আমাদের দেশে যুগ যুগ ধরে মূলত সকালে নাশতার পরে দুই বেলা ভাতই খাওয়া হয় দুপুরে ও রাতের খাবার হিসেবে। তবে আজকাল পুষ্টিবিদেরা দিনে তিনবার পেট ঠেসে খাওয়ার বদলে ‘সিক্স স্মল মিলস’ বা দিনে ছয়বার অল্প অল্প করে স্বাস্থ্যসম্মত ও পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করার ব্যাপারে উৎসাহিত করছেন সবাইকে। এতে অতিভোজন যেমন এড়ানো যায়, দৈনিক কর্মশক্তি ও উদ্যমও আশ্চর্য রকমের বেড়ে যায়। তাই বিকেলে হালকা নাশতা খাওয়া এ দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। এ ছাড়া এমনিতেও বহু বছর ধরে আমাদের দেশে ঘরে ঘরে সব পরিবারেই কম-বেশি বিকেলে হালকা ও মুখরোচক কিছু খাওয়ার প্রচলন আছে।
কর্মক্ষেত্র থেকে ফিরে বেশ করে শর্ষের তেল, পেঁয়াজ-কাঁচা মরিচে মাখা মুড়ি-চানাচুরের বাটিটা দেখলে নিমেষেই সব ক্লান্তি উধাও হয়ে যায়। বিকেলে খেলাধুলা শেষে বাড়ি ফিরে মায়ের হাতের ডিম, সবজি দিয়ে রান্না ঝরঝরে নুডলস পেলে পড়তে বসতে গিয়ে আর ঘুম পেয়ে যায় না। ছুটির দিনে বিকেলে পরিবারের সবাই মিলে হইচই, হাসি-আড্ডায় ধোঁয়া ওঠা চায়ের সঙ্গে উড়িয়ে দেওয়া যায় প্লেটের পর প্লেট ফুলকপির বড়া, শিঙাড়া, বেগুনি, আলুর চপ ইত্যাদি। বিকেলের নাশতা মানেই এক অন্য রকম ভালো লাগা।
তবে আমাদের গ্রাম ও শহরে সব জায়গাতেই এখন কায়িক শ্রমের প্রবণতা কমে যাওয়া, প্রক্রিয়াজাত খাবার ও ফাস্ট ফুড গ্রহণের আগ্রহ বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি কারণে বিকেলের নাশতা যাতে স্বাস্থ্যকর হয়, সেদিকে বিশেষ মনোযোগী হতে হবে। নয়তো অতিরিক্ত স্থূলতা, হৃদ্রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিসের মতো প্রাণঘাতী রোগের ঝুঁকি থেকেই যাবে।
গৃহিণীরা যখন দৈনিক পরিকল্পনা করবেন যে কখন কী রান্না হবে, তখনই বিকেলের জলখাবারের ব্যাপারে প্রস্তুতি নিয়ে নিলে পরিবারের সবাইকে ঘরে তৈরি স্বাস্থ্যকর খাবার পরিবেশন করা সহজ হবে। মৌসুমি সবজি মিহি ঝুরি করে ভেজিটেবল রোলের পুর তৈরি করে নেওয়া যায়। স্যান্ডউইচের জন্য মুরগির মাংস, ডিম, শসা, গাজর ইত্যাদি পছন্দ অনুযায়ী কেটে কুটে বা সেদ্ধ করে প্রস্তুত করে রাখা যায়। শিঙাড়া, সমুচা, আলুর চপ ইত্যাদি আগে থেকে একসঙ্গে বানিয়ে জিপলক ব্যাগ বা মুখবন্ধ করা বাক্সে ফ্রোজেন করে রাখলে যখন ইচ্ছে ভেজে নেওয়া যায়।
তেলে ভাজা এমনতর বিকেলের নাশতা একেবারে রোজ রোজ অবশ্য খাওয়া উচিত নয়। আর খেয়াল রাখতে হবে যে ভাজার পরে সেই তেল যেন পুনরায় ব্যবহার না করা হয়। আবার তেলে ভাজা নাশতার সঙ্গে বেশ পরিমাণ টমেটো, শসা, পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচের সালাদ পরিবেশন করলে তা বিকেলের নাশতাকে সব মিলে স্বাস্থ্যকর করে তোলে। শিশু-কিশোর এবং উঠতি বয়সের তরুণদের বিকেলের নাশতায় প্রথম পছন্দই থাকে দোকানের বিভিন্ন ফাস্ট ফুড, যেমন পিৎজা, ফ্রাইড বা গ্রিল চিকেন, পাস্তা, বার্গার, শর্মা রোল, নাচোস ইত্যাদি। একটু কষ্ট হলেও বাড়িতে যদি এই খাবারগুলো বানিয়ে নেওয়া যায়, তবে সাশ্রয় তো হবেই, সেই সঙ্গে তা হবে অনেক স্বাস্থ্যসম্মত।
