অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী
অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

ইলিশকথা ৩

মহামিলনের ইলিশ

কত কিছুরই তো কত নাম হয়। নানা নামে পরিচিতি পায়। কাজেই জলের মহারাজের নানা নাম হবে, তাতে আর আশ্চর্য কি। এই যেমন আমরাই ডাকি কত নামে। ইলিশ, চন্দনা, জাটকা, খয়রা; চট্টগ্রামের দিকে বলে চিটা। কুমিল্লা, নোয়াখালীতে আবার বিল্লি, খাল্লিশ, বাম, পাইটে, সকড়ি। নদী থেকে বিলে এসে কুল হারানো ইলিশ হয়ে যায় বিলিশ।

ওডিশার মানুষ বলে ইলিশি। আসামে সেটা আবার হিলসা। বিহারে ইলসা। মারাঠিদের কাছে পাল্লো। গুজরাটে স্ত্রী আর পুরুষ ইলিশকে পৃথক নামে ডাকা হয়। স্ত্রী মাছ মদেন আর পুরুষ মাছ পালওয়া। এই গুজরাটি ইলিশকে সাহিত্যিক তসলিমা নাসরিন বলেছেন ঘাসের মতো। কোনো স্বাদ নেই।  

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশের সিন্ধিদের কাছে ইলিশ পরম পছন্দের। ওরা বলে পাল্লা। পাকিস্তানে এই পাল্লা ধরার জন্য আছে বাংলাদেশের মৎস্যজীবীরা। করাচিতে একটা পল্লিই আছে। কিন্তু তারা যাপন করছে মানবেতর জীবন। নেই তাদের কোনো নাগরিক অধিকার।

উড়িয়াদের কাছে মাছ মানে ইলিশ। চাকরি মানে পুলিশ। তাই তো উড়িয়ারা ছড়া কাটে: মাছ খাইবি ইলিশি, চাকরি করিবি পোলিসি। এই প্রসঙ্গে আরও একটি ছড়ার কথা মনে আসে। এটাও সত্যেন বাবুর; তবে দত্ত নয়, ঠাকুর। এক সত্যেন বাবু ছড়া লিখতে পারলে আরেক সত্যেনবাবুই–বা বাদ যাবেন কেন। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ছড়া ইলশেগুঁড়ির কথা উল্লেখ করেছি। তবে এই সত্যেন্দ্রনাথ আবার ঠাকুর পরিবারের। রবিঠাকুরের বড় দাদা। বাংলার প্রথম আইসিএস। তিনি বোম্বে (হালের মুম্বাই) থাকতেন চাকরিসূত্রে। সিন্ধিদের ইলিশপ্রেমে মুগ্ধ হয়ে তিনি লেখেন: যব পাল্লা মাছলি খানা, তব সিন্ধ ছোড়কে নাহি জানা। সিন্ধিদের কাছে ইলিশ এতটাই প্রিয় যে জামাই এলে পাল্লা দিয়েই আপ্যায়ন করতে হবে। তারা মাছ টুকরা করে না। আস্ত রান্না করে। তবে ইলিশের চমৎকার আরও কিছু নাম আছে: জলতাপী, কাজলগৌরী, মুখপ্রিয়া ইত্যাদি।

