বাদশাহ সোলোমনের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন শেবার রানি। উপহার হিসেবে এনেছেন ১২০ ট্যালেন্ট বা প্রায় চার হাজার কেজি সোনা, অনেক অনেক দামি রত্ন আর নানা রকমের মসলা। সোলোমন তখন ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের রাজা। দারুণ প্রতাপ তাঁর! তাঁকে উপহার হিসেবে মসলা দেওয়া কেন? কারণ, মসলা খুব দামি জিনিস। কেমন দামি জিনিস? খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ সালে এক মুঠ এলাচি দিয়ে একটা দাস কেনা যেত! আজও কিছু মসলা বেশ দামি—যেমন এক কেজি জাফরানের বাজারমূল্য ১০ লাখ টাকার বেশি!
প্রতিটি রাষ্ট্রব্যবস্থায় যে বিষয়টি প্রধান ছিল, তা হলো জনসাধারণের ওপর কর আরোপ। রাষ্ট্র বা রাজা প্রতিটি ভোগ্যবস্তুর ওপর কর আরোপ করবেন। সেই কর জমা পড়বে কোষাগারে। সেই করের অর্থে রাষ্ট্র গতিশীল হবে। দেখা গেছে, খাদ্যব্যবস্থায় যে সরবরাহটি নিয়ন্ত্রণ করলে রাষ্ট্রের লাভ, সেখানে রাষ্ট্র কোনো ছাড় না দিয়ে কর বসিয়েছে, উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করেছে। প্রাচীনকাল থেকে মানুষের খাদ্যই কত কিছু নিয়ন্ত্রণ করে এই সমাজের! ধর্ম নিয়ন্ত্রণ করে কী খাবেন আর কী খাবেন না। এখনো জ্বালানি তেলের উৎপাদন ও সরবরাহব্যবস্থা রাষ্ট্র সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু একসময় খাওয়ার তেলের উৎপাদন ও বিপণনও নিয়ন্ত্রণ করত রাষ্ট্র। সেকালে তিনটি মূল জিনিসের উৎপাদন ও সরবরাহ সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করত রাষ্ট্র। সেগুলো হলো তেল, লবণ আর মসলা।
তেল একটি ভোগ্যপণ্য, যা সহজে নষ্ট হয় না। কিছু কিছু তেল শত শত বছরেও নষ্ট হয় না বলে জানা যায়। যে তেল নষ্ট না হয়ে যত দীর্ঘদিন টিকে থাকে, সেই তেল তত দিন মুদ্রাবিহীন বাণিজ্যে মুদ্রার সমান। যেমন জয়তুন তেল, অলিভ অয়েল। ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় সোনার পরিবর্তে জয়তুন তেলের সাহায্যে লেনদেন হতো। এই তেলের লেনদেনে ভাগ বসাতেন বাদশাহ সোলোমন। আর লবণের ওপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ সব সময়ই ছিল।
কতটুকু নিয়ন্ত্রণ? প্রাচীন গ্রিক বীর আলেক্সান্ডার ভারতের একাংশ জয় করেছিলেন। তাঁর সঙ্গে থাকা শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী যা লুটপাট করত, সেখানে তিনি তিনটি জিনিস সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করতেন—সোনা, নারী আর লবণ! এই তিনটি সম্পদ রাষ্ট্র বণ্টন করবে। লবণের বিষয়টি হাস্যকর মনে করার কোনো কারণ নেই। কারণ, লবণ প্রকৃতির নির্ধারিত উৎসেই পাওয়া যায়। অন্য কোথাও না। খুবই দুষ্প্রাপ্য! এখনকার মতো তখন দোকানে গিয়ে এক কেজি লবণ কিনে আনার ভাবনা ছিল অচল। এখনো যুদ্ধে তাই লবণ নিয়ন্ত্রণ একটা কৌশল।
চাকরিজীবীরা প্রতি মাসে যে ‘স্যালারি’ পান, কিংবদন্তি হলো সেই স্যালারি শব্দটি এসেছে ‘সল্ট’ শব্দ থেকে। আর সল্ট শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ লবণ। বলা হয়ে থাকে, প্রাচীন রোমে সৈন্যবাহিনীতে লবণ কেনার জন্য যে টাকা দেওয়া হতো সেটাই স্যালারি। সেখান থেকেই শব্দটা রয়ে গেছে আমাদের মধ্যে। ‘কার নুন খাও’ বা ‘যার নুন খাই, তার গুণ গাই’-এর অর্থ কোনো রাজার বা সৈন্যদলের নুন খাও অর্থেই রয়ে গেছে প্রাচীন নুন খাওয়ার তুলনাটি। তেমনি ‘নিমক-হারামি’ বলা হয় বিশ্বস্ততা হারালে বা আনুগত্যের বরখেলাপ করলে।
আমাদের ইতিহাসে দেখি রবীন্দ্রনাথের দাদা ছিলেন মধ্যবিত্ত এক মানুষ। ইংরেজদের সঙ্গে খাতির হতেই তিনি হয়ে গেলেন এই অঞ্চলের লবণের নিয়ন্ত্রণকারী। ইংরেজরা তাঁকে এই ক্ষমতা দেওয়ার পরই শুরু হয় জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির রমরমা ইতিহাস।
আর মসলা? মসলার হাত ধরে সভ্যতা এগিয়েছে। প্রাচীনকাল থেকেই মসলা একটি বিলাসী ভোগ্যপণ্য। এটি সবার কাছে সহজলভ্য করা হতো না। বাজারে ছাড়া হতো চড়া দামে। সব সময় যেকোনো বিলাসীপণ্য নিয়ন্ত্রণ করে রাষ্ট্র। মসলাচাষিরা থাকতেন কঠোর নিয়ন্ত্রণে। এটি আমাদের মানবসভ্যতার পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাস। পাঁচ হাজার বছর ধরে সমাজের মানুষ কোন মসলা খাবে, তা নিয়ন্ত্রণ করে সমাজপতিরা। মরিচ, হলুদ, রসুন—এসব শুকনো মসলা কর হিসেবে দেওয়া যেত। উদাহরণ আছে—
ধান ফুরাল, পান ফুরাল খাজনার উপায় কী?