আজকাল ভিডিও সাইটগুলোতে অনেক বিস্তারিত রেসিপি পাওয়া যায় এই জনপ্রিয় ফাস্ট ফুডগুলো ঘরে তৈরি করার জন্য। এগুলো বানানোর জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণও এখন অনেক সুলভ ও সহজলভ্য আমাদের দেশে। মোজারেল্লা চিজ আর ইস্ট কিনে নিয়ে নিজেদের পছন্দমতো পিৎজা ঘরে বানালে তাতে স্বাদ আর পুষ্টি দুই-ই নিশ্চিত করা যায় ষোলোআনা। আর ছুটির দিনে পরিবারের সবাইকে বিশেষত শিশুদের নিয়ে এই ঘরোয়া পিৎজা উৎসব আমাদের অনন্য এক আনন্দ দিতে পারে। আবার মজার ব্যাপার হলো, ঘরে বানানো বার্গারের প্যাটিতে নির্দ্বিধায় গ্রেট করা সবজি মিলিয়ে নেওয়া যায়, মেয়োনিজের বদলে ব্যবহার করা যায় পানি ঝরানো টক দই, ফ্রাইড চিকেনের জন্য বেছে নেওয়া যায় স্বাস্থ্যসম্মত নিরাপদ ব্রয়লার। এই ছোট ব্যাপারগুলোই কিন্তু পরিবারের স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আমাদের একেবারে দেশি খাবারগুলো কিন্তু যথেষ্ট স্বাস্থ্যসম্মত বিকেলের নাশতায়। হাতে ভাজা মুড়ি, খাঁটি ঘানি ভাঙা শর্ষের তেল, পেঁয়াজ-কাঁচা মরিচ-পুদিনা-টমেটো-ধনেপাতা-লেবুর খোসার সঙ্গে চানাচুরের বদলে সেদ্ধ বা কাঁচা ছোলা, সেদ্ধ ডাবলি বুটের ঘুগনি, অঙ্কুরিত খোসাসুদ্ধ ছোলা বা মুগ-মসুরের ডাল ইত্যাদি মেখে নিলে তা হয় খুবই স্বাস্থ্যকর একটি খাবার।
হারিয়ে যাওয়া দেশি খাবার, যেমন পয়রা, যব, ছোলা ইত্যাদি চূর্ণ করে বানানো ছাতু, গুড় আর দেশি কলা দুধে মেখে ডিমের আকার দিয়ে বা বল বানিয়ে শিশুদের সহজেই আকৃষ্ট করা যায়। কাউনের চালের পায়েস, পানিতে ভিজিয়ে ঝরিয়ে হালকা লবণ দিয়ে শুকনো খোলায় টেলে নেওয়া লাল চিড়া, দুধে মিশিয়ে খই, মুড়ির মোয়া, শুকনো তাওয়ায় করা গমের চাপটি বা কলাই রুটি—এসব সম্পূর্ণ দেশজ খাবারকে আমাদের প্রাধান্য দেওয়া উচিত বিকেলের নাশতায়।
অনন্য পুষ্টিগুণসম্পন্ন এই খাবারগুলো তথাকথিত হেলথ ফুড, যেমন প্রক্রিয়াজাত ইনস্ট্যান্ট ওটস, কর্নফ্লেক্স, ক্র্যাকার, পপকর্ন ইত্যাদি থেকে অনেক কম খরচে পেট ভরায়। এগুলোর পাশাপাশি বিভিন্ন আঞ্চলিক পিঠা, যেমন তালের পিঠা, চিতই পিঠা, ভাপা পিঠা, ম্যারা পিঠা, নুনগড়া পিঠা, ভাপা পুলি ইত্যাদি বিকেলের নাশতায় রাখলে দেশীয় ঐতিহ্যের প্রতিফলন ঘটবে আমাদের প্রাত্যহিক খাদ্যাভ্যাসের মধ্য দিয়ে।
সবজিতে রঙিন হোক বিকেলের খাবার
