দেড় হাজার টাকা। আকারের ওপর নির্ভর করে দাম।

খুব ভোরে মাওয়া যাওয়ার আনন্দই অন্য রকম। দিনের প্রথম আলো দেখতে দেখতে যাওয়া আর হাতে পদ্মার ইলিশের গন্ধ নিয়ে ফেরার স্মৃতি মনে গেঁথে থাকে অনেক দিন।