জীমূতবাহন থেকে হ্যামিলটন সাহেব

ইলিশের বৈজ্ঞানিক নাম প্রথম দেন হ্যামিলটন বুকানন সাহেব। ১৮২২ সালে। তখন তিনি বঙ্গোপসাগরের মাছ নিয়ে গবেষণা করছিলেন। তাঁর দেওয়া নাম হিলসা ইলিশা। তবে ইলিশ নিয়ে কম ঘাঁটাঘাঁটি করেননি ওপার বাংলার লেখক দিগেন বর্মণ। তাঁর ছোট্ট একটি বইতে (ইলিশ পুরাণ) ধরা আছে আদ্যোপান্ত। সেখানে তিনি জানাচ্ছেন, দ্বাদশ শতাব্দীকে ইলিশ নাম দেন পণ্ডিত জীমূতবাহন। আবার সর্বানন্দের ‘টীকাসর্বস্ব’ গ্রন্থে রয়েছে ইল্লিষ-এর উল্লেখ। কবি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র বলেছেন ‘পাঙ্গাস ইলিশা’। পাঙ্গাস শব্দটি বৃহৎ বোঝাতে ব্যবহার করা হয়েছে।
আবার মোট পাঁচটি মাছকে নিরামিষ আখ্যায়িত করে নিরামিষভোজীদের সুবিধা করে দেন সেই সময়ের শাস্ত্রকারেরা। এই তালিকায় আছে ইলিশ, খলশে, ভেটকি, মাগুর আর রুই।

যত পদ

ইলিশের মাথা দিয়া সরিষা শাক কখনো কি খেয়ে দেখেছেন? দেখা যেতেই পারে। লখিন্দরকে কিন্তু এই পদ রান্না করে খাইয়েছিরেন তাঁর স্ত্রীর ভ্রাতৃবধূ তারকা। আবার এই বেহুলা-লখিন্দরের বিয়েতে কনেপক্ষ (বেহুলার বাবা) পাত্রপক্ষকে অন্ততপক্ষে পনেরো পদের মাছ দিয়ে আপ্যায়ন করেন। এই তালিকাতেও ছিল ইলিশ। পরিবেশিত হয়েছিল ভাজা ইলিশ।

ইলিশ কতভাবে যে রান্না করা যায়, তার ইয়ত্তা নেই। অন্তত পাঁচ শ পদ আছে ইলিশের। তবে যে যা–ই বলুক, সোয়াদ করে ইলিশের ঝোল রাঁধতে পারলে সেই বউও কিন্তু সোনাবউ হয়ে যায়। বিশ্বাস না হলে যোগীন্দ্রনাথ সরকারের ছড়াটা পড়ে নিতে পারেন: সোনা নাচে কোনা/ বলদ বাজায় ঢোল/ সোনার বউ রেঁধে রেখেছে/ ইলিশ মাছের ঝোল।
আহা ইলিশ!

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

ইলিশ নিয়ে লিখতে বসলে আমার আব্দুল মাঝির কাল্পনিক চেহারাটা চোখে ভাসে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আব্দুল মাঝি। রবীন্দ্রনাথ অনেক কিছু নিয়ে অনেক লিখেছেন। তবে ইলিশ নিয়ে তেমন নয়। যদিও ইলিশ তাঁর প্রিয়। খেতে এবং খাওয়াতে ভালোবাসতেন। ছেলেবেলার স্মৃতিচারণায় তিনি আব্দুল মাঝির অনবদ্য বর্ণনা দিয়েছেন: হালের কাছে আবদুল মাঝি, ছুঁচলো তার দাড়ি, গোঁফ তার কামানো, মাথা তার নেড়া। তাকে চিনি, সে দাদাকে এনে দিত পদ্মা থেকে ইলিশ মাছ আর কচ্ছপের ডিম।

রবীন্দ্রনাথ ও ইলিশ নিয়ে নাহয় পরে আরেক দফা আসা যাবে। আপাতত সেই অনামী বাঙালি কবির কথা বলি; যিনি ইলিশ নিয়ে সংস্কৃত প্রশস্তি গেয়েছিলেন কোনো এক কালে: ‘বায়ু বিশ্বকে ধারণ করে আছে, তার উপরে আছে কচ্ছপ, তার উপরে শেষনাগ, তার উপরে পৃথিবী, তার উপরে কৈলাস শৃঙ্গ, তার উপরে গঙ্গা আর তার উপরে “ইল্লিশ”। এই ইলিশ মৎস্যরাজ। এর মাহাত্ম্য সর্বজনবিদিত। এই ইলিশ ভক্ষণে সকল দুঃখ থেকে মুক্তি।’

