কেমন করে এল 'থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়'

কলার থোড়। ছবি: আফরোজা লিলি
কলার থোড়। ছবি: আফরোজা লিলি

প্রবাদটি শুনেছেন নিশ্চয়ই, ‘থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়’। বাংলা প্রবাদ। এর অর্থ বৈচিত্র্যহীন। রান্নার বৈচিত্র্যহীনতা, জীবনে বৈচিত্র্যের অভাব—এ রকম বোঝাতে এই প্রবাদ ব্যবহার করা হয় বাংলা ভাষায়। কিন্তু কেমন করে এল ‘থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়’ প্রবাদটি? অকূলপাথারে পড়ার প্রয়োজন নেই, এক্ষুনি সব পরিষ্কার হয়ে যাবে আপনার কাছে।

‘থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়’ এই প্রবাদে বাঙালির তিনটি বহুল প্রচলিত খাবারের কথা বলা হয়েছে। এই খাবারগুলো আবহমানকাল ধরে আমাদের রান্নাঘরে রান্না হয়ে আসছে ধর্ম ও সম্প্রদায়নির্বিশেষে। সুস্বাদু তো বটেই, এই খাবারগুলোকে এখন পুষ্টির দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ ভাবা হচ্ছে। এই তিন খাবারের একটি হচ্ছে থোড় অর্থাৎ কলাগাছের ভেতরের নরম অংশ। কলাগাছ শুধু হাতিই খায় না, মানুষও খায়। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কলাগাছের বিভিন্ন অংশের সুস্বাদু রান্নার রন্ধনপ্রণালি পাওয়া যায় এখনো। এর কিছু বেশ সুস্বাদু।

যাদের বয়স চল্লিশ পেরিয়ে পঞ্চাশ-ষাট কিংবা সত্তরের ঘরে পড়েছে, চোখ বন্ধ করে একবার আপনার গ্রামের বাড়ির চৌহদ্দি স্মরণ করার চেষ্টা করুন। কী দেখছেন? বাড়ির ভিটায় বা পাশেই কয়েকটা কলাগাছ, ছাইয়ের স্তূপের পাশে একটা চালকুমড়ো, মিষ্টিকুমড়ো বা পুঁই লতা অবহেলায় আকাশ ফুঁড়ে উঠতে চাইছে