ছবি: প্রথম আলো
ছবি: প্রথম আলো

পণ্ডিতের ভিটা অথবা ইলিশের ভর্তা

রাস্তাটা একেবারে নাক বরাবর এবং সুদৃশ্য। ঢাকা শহরের জ্যাম কাটিয়ে কোনোমতে মেয়র হানিফ উড়ালসেতুতে উঠলে হাঁপ ছেড়ে বাঁচবেন। তারপর ঝাঁ–চকচকে রাস্তায় প্রায় পৌনে এক ঘণ্টার যাত্রা। সে রাস্তা ধরে বেশ কিছুটা এগিয়ে বাঁয়ে ঢুকে গেলে বজ্রযোগিনী গ্রাম, পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্করের ভিটেবাড়ি। পাণ্ডিত্যে তাঁর বিশ্বজোড়া পরিচিতি থাকলেও আমার কাছে তিনি চা পান করা প্রথম বাঙালি হিসেবেই পরিচিত। চীন দেশের কল্যাণে চায়ের সঙ্গে আত্মোৎসর্গের একটা সম্পর্ক আছে। যদি আত্মা আর বুদ্ধির মুক্তি চান তাহলে বামপন্থী হয়ে যেতে পারেন পণ্ডিতের ভিটেবাড়িতে। আর যদি স্বাদকোরকে অনুরণন তুলতে চান তাহলে রাস্তাটা সোজা। ডানে-বাঁয়ে না গিয়ে চলতে চলতে পদ্মা নদী যেখানে আপনার গতি রোধ করবে, আপনার গন্তব্য সেখানেই। সবাই তাকে মাওয়া ঘাট বলে চেনে।

সেখানে কোনো গাছ নেই, অশ্বত্থ তো নেই-ই। মহামতি বুদ্ধ অশ্বত্থের তলে বসে বুদ্ধত্ব লাভ করেছিলেন। আর মাওয়া ঘাটে আপনার স্বাদ কোরকের ইহলৌকিক মুক্তি ঘটবে রেস্তোরাঁর চেয়ার দখল করে তাতে বসতে পারলে। দখলই বৈকি। প্রচুর মানুষ গিজগিজ করে সেখানে সারা বছর। এই করোনাকালে কিছুটা আড়ষ্টতা থাকলেও ইলিশের স্বাদ নিতে আসা মানুষের কমতি নেই মাওয়া ঘাটে। ঘাট পার হয়ে দক্ষিণে যাওয়ার যাত্রীরা তো আছেনই। আছেন শুধু মাওয়ায় ইলিশ খেতে যাওয়া মানুষও। সব মিলিয়ে শত শত মানুষ, আক্ষরিক অর্থে। এই শত শত মানুষের মধ্য থেকে রেস্তোরাঁর একটি চেয়ার দখল করা কোনো অর্থেই সহজ কাজ নয়। জুতমতো একটা চেয়ার-টেবিল দখল করে এবার একটু হাত-মুখ ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে বসে পড়ুন। মাস্ক সরিয়ে নিয়ে নাকে লাগতে দিন ভাজা ইলিশের গন্ধ। তাতে আপনার ক্ষুধা কিছুটা বাড়বে।

মাস্ক সরিয়ে নিয়ে নাকে লাগতে দিন ভাজা ইলিশের গন্ধ। তাতে আপনার ক্ষুধা কিছুটা বাড়বে

কী খাবেন মাওয়া ঘাটে? মাংস পাবেন খুব কম। পাবেন পাঙাশ, রুই, চিংড়ি, কাতলা, বেলে, কাঁচকি ইত্যাদি তাজা মাছের বিভিন্ন ধরনের রান্না। তবে মাওয়া ঘাটে মানুষ ইলিশ খেতেই যায়। ইলিশের ভাজা, ইলিশের বিভিন্ন পদ, ইলিশের ভর্তা। হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন আপনি, ইলিশের ভর্তা। ভর্তাপ্রিয় বাঙালির রসনাবিলাসের জগতে একেবারে ভিন্ন একটা খাবার। আজ বরং ইলিশের ভর্তা নিয়ে কথা হোক। অবশ্য সে প্রসঙ্গে আসার আগে আর কিছু প্রয়োজনীয় কথা সেরে নেওয়া যাক।