কোনো সন্দেহ নেই, শত দুঃখে থাকা বাঙালির, ইলিশের নাম শুনলেই মন ভালো হয়ে যায়। আর খেতে পারলে তো কথাই নেই। অথচ এই ইলিশ বাদ দিয়ে রোহিত মৎস্য শাস্ত্রকারদের কাছে হয় কিনা মীনশ্রেষ্ঠ! এ জন্য তেমন উল্লেখ কোথাও সেভাবে দেখা যায় না ইলিশের। ১৭১১ সালে রামেশ্বর চক্রবর্তীর ‘শিবায়ন’-এ ইলিশের উল্লেখ যেন বুড়ি ছুঁয়ে যাওয়া। এরও এক শ দশ বছর বাদে রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে কাশীর গঙ্গায় ইলিশ পাওয়ার কথা জানা যায়।

ইলিশ

আরও সাত দশকের বেশি সময় পার করে, ১৮৯৭ সালের ‘কষ্টিপাথর’ নাটকে মেলে ইলিশের উল্লেখ। এরপর ব্রহ্মদেশ থেকে পারস্য উপসাগর—পানি কম গড়ায়নি। সেই থেকে এই ২০২০ পর্যন্ত প্রায় সোয়া শ বছরে ইলিশ মৎস্য মহারাজাধিরাজ হিসেবে মসনদে আসীন রয়েছে। স্থান পেয়েছে কবিতা, ছড়া, গল্প, লোকগান, প্রবাদ, প্রবচনে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’, প্রেমেন্দ্র মিত্রের ঘনাদা, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের গল্প, বুদ্ধদেব গুহর গল্প সংকলন, বুদ্ধদেব বসু, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, মোহাম্মদ রফিকের কবিতা তো আছেই। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীই–বা বাদ যাবেন কেন। তিনি ইলিশের বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছেন: সুলক্ষণ ইলিশ। মানে যে ইলিশের পেটে সদ্য ডিমের ছড় পড়েছে। আর সাহিত্যিক শংকর তো আবার ইলিশকে ব্রাহ্মণ বলেছেন। ইলিশের পিঠে যে দাগ থাকে, তাকে তিনি উপবীত বা পৈতের সঙ্গে তুলনা করেছেন।

তবে যা–ই বলি, প্রমথনাথ বিশীর ‘গঙ্গার ইলিশ’ গল্পটি কিন্তু সরস। ট্রামে উঠে ইলিশের সঠিক দাম না বলে বাজারে মারামারি বাধিয়ে দেওয়া আর গিন্নির কাছে ভালো সাজতে গিয়ে প্রতিবেশিনীদের ইলিশ কিনে দিয়ে নিজের পকেট থেকে গচ্চা দেওয়ার কাহিনিটা বেশ। তবে গুলজারের গল্প ‘ইলিশ’ অন্যতর দ্যোতনাবহ। কেন যেন পদ্মা নদীর মাঝির বর্ণনার আবেশ মেলে। ‘ইলিশ মাছেরা এবং বাবা’ যুক্তরাজ্যের সারের এক অভিবাসী বাঙালি পরিবারের গল্প। পরিযায়ী লেখক সালেহা চৌধুরীর লেখা। ছুঁয়ে যায়। ইলিশ মাছ নিয়ে সংকলন করেছেন মঈনুল হাসান ও মোজাফফর হোসেন ‘কল্পে গল্পে ইলিশ’। উল্লেখ্য, গল্প তিনটি সেখানেই পেয়েছি।

জামাই আপ্যায়নে সিন্ধিদের ইলিশ না হলে চলে না

রসরাজ অমৃতলাল বসু গানও লিখেছেন। সেখানে তিনি ইলিশের তেলকে কড লিভার অয়েলের সঙ্গে তুলনা করেছেন। এখন কিন্তু সেটা প্রমাণিতও হচ্ছে।
আবার রবীন্দ্রনাথে ফেরা যাক। ছাড়া লিখেছেন ইলিশ নিয়ে। উপমা হিসেবেও ব্যবহার করেছেন। একবার শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে এক ভোজ আসর আয়োজনের কথাও জানা যায়।