আর ক’টা দিন সবুর করো রসুন বুনেছি।
রসুন? হ্যাঁ! টাকাপয়সা, চাল-ডাল, পান বা গরুর-ছাগল-মুরগির সঙ্গে রসুনও নিত বর্গি হানাদার চাঁদাবাজেরা। তাই এই রসুনটা লোকছড়ায় টিকে গেছে। কিন্তু দাপটের সঙ্গে থাকলেও অর্থমূল্যে নয়। এসব আনাজপাতির চেয়ে কিছু মসলা একটু গুরুত্বপূর্ণ। কিছু মসলা রসুনের মতো কেজিতে কেজিতে কেনা যায় না। বর্গি চাঁদাবাজ এসেছে, আপনার কাছে দশ মণ রসুন আছে আর এক কেজি লবঙ্গ আছে। দুটোর দাম সমান। তার কাছে এক কেজি লবঙ্গই গ্রহণযোগ্য। এই কারণে কিছু মসলা অর্থনীতিতে দারুণ গুরুত্বপূর্ণ। সভ্যতার ইতিহাসেও এরা দিকনির্দেশক। এলাচি, দারুচিনি, লবঙ্গ, মরিচ ও জিরা—এই পাঁচটি মসলা চড়া দামে বিক্রি করত ফিনিশীয় বণিকেরা।
‘মসলা’ শব্দটি খুব প্রাচীন নয়। ধারণা করা হয়, মসলা ফারসি শব্দ থেকে এসেছে বাংলায়। ফিনিশীয়রা ভূমধ্যসাগর অঞ্চলে রাজরাজড়াদের কাছে ছড়িয়ে বেড়াত তাদের জাহাজভর্তি মসলা। এশিয়ার সমুদ্রে দাপটে বেড়ানো আরব বণিকদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকায় তারা বেশ পসার জমিয়েছিল। পরে কিছুকাল আরবরা দখল করে এই বাণিজ্য। তারা বিভিন্ন জায়গা থেকে মসলা সংগ্রহ করতে থাকে। ইন্দোনেশিয়া থেকে আফ্রিকার নানা উপকূলে মসলা সংগ্রহ করত তারা। তারপর সে বাণিজ্য চলে যায় ইউরোপীয়দের হাতে—মূলত পর্তুগিজ আর ডাচদের হাতে। এই ইতিহাসের পুরোটাই মসলার রাজনীতি এবং রক্তক্ষয়ের ইতিহাস। সিল্ক রোড দিয়ে যে পণ্যটির সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য হতো, তা এই মসলা। হাজার রকমের নাম, গন্ধ আর স্বাদ তাদের!