ইলিশ চেনেন তো ঠিকমতো? চিনলে ভালো। না চিনলে ইলিশপ্রেমী হিসেবে আশাহতও হতে পারেন। মনে রাখবেন, মাওয়া একটা ঘাট। এখানকার সবকিছুই নদীর জলের মতোই ভাসমান। মানুষও। কাজেই আপনার চিরকালীন অভ্যাস ‘মামা, এক পিস ইলিশ’ বলে রেস্তোরাঁয় ইলিশ খাওয়ার সহজিয়া তরিকা সেখানে চলবে না। বুঝেশুনে নিতে হবে, দেখেশুনে খেতে হবে। মাওয়ায় ইলিশ খাওয়ার প্রথম ধাপ, আসল ইলিশ বেছে নেওয়া। থরে থরে সাজানো থার্মকলের বাক্সে বরফ দেওয়া ইলিশ থাকে প্রতিটি রেস্তোরাঁয়। যদি সংখ্যায় বেশি থাকেন, মানে পাঁচ-সাতজন বা তারও বেশি মানুষ থাকেন, তাহলে আস্ত ইলিশ দরদাম করে কিনে ফেলুন রেস্তোরাঁতেই। তারপর বলুন কী খাবেন—ভাজা নাকি ভর্তা। মাওয়ায় সাধারণত ভর্তা আর ভাজাই খাওয়া হয়। তবে চাইলে একটু বেশি সময় থাকলে আর যারা খাবার তৈরি করে দেয় রেস্তোরাঁর সেই লোকজনের সঙ্গে খাতির করে ফেলতে পারলে, যা ইচ্ছা তা–ই খেতে পারবেন। আর যদি সংখ্যায় কম মানুষ থাকেন তাহলে পিস হিসেবে ইলিশ কিনুন দরদাম করে। তারপর তাদের বলুন কী খাবেন।

ভাজা ইলিশ আর মচমচে করে ভাজা একটা শুকনো মরিচ আপনার স্বাদকোরকের ভূগোল বদলে দেবে

গোয়ালন্দ ঘাটের সেই গল্পটা শুনেছেন তো। সেখানে নাকি স্টিমার ঘাটে খেতে গেলে অনেক যত্ন করে বসানো হতো দোকানে পাতা বেঞ্চে। তারপর তাড়াহুড়ো করে থাল-জল পেতে দেওয়া হতো। কিন্তু খাবার দিতে গড়িমসি করা হতো ইচ্ছা করেই। স্টিমারের ভোঁ যখন বাজত তখন খাবার দেওয়ার তোড়জোড় শুরু হতো। হাতে-মুখে জল দিয়ে বুভুক্ষু যাত্রীরা যখন খাওয়া শুরু করবেন তখন ক্যাশ কাউন্টার থেকে তাঁদের বারবার মনে করিয়ে দেওয়া হতো, স্টিমার ছেড়ে গেল কিন্তু। যাত্রীদের স্টিমার ধরার তাড়া থাকত বলে তারা খেতে পারত না। ফলে টাকাটা গচ্চা যেত স্টিমার ধরার তাড়ায়। সেই খাবারই পরে পরিপাটি হয়ে আর একজন যাত্রীর পাতে আসত ফিরে। যারা একটু অভিজ্ঞ যাত্রী তারা ধীরেসুস্থে পেট পুরে খেয়ে পরের স্টিমার ধরত। মাওয়া ঘাটে সে রকম অবস্থা নেই। তবে তাড়াটা ঠিকই আছে। সব দিক থেকে আপনার ওপর চাপ দেওয়া শুরু হবে দ্রুত খাওয়া শেষ করে জায়গাটা খালি করার জন্য। কারণ, ততক্ষণে আরও কিছু মানুষ আপনার দখল করা চেয়ার-টেবিলের দখল নিতে দাঁড়িয়ে গেছে। কিন্তু ইলিশ বলে কথা। আপনি ধীরে–সুস্থে খেয়ে তারপরেই উঠুন।

