সবুজ প্রকৃতিকেই ভোরে জলরঙে আঁকা ছবি মনে হতো। হেমন্তের সেই ভোরে মেঠোপথে হাঁটতে গেলে ভিজে যেত হাওয়াই চপ্পল। পা পিছলে দুই পা এগোলাম তো পিছিয়ে যেত এক পা। এমন ভোরে একদল লোক চলেন কাস্তে হাতে মাঠের দিকে। যেদিকে ভোরের আলো পড়ে, চকচক করে সোনালি ধান। বাড়িতে মা-চাচিদের সঙ্গে ব্যস্ততা বাড়ত সহকারীদেরও।
গোবরে লেপা উঠানের একদিকে বড় টিনের পাত্রে জ্বাল হতো সদ্য মাড়াই করা ধান। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির চেনা পরিবেশ আরও পাল্টে যেত। কেউ ধান মাড়াই করছেন, উঠানে এনে কেউ তা ঢালছেন। পায়ে ঠেলে বৃত্তাকারভাবে ছড়াচ্ছে আরেক দল, দূর থেকে এই ধান দেখতে অনেকটা সোনালি কার্পেটের মতো।
শুকানো ধান থেকে পাওয়া আতপ চাল নিয়ে বাড়ি বাড়ি চলত আরেক উৎসব। ঢেঁকির পাড়ে সেই চাল থেকে পাওয়া যায় ধবধবে সাদা চালের গুঁড়া। এই গুঁড়া থেকেই বাড়ি বাড়ি তৈরি হতে থাকে ভাপা, চিতই, পুলি, মালপোয়া আর নাম না জানা হরেক রকম নকশি পিঠা। নিজেদের খাওয়ার পাশাপাশি অতিথি আপ্যায়নে এটাই মোক্ষম সময়।
অগ্রহায়ণ মাসজুড়ে গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে এই দৃশ্য চোখ জুড়ানোর মতো। আবহমান কাল থেকে নতুন ধানের এই উৎসব চলতে থাকে হেমন্ত থেকে শীতকালজুড়ে।
অগ্রহায়ণ মাসটা তাই নবান্ন উৎসবের সময়। শহুরে জীবনেও বেশ কয়েক বছর ধরে আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করা হয় নবান্ন উৎসব। জাতীয় নবান্ন উৎসব উদযাপন পর্ষদ, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিসহ বেশ কয়েকটি খাবার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান রাজধানীতে অগ্রহায়ণ মাসে নবান্ন উৎসবের আয়োজন করে। সেখানে শহুরে আবহে বেড়ে ওঠা তরুণেরা আসেন আগ্রহভরে। কেউ আসেন বন্ধুদের সঙ্গে দল বেঁধে, কেউ পরিবার নিয়ে। এমনই একটি আয়োজনে ২০১৯ সালে কথা হয়েছিল বেশ কয়েকজন তরুণ-তরুণীর সঙ্গে। ঢাকার লালমাটিয়া থেকে আসা এক দম্পতি জানিয়েছিলেন, শহরে জন্ম হওয়া তাঁদের সন্তানেরা নবান্ন উৎসব সম্বন্ধে খুব একটা জানত না। তাই কয়েক বছর ধরে নিয়মিত তাঁরা সন্তানদের নবান্ন ও পৌষ উৎসবে নিয়ে আসেন। দেখানোর চেষ্টা করেন গ্রামীণ সেই ঐতিহ্য।
জাতীয় নবান্ন উৎসব উদযাপন পর্ষদ ১৪০৬ বঙ্গাব্দ থেকে নিয়মিত ঢাকায় নবান্ন উৎসব উদযাপন করে আসছে। এক দশকের বেশি সময় ধরে তারা উৎসবের দিন হিসেবে বেছে নেয় ১ অগ্রহায়ণকে। সেই উৎসবে শোভাযাত্রা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আর পিঠা-পায়েস, গুড়-মুড়ির আয়োজনে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বকুলতলা থাকে সরগরম। শহুরে তরুণেরাই মূলত শামিল হন এই আয়োজনে। করোনাভাইরাসের কারণে এবার সেই আয়োজন বাদ রাখা হয়েছে।
তবে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির নবান্ন আয়োজন এবারও হবে বলে শোনা যাচ্ছে। সুরক্ষা মেনে এই আয়োজনের চিন্তাভাবনা আছে আয়োজকদের।
সম্প্রতি ফেসবুকে নিজের প্রোফাইল থেকে ‘ইন দিস ডে’ শেয়ার করেছিলেন মহাখালীর তরুণী সুরভী সুলতানা। নতুন শেয়ারে তিনি ক্যাপশনে লিখেছেন, ‘করোনা এবার নবান্নও কেড়ে নিল। কী সুন্দর একটা দিন কাটিয়েছিলাম সেবার।’ শেষে দিয়েছেন দুটি মন খারাপের ইমো। তাঁর শেয়ার করা ছবিতে চোখে পড়ে নবান্নের শোভাযাত্রা আর বকুলতলার আয়োজন। ফেসবুক মেমরিটা তাঁকে ইনবক্সে পাঠিয়ে জানতে চাইলাম, এবারও কি যাওয়ার ইচ্ছা ছিল?
