আমাদের সকালগুলো শুরু হতো কাঁথার উষ্ণতায়। সীমাহীন আলস্য ঘিরে থাকত সেই ওমের ভেতর। টেনেহিঁচড়ে যখন আমাদের তোলা হতো, কুয়াশার চাদরে ঢাকা সূর্যরশ্মি আলগোছে এসে পড়ত আমাদের গায়। সে এক সন্দিগ্ধ সন্ধিক্ষণ! হিম হিম শীতের সকালে ঘুম জড়ানো চোখে বাইরে ছুট দেব, নাকি চাদর মুড়ি দিয়ে বাবু হয়ে পড়তে বসব, সে সিদ্ধান্ত নিতেই সন্দিহান হয়ে যেতাম। তারপর মেরেকেটে ঘণ্টাখানেক পড়ে স্কুলে যাওয়ার সময় এগিয়ে আসত ক্রমশ। এ সময়টাই ছিল সবচেয়ে রোমাঞ্চকর। বারান্দার খোলা রোদে পিঠ পেতে বসে নতুন পেঁয়াজের মিশেলে নতুন আলুর ভর্তা দিয়ে নতুন চালের গরম ভাত খাওয়ার সেই রোমাঞ্চকর মুহূর্তগুলো এখন ভেসে বেড়ায় হালকা কুয়াশার মতো।
কুয়াশাই বটে। ২০০ টাকা কেজির পেঁয়াজ যে পরিমাণ ‘হট’, তাতে শীতের বিকেলে ঝুলে থাকা কুয়াশা তো বটেই, শ্রাবণের ঘন কালো মেঘও পাতলা হয়ে হালকা কুয়াশায় পরিণত হবে। ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত। আমার বয়স যত বাড়ছে, খেয়াল করে দেখছি, আনাজপাতির দামও ততই বাড়ছে। পেঁয়াজের কেজি ২০০ টাকায় কিনে খেতে হচ্ছে! এর আগে ধনেপাতা কিনে খেতে হয়েছে ৪০০ টাকা কেজি। এখন নতুন আলুর দাম চলছে ১২৫ টাকা, কাঠি নাল বা গোল লাল আলুর দাম ৪৫ টাকা আর হল্যান্ড আলুর দাম ২৫ টাকা কেজি। আদার ব্যাপারীরা এখন অনায়াসে জাহাজের খবর নিতেই পারেন। চালের দাম আপনারা সবাই জানেন। দেশি মাছের দাম এখন মোটামুটি সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। খেয়াল করে দেখবেন, মাছ যত ছোট, দাম তার তত বেশি। এ জন্যই হয়তো আমাদের পূর্বপুরুষেরা প্রবাদ তৈরি করেছিলেন—ধানি মরিচের ঝাল বেশি। আর কে না জানে, ধানি মরিচ আকৃতির দিক থেকে ধানের চেয়ে একটু বড়—আড়াই শ গ্রাম ২৫ টাকা মানে ১০০ টাকা কেজি দিয়ে যে কাঁচা মরিচ কিনি আমরা, ধানি মরিচ সেই মরিচের একেবারে ডগার সমান।
ধুরো, কিসের মধ্যে কী, পান্তাভাতে ঘি! বলছিলাম পেঁয়াজের কথা… জনাব, ঘি খান আর না-ই খান, পান্তাভাত পেঁয়াজ ছাড়া জমে না। ২০০ টাকার ধাক্কায় পান্তাভাতের ‘কালচার’ নষ্ট হয়ে যেতে বসেছে আজকাল। বাসি তরকারি দিয়ে, শুধু নুন-তেল-কাঁচা মরিচ দিয়ে মাঝেমধ্যেই পান্তা খেতে হচ্ছে কিছুদিন থেকে। একজন খাঁটি বাঙালির কাছে এভাবে পান্তা খাওয়া ‘অসংস্কৃত’ চর্চা নয়, বলুন? একবার খেয়াল করে দেখেছেন, আপনার প্রিয় গরম শিঙাড়ার সঙ্গে এখন মরিচ এলেও পেঁয়াজ আসছে না। আসছে পেঁপেকুচি! মাংসের হাঁড়িতে পরিমাণের অর্ধেক হয়ে গেছে পেঁয়াজ। ফলে মাংসের স্বাদ না বাড়লেও বাড়ছে দাম্পত্য কলহ। মসুর ডালের সম্ভার থেকে ইতিমধ্যে পেঁয়াজ উধাও হয়েছে। এ কারণে সম্ভারের ‘ছ্যাঁৎ’ শব্দ তার আভিজাত্য হারিয়ে ফেলেছে। ফলে প্রতিবেশীর নাকে সুড়সুড়ি লাগছে না এখন। স্কয়ার ফিটের হিসেবে ঘরসংসার করা এই শহরে প্রতিবেশীর সঙ্গে ডালের সম্ভারের ঝাঁজালো গন্ধের মাধ্যমে যে দূরবর্তী যোগাযোগটা ছিল, সেটাও এখন আর হচ্ছে না। শুক্কুরবারের ছুটির দিনে নরম রোদে পিঠ পেতে পেঁয়াজ মেখে মুড়ি খাব, সঙ্গে গরম চা, সে কি আর হবে? কিংবা শনিবারের দুপুরে গ্রেভিকে হেভি করার জন্য বেশি করে পেঁয়াজ দিয়ে মাংস কষা? তা সে বিফ হোক, মাটন হোক কিংবা কিচেনের হাতের পাঁচ চিকেন? স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, পরি উড়ে যাচ্ছে আর কল্পনা পড়ে থাকছে। ভেবে দেখুন, কতটা সংস্কৃতিহীনতার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে আমাদের মাত্র ২০০ টাকার জন্য! পেঁয়াজ যখন বাঙালির সমৃদ্ধ খাদ্যবিলাসকে ম্রিয়মাণ করে দিয়ে অসংস্কৃত চর্চার দিকে ঠেলে দিচ্ছে, ঠিক তখন তপন রায়চৌধুরীকে মনে পড়ছে। তিনি নাকি পেঁয়াজের পায়েস খেয়েছিলেন! আর সে পায়েসের স্বাদ ছিল স্বর্গীয়। ‘আমি শুনে হাসি, আঁখি জলে ভাসি’—এখন আসতেন মোগো দ্যাশে!