কী খাবেন, সেটা আগেই বলেছি। খাবেন ধবধবে সাদা ভাত আর ইলিশ—সেটা ভাজাও হতে পারে, ভর্তাও হতে পারে কিংবা শর্ষে ইলিশও হতে পারে। ভাজা কিংবা ভাপা অথবা শর্ষে ইলিশ নিয়ে আপনি নিজেই জানেন অনেক কিছু। তাই ভর্তার কথাই বলি।

প্রায় সবাই মনে করেন যে ইলিশের ভর্তা হয় শুধু লেজের। ব্যাপারটা সে রকম নয়

প্রায় সবাই মনে করেন যে ইলিশের ভর্তা হয় শুধু লেজের। ব্যাপারটা সে রকম নয়। আপনি মাছের যেকোনো অংশ দিয়েই ভর্তা খেতে পারেন। যদি আস্ত ইলিশ কেনেন, তাহলে লেজ এবং মাথা দিয়ে ভর্তা খেতে পারেন। কারণ, তাতে নিজেদের মধ্য ইলিশ ভাগাভাগি করতে সমস্যাটা কম হবে। আর ইলিশ খেতে গিয়ে কে নিজের ভাগ নিয়ে উদারতা দেখাতে চায় বলুন। যদি দু–একজন থাকেন বা সংখ্যায় কম থাকেন তাহলে পছন্দমতো ইলিশের পিস কিনে সেটা দিয়ে ভর্তা বানাতে বলুন। ইলিশভর্তার রেসিপিটা খুব সহজ। বলে দিলে বাড়িতেও আপনি বানাতে পারবেন অনায়াসে।

ইলিশের ভর্তা

লেজ কিংবা টুকরো যা–ই হোক না কেন, প্রথমে সেটা ভেজে নিন। তারপর মিহি করে পিষে কাঁটা ছাড়িয়ে নিন। কাঁটা মোটামুটি সরিয়ে নেওয়া হলে হালকা করে সরষের তেল দিন। তাতে একটা আলাদা ঘ্রাণ তৈরি হবে। এরপর একে একে যোগ করুন শুকনো মরিচের গুঁড়া আর সরষের তেল দিয়ে বানানো মিশ্রণ, স্বাদমতো লবণ, পেঁয়াজকুচি। চাইলে হালকা ধনেপাতাও যোগ করতে পারেন। তবে কাঁচা মরিচ নয়। মিহি করে রাখা ইলিশের সঙ্গে এই উপাদানগুলো মিশিয়ে হাত দিয়ে আর একবার দলাইমালাই করে নিন। ব্যস, তৈরি হয়ে গেল আপনার ইলিশভর্তা।

তবে একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, যখন ভর্তা করছেন তখন আপনি ইলিশের প্রকৃত স্বাদ পাবেন না। ভর্তার চিরকালীন বিষয় হলো, প্রকৃত উপকরণের স্বাদকে ভেঙে দিয়ে একটু ভিন্ন দিকে সেটা বাড়িয়ে তোলা। ঠিকমতো আলুভর্তা বানালে যেমন আলুর প্রকৃত স্বাদ উড়ে যায়। ইলিশের ক্ষেত্রেও সেটাই হবে। তবে একেবারে ভিন্ন একটা স্বাদের ইলিশ খেতে পারবেন ভর্তা করলে।

মাওয়া ঘাটের ট্রেডমার্ক খাবার

ইলিশের ভর্তা, ভাজা, ডিম, এক চাকা বেগুনভাজা, সাদা ধবধবে ভাত আর মচমচে করে ভাজা একটা শুকনো মরিচ—মাওয়া ঘাটের ট্রেডমার্ক খাবার এটাই। খাওয়া শেষ করে খোঁজ করবেন হোসেন মিয়ার। তিনি কুলফি বিক্রি করেন ঘাটেই। গুরু ভোজনের পর একটা ঠান্ডা ঠান্ডা কুল কুল ডাবল সাইজের কুলফি খেয়ে নিন আয়েশ করে। দুধের সঙ্গে কিশমিশ আর এলাচি দেওয়া সে রকম কুলফি ঢাকা শহরে বা কুষ্টিয়ার বাইরে আপনি আর খাননি কখনো। তারপর চাইলে বজ্রযোগিনী গ্রামে পণ্ডিতের ভিটায়ও যেতে পারেন অথবা ফিরতে পারেন আপন আলয়। ইচ্ছেটা আপনার।