আলেক্সান্ডারের ভারতে আসার আগে দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ এলাচি বা লবঙ্গের স্বাদ পায়নি। এই দুটি ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের মসলা। তাঁর সময়ও যারা এলাচি-লবঙ্গ চাখতে পেতেন, তাঁরা রাজা-মহারাজা! তেমনি ইংরেজ উপনিবেশ আমলে বণিকদের মাধ্যমেই সম্ভ্রান্ত ও উচ্চবিত্তরাই পেত বিশেষ কিছু মসলা। সাধারণ মানুষ এর স্বাদ পেত খুব কম। কত হাজার কোটি টন মসলা চীন থেকে ইউরোপ পর্যন্ত ভ্রমণ করেছে তার হিসাব দেওয়া সম্ভব নয়। মাঝখানে যেখানেই যে রাজার জমিতে পড়েছে এই মসলা, সেখানে খাজনা দিতে হয়েছে। পথের কর! ফলে উৎপাদনস্থল থেকে পরিবহনের কারণে মসলার দাম ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছাতে বহু বহুগুণে বেড়ে যেত।
আমাদের এই দেশে গরমমসলা মানুষ চিনতে শুরু করে খুব বেশি দিন আগে নয়। এর কারণও আছে। বাঙালির জীবনে মাংস খাওয়ার রেওয়াজ কম। নদীমাতৃক দেশ হওয়ার কারণে বাঙালি আমিষের জন্য মাছের দিকে ঝুঁকেছে বেশি। নদীপারের জনপদে মসলা ব্যবহার সরল। মাছের তরকারিতে খুব বেশি মসলা ব্যবহারের প্রয়োজন হয় না। এদিকে যেখানে নদী বা সাগর নেই, সেখানে মানুষ আমিষের জন্য মাংসনির্ভর। মাংস রাঁধতে মসলা বা কোনো সুগন্ধি উপকরণ সংযোগ করা কবে থেকে শুরু, তা জানা যায় না।
অনেকে মজা করে বলেন, সভ্যতার ইতিহাসে কিছু মসলা সব সময় দামি বস্তু বলে এদের নাম ‘গরমমসলা’! কিন্তু বিষয়টি অন্য রকম। এই মসলাগুলোতে ‘দেহের উষ্ণতাবর্ধক’ গুণ আছে। স্বাদও একটু ঝাঁজালো। তাই সম্ভবত এর নাম গরমমসলা। সব মসলাই দেহের কোনো না কোনো উপকার করে। যেমন হলুদ। কোষের ক্ষয়পূরণে এর বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। যাঁরা হলুদ বেশি খাবেন তাঁদের আলঝেইমার বা স্মৃতিভ্রষ্ট রোগ কম হয়। হলুদ যাঁরা খান, তাঁরা মানসিকভাবে ‘প্রফুল্ল’ থাকেন বলেও জানা যায় বিভিন্ন লেখা পত্রে। যে অঞ্চলে খুব গরম, সেই অঞ্চলে ঝাল খাওয়ার প্রচলন বেশি।
কিছু মসলা মানুষের বার্ধক্য রোধ করে। কোষের ক্ষয়কে ধীর করে। সবচেয়ে বড় কথা, যেকোনো মসলার গন্ধ শুধু নাকেই সুড়সুড়ি দেয় না, পেটের খিদে জাগানোর সঙ্গে সঙ্গে অন্য খিদেও জাগায়! বিষয়টি বোঝা সহজ। সব মসলারই সুগন্ধ আছে। মসলা পেটে যতটুকু কাজ করে, তার চেয়ে অনেক বেশি কাজে করে মগজে। বিভিন্ন রকম মসলা নানা রকম হরমোনের জন্ম দেয় সেরেব্রামে। পৃথিবীর সব মসলার গন্ধই উত্তেজক। মসলার সুগন্ধ আমাদের মস্তিষ্কে হর্ষ (Euphoric state) উৎপাদন করে।
ইতিহাসে দেখি, আওরঙ্গজেব খুব এলাচি আর লবঙ্গ খেতেন। আর জাহানারা পানের সঙ্গে এলাচি-দারুচিনির প্রচলন করেছিলেন। এলাচি কেন? মুখে সুগন্ধ হবে আর প্রেমময় মুড তৈরি হবে। বলে রাখা ভালো, প্রেমিকার কাঁকন পরা হাতে প্রেমিককে পান খাওয়ানোর প্রচলনটি সিন্ধু অববাহিকার নয়। ওটি ইরান থেকে এসেছে। এবং পানও উত্তেজক—গরমমসলার মতো!
মহামতি আকবর তো আরও এক কাঠি ওপরে। তিনি গরুকে এলাচি আর দারুচিনি খাওয়াতেন ভাতের মাড়ের সঙ্গে, ঘাসের সঙ্গে! যখন সে গরুর মাংস থেকে কাবাব বানানো হতো তখন তার মাংসের রন্ধ্রে রন্ধ্রে থাকত সুগন্ধ! বিশেষ দিনে জবাই হতো সে গরু।
সবশেষে ঠাকুরবাড়ির এক ঘটনা। রবীন্দ্রনাথের বাবা গরুকে ঝোলা গুড় আর গুয়ামুরি/মৌরি খাওয়াতেন! তাঁর ধারণা ছিল, এতে গরুর দুধ মিষ্টি হয়।
এই হলো গল্প। তেল, লবণ আর মসলার গল্প আসলে ফুরোবার নয়। মানব সভ্যতার ইতিহাস কোনো না কোনো মাত্রায় গতি পেয়েছে তেল, লবণ আর মসলার কারণে।
তথ্যঋণ: সত্যেন সেন, মসলার যুদ্ধ, মুক্তধারা, ১৯৮০ ও বিভিন্ন ওয়েবসাইট।