জনৈক বিদেশিনী তাঁর লেখা ‘আ ম্যারেজ টু ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে বাঙালি নারীর হাতের ইলিশ খেয়ে তাকে ‘আনপ্যারালালড হিলশা ফিশ কারি’ আখ্যা দিতে কুণ্ঠিত হননি।
১২৯২ সালে শ্রী বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায় প্রণীত ‘পাক প্রণালী’ গ্রন্থে মাত্র ইলিশের চারটি পদের উল্লেখ মেলে। এর একটি ইলিশ ভাতে (ভাপে নয়)।

বাজার করার ব্যাপারে নিজেকে আনাড়ি মনে করতেন বুদ্ধদেব বসু। দু–একবার যেতে হলেও ঠিকঠাক কিছুই আসত না। ফলে তাঁর স্ত্রী প্রতিভা বসুই সব সামলাতেন। তবে ৬৫ বছরে এসে সেই বুদ্ধদেব বসু কিনা রান্নাবান্না নিয়ে আস্ত একখানা বই-ই লিখে ফেললেন। ‘ভোজন শিল্পী বাঙালী’। এই বইয়ের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে তিনি ইলিশকে বিশেষায়িত করেছেন মীনসত্তম হিসেবে। চিতলের প্রসঙ্গ ধরে তিনি ইলিশে আসেন। চিতল মাছেন ‘মুঠিয়া’ তাঁর ভাষায়: বঙ্গসংস্কৃতির আনন্দ মেলায় পুব বাংলার এক বিশিষ্ট অবদান। এরপরেই তিনি লিখেছেন: আর সেই রজতবর্ণ মনোহরদর্শন মৎস্যকুলরাজ মহান ইলিশ।

বুদ্ধদেব বসুর রেসিপি: ইলিশের লেজ দিয়ে লাউ

তিনি মনে করতেন, সে এক দেহে এতটা প্রতিভা ধারণ করে যে শুধু তাকে দিয়েই তৈরি হতে পারে একটি পঞ্চপদী নানা স্বাদযুক্ত ভোজনের মতো ভোজন। আর পাঁচপদ কী এবং কীভাবে রেঁধে মধ্যাহ্নভোজ সারা যাবে, সেটাও যেমন বলেছেন, তেমনি দিয়েছেন কীভাবে কাটলে ইলিশ রান্না জমবে, সে পরামর্শও। তবে হ্যাঁ, ইলিশের ত্রিসীমানায় পেঁয়াজ আর আদাকে ঘেঁষতে দিতে তিনি নারাজ। আদায় যেমন কাঁচকলা নয়, তেমনি বুদ্ধদেব বাবুর কাছে আদায় ইলিশ নয়। এমনকি আলুও নৈব নৈব চ। তাঁর কথায়, ইলিশে আলু যোগ করা মহাপাতকের কাজ। তবে বুদ্ধবাবুকে প্রণিধান মেনে আমরাও তাঁর পঞ্চপদের চারটি আপনাদের জন্য আগেই পরিবেশন করেছি। পরখ করে দেখতে পারেন তাঁর ইলিশীয় মুনশিয়ানা।

আবার পর্তুগিজদের কল্যাণে এ দেশে আসা পেঁয়াজের ঝাঁজে এখন বাজার গরম। এই পেঁয়াজেই কিন্তু তফাত পূর্ব বাংলার কথাশিল্পী বুদ্ধদেব বসু আর ঠাকুরবাড়ির মেয়ে প্রজ্ঞাসুন্দরীর। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাতনি আবার ইলিশের স্বাদ খোলতাই করতে আদা আর পেঁয়াজ সঙ্গতে এক পায়ে খাড়া। ইলিশ মাছের ঝোল রান্নার যে প্রণালি প্রজ্ঞাদেবী বাতলেছেন, তাঁর আমিষ নিরামিষ গ্রন্থে, তাতে রয়েছে বিলাতি বেগুন বা তেমতি (টমেটো), সঙ্গে পেঁয়াজ, দুখানা তেজপাতা, ছয় গ্রাম আদা এবং ধনেশাক। বুদ্ধদেব বসু দেখলে নির্ঘাৎ অজ্ঞান হয়ে যেতেন। প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবীর ভাষায় ইলিশেররক্তই এর তেল। তাই মাছ ভালো করে ধুয়ে তবেই কাটতে হবে।