বিকেলের খাবারের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সবজির অন্তর্ভুক্তি। উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ‘ফাইভ এ ডে’ নামে একটি ক্যাম্পেইন আছে, যেখানে সারা দিনে অন্তত পাঁচ ধরনের ফল বা সবজিজাতীয় খাবার খাওয়া নিশ্চিত করা হয় পরিবারের সবার জন্য। তবে এটি মনে রাখা দরকার যে দুপুরের পর আর ফল খাওয়া উচিত নয়। তাই ফল যা খাওয়ার তা খেতে হবে সকাল থেকে দুপুরের মধ্যে। আমাদের দেশে যেভাবে সুলভে প্রতি মৌসুমে হরেক রকমের ফল পাওয়া যায়, তা অনেক দেশেই অকল্পনীয় একটি ব্যাপার। শীতে কমলা, কুল, বরই অথবা গরমে আম, লিচু, কাঁঠাল, জাম, তরমুজ, বাঙ্গি আর বর্ষায় আনারস, জামরুল, জাম্বুরা, আমড়ার পাশাপাশি সারা বছরই আমাদের দেশে পাওয়া যায় পেয়ারা, পেঁপে, কলা এবং আরও বহু ফল।
সামান্য বিটলবণ বা লবণ-মরিচ দিয়ে হোক, আর এমনি এমনিই হোক, হালকা খাবার হিসেবে ফলের কোনো তুলনা নেই। জাম, বরই, জাম্বুরা, কাঁচা-পাকা আম—এসব দিয়ে তৈরি করা যায় জিবে জল আনা ভর্তা। ফ্রুট সালাদ বা টক দইয়ে মেখে ফলের চাট তৈরি করে নিলেও কিন্তু বিকেলের নাশতায় খুব মজা লাগে খেতে। সেই সঙ্গে দুধ বা দই সহকারে বা এমনিই স্মুদি বা জুস তৈরি করে খাওয়া যায় ফল। বিকেলের নাশতায় সবজির সালাদে কাবুলি ছোলা, রাজমা, পনির কুচি, সিদ্ধ বা গ্রিল করা মুরগির মাংস, ডিম সেদ্ধ ইত্যাদি মেশালে এই একটি খাবারেই সম্পূর্ণ পুষ্টি নিশ্চিত হবে। এ ছাড়া সব পদের সবজি মিশিয়ে অত্যন্ত সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যকর ভেজিটেবল স্যুপ বানানো যায়। ভেজিটেবল কাটলেট, সবজির বড়া ইত্যাদিও ভালো লাগে বিকেলের হালকা খাবারে।
বিকেলের খাবার আমাদের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিন্তু অনেক সময় আমরা এ সময়ে ক্ষুধার মুখে ঝটপট কিছু খেতে গিয়ে অনেক অস্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে ফেলি। একটু সচেতন থাকলে ছোট ছোট পরিবর্তন আনার মাধ্যমে আমরা বিকেলের জলখাবারে একই সঙ্গে স্বাদ ও স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে পারি।
ইনস্ট্যান্ট নুডলসের বদলে সেই আগের দিনের মতো ময়দার সাদা নুডলস বা পারলে হাতে তৈরি আটার নুডলস ব্যবহার করা যায়। বাড়িতেই চটপটি, ফুচকা, তেঁতুলের টক বানিয়ে নিয়ে মহাসমারোহে পরিবারের সবাই মিলে বিকেলে খাওয়া যায়। ভাজাপোড়ার বদলে ঘরে বেক করা বা গ্রিল করা খাবার খাওয়া ভালো। সবজির বড়া বা পাকোড়ার বদলে বিনা তেলে প্যানকেক বা ভাপ দিয়ে স্টিমড মোমো তৈরি করা যায় বিকেলের নাশতার জন্য। তবে সব সময় বয়স ও স্বাস্থ্যের অবস্থা বিবেচনা করে বিকেলের খাবার নির্বাচন করা উচিত। ডায়াবেটিসের রোগীদের জন্য মিষ্টি খাবার বা কিডনির রোগীদের জন্য বেশি আমিষসমৃদ্ধ খাবার না রাখাই ভালো। আবার বাড়ির বয়স্ক বা ছোট সদস্যদের সঠিক পুষ্টির ব্যাপারটিও খেয়াল রাখা দরকার। বিকেলে চায়ের সঙ্গে এভাবে একটু পরিকল্পনামাফিক মজাদার সব বৈচিত্র্যময় ও স্বাস্থ্যকর ‘টা’র সংযোজন আমাদের আটপৌরে জীবনে আনতে পারে জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টির সঙ্গে সঙ্গে ইন্দ্রিয় তৃপ্তিকর তুষ্টির ছোঁয়া।