সুরভী উত্তরে লিখলেন, ‘খুব ইচ্ছে ছিল এবারও যাব। বাসায় সাধারণত আব্বুর কাছে গ্রামের এই সময়ের গল্প শুনেছি। ছোটবেলা গিয়েছিও কয়েকবার গ্রামে। আমরা গেলে দাদু নানা রকম পিঠা বানাতেন। চুলার পাশে বসে সেসব পিঠা খেতাম ফুঁ দিয়ে। দাদু মারা যাওয়ার পর আর সেভাবে আয়োজন হয়নি। তাই এই উৎসবে এসে সেই দিনগুলো মনে করার চেষ্টা করি।’
এবার পয়লা অগ্রহায়ণে ফেসবুকের অনেক বন্ধুর স্ট্যাটাস চোখে পড়ছে নবান্ন নিয়ে। খুঁজে খুঁজে এমন কয়েকজনের কাছে জানতে চাইলাম নবান্ন নিয়ে। বেশ কয়েকজন জানালেন, নবান্ন নিয়ে তাঁদের জানাশোনা আসলে পাঠ্যবই থেকেই। খুব একটা বাস্তব অভিজ্ঞতা নেই। তবে হেমন্তের পর শীতের ছুটিতে কেউ কেউ গ্রামে গিয়ে নতুন চালের পিঠা-পায়েস খেয়েছেন বলে জানালেন। ঢাকায় একটি আবৃত্তি সংগঠনের সঙ্গে জড়িত নরসিংদীর তরুণ তৌফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে দেখেছি বাড়িতে এই মৌসুমে বোন-দুলাভাইদের দাওয়াত করে আনা হয়।
এরপর নানা রকম খাবারের আয়োজন করেন মা-চাচিরা। বিশেষ করে বিভিন্ন ধরনের পিঠা। কোনোবার তাঁরা আসতে না পারলে আব্বু অথবা আমি হাঁড়ি ভরে পিঠা বানিয়ে বয়ে নিয়ে যেতাম বোনদের জন্য। ঢাকায় আসার পর এখনো অগ্রহায়ণ এলে মা ফোন শুরু করেন পিঠা খেতে বাড়ি যাওয়ার জন্য।’
নতুন ধান ওঠার পর আরও একটা জিনিস চোখে পড়ে গ্রামে—ফেরিওয়ালার হাঁকডাক। চুলের ফিতা, সাবান-শ্যাম্পু থেকে নতুন শাড়ি। রসগোল্লা, কটকটি, গুড়, বাদামভাজা, পাঁপড় ও জিলাপির মতো খাবারও বাড়ি বাড়ি এনে ফেরিওয়ালা বিক্রি করেন নতুন ধানের বিনিময়ে।
নতুন ধানে কৃষকের গোলা ভরার পাশাপাশি কিষানির মুখে হাসি ফোটে এই একখানা নতুন শাড়ি বা সাবানে। বাড়ির ছোটরা থাকে রসগোল্লার রসে জিবে জল আনার অপেক্ষায়। এখন চলছে সেই আনন্দের দিন। সুযোগ পেলে গ্রামে ফিরে বিকেলের রোদে পিঠ ঠেকিয়ে বসে থাকুন। সার বেঁধে ধান মাথায় নিয়ে ফেরা কৃষকের মুখেও দেখতে পাবেন সোনালি হাসি। বিকেলের রোদ লেগে যে হাসি তখন চকচক করছে তাঁর মাথায় থাকা ধানের আঁটিতে।