ইলিশ হবে অথচ বাবুদের কথা হবে না, তা কি হয়। কলকাতার বাবুরা বাইজি বাড়ি ঠেঙিয়ে ভোররাতে এসে ঘুমোতেন। তাই উঠতে উঠতে সূর্য হেলে যেত পশ্চিমে। আর তখন হতো তাদের নাশতা (প্রাতরাশ হয়ে যেত অপরাহ্নরাশ) ; কম করে পঁচিশ পদ দিয়ে। সেই তালিকায় থাকত ভাপা ইলিশ। এই গল্প বাংলা টপ্পার শেষ সলতে রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের।

সৈয়দ আলী আহসানের বর্ণনায় আছে গোয়ালন্দ স্টিমারঘাটের ইলিশ। সতীনাথ ভাদুড়ির জাগরিতেও উল্লেখ পাই। বাদ কেন দিই হালের সব্যসাচী শ্রীজাতকে। তাঁর ছড়া ‘ইলিশগীতিকা’র শুরুটাই যে মন মজাবে: ভোলা মন, ইলিশ নামের গুণটি গেয়ে যাই। প্রায় সমে এসে বলি ‘তের নদী’ সিনেমার কথা। যেখানে একটা দৃশ্য আছে ইলিশ নিয়ে। বারীন সাহা পরিচালিত এই ছায়াছবিতে ইলিশের ঝাঁকের দৃশ্য যোগ করে ইলিশের সঙ্গে বাঙালি-জীবনের অন্তর্লীন সম্পর্ককেই প্রতীয়মান করা হয়েছে। ভেবেছিলাম এখানে শেষ করে দেব। কিন্তু ইলিশ কীভাবে মহামিলনে অনুঘটক হয়েছে যে গল্প না বললে তো ষোলো আনাই মিছে। তাই একটু ধৈর্যচ্যুতি ঘটাচ্ছি।

মহামিলনের ইলিশ

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

বাংলা ও বাঙালির প্রিয় মাছ ইলিশ গঙ্গা কিংবা পদ্মার বাহন নয়। পদ্মার বাহন কী জানা যায় না। তবে গঙ্গার বাহন মকর। বরুণদেবের বাহনও। আবার পুরাণমতে বরুণদেবের বাহন ইলিশ। এই বরুণদেবের অবতার ঝুলেলাল। তাঁর বাহন ইলিশ। সিন্ধি হিন্দুদের ইষ্টদেবতা ঝুলেলাল। তাঁর জন্মগত নাম উদেরোলাল। আদর করে ওদেরোলালও বলা হয়। পাকিস্তানের সিন্ধের মাতিয়ারি জেলায় রয়েছে এই ঝুলেলালের মন্দির। মন্দিরের ভেতরে ইলিশ মাছের পিঠে পদ্মের আসরে উপবিষ্ট ঝুলেলালের মূর্তি আছে। এই মন্দিরে হিন্দু ও মুসলমান উভয়েই আসে। অন্যদিকে ভারতের গুজরাটে কচ্ছের নারায়ণ সরোবরে রয়েছে ঝুলেলালের আরেকটি মন্দির ঝুলেলাল তীর্থধাম।

ঝুলেলালের মন্দির

আমাদের কাছে ঝুলেলাল শব্দটি পরিচিতি পায় রুনা লায়লার কাওয়ালির কারণে: ‘দমাদম মস্ত কালান্দার...হো লাল মেরি পত রখিয়ো বলা ঝুলে লালন’। এই কাওয়ালি গাওয়া হয় সুফিসাধক লাল শাহবাজ কলন্দরের উদ্দেশে। নুসরাত ফতেহ আলীর কণ্ঠেও আমরা শুনি আরও একটি কাওয়ালি: সাখি লাল কালান্দার মাস্ত মাস্ত…ঝুলে লাল কালান্দার মাস্ত মাস্ত। শাহবাদ কালান্দারের আসল নাম সৈয়দ উসমান মারওয়ান্ডি। তাঁর অধিষ্ঠান সিন্ধু নদের ধারে, সেহওয়ানে। সিন্ধি মুসলমানদের পরম শ্রদ্ধেয়। যদিও জাতি–ধর্মনির্বিশেষে মানুষ আসে তাঁর দরগায় মুশকিল আসানের জন্য। শাহবাজ কালান্দারকে ঝুলেলাল বলা হয় তাঁর লাল পোশাকের জন্য। তবে মস্ত কালান্দার কাওয়ালির পরই তাঁকে ঝুলেলাল হিসেবে বিশেষ পরিচিতি দিয়েছে। আবার জনশ্রুতি আছে, উভয় ব্যক্তিই অভিন্ন। ওঁরা মুসলমান না হিন্দু—আদতে তা কারও জানা নেই। সহকর্মী সাদিয়া মাহজাবীন ইমামের কাছে এই কাহিনি শুনে অনুরণিত হয় লালন: সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে।

সেহওয়ানে লাল শাহবাজ কালান্দারের দরগা

লোককথার বরাত দিয়ে সাদিয়া আরও জানান, পলিমাটি অঞ্চল থেকে উজিয়ে পশ্চিমে যেতে যেতেই নাকি মাছের রং রুপালি হয়েছে। যদিও অন্য তথ্য বলছে: ‘সিন্ধুর বুড়ো জেলেরা বলেন, আরব সাগর থেকে মিঠে জলে ঢোকার সময়ে পাল্লার গা থাকে কুচকুচে কালো। উজান বেয়ে যত সে তার মুর্শিদের (গুরু) থানের দিকে এগোয়, তত বাড়তে থাকে তার জেল্লা। আরব সাগর থেকে খানিক পরে উঠলে হলদে পাথরে ছাওয়া লক্ষ পিরের কবরিস্তান থাট্টা। একটা সময় ছিল, যখন থাট্টার হলুদ পাথরে মাথা ছুঁইয়ে পাল্লার ঝাঁক এগোত উত্তরে। জামশোরো হয়ে সেহওয়ানে শাহবাজ কলন্দরের দরগায় মাতন দেখে উজানে, ঝুলেলালের সুক্কুরে গিয়ে যখন সে পৌঁছত, পাল্লার শরীর তখন রুপোয় মোড়া’ (সোমেশ ভট্টাচার্য, আনন্দবাজার, ২ জুলাই ২০১৭)।

বাঙালিদের মতোই সিন্ধিদের ইলিশ অনুরাগ বর্ণনাতীত। অবশ্য সেই অনুরাগ ছাপিয়ে আমাদের চিত্ত চমৎকৃত করে মহামিলনের কাহিনি। এরপর আর দ্বিধা কিংবা কুণ্ঠা থাকে না ইলিশকে মৎস্যকুলমণি আখ্যায়। (শেষ)

তথ্যঋণ:
ইলিশ পুরাণ, দিগেন বর্মণ
ভোজন শিল্পী বাঙালী, বুদ্ধদেব বসু
মছলিশ, আলপনা ঘোষ,
পাক-প্রণালী, বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায়
বাঙালি চার সহস্র বছরের খাদ্যাভ্যাস ও খাদ্যাচার: বিবর্তন ও অনুসন্ধান, শুভদীপ বোয়াল, সপ্তডিঙা, বিশ্বকর্মাপূজা সংখ্যা ২০১৯
ইলিশ ডিলিশ, সাগুফতা শারমিন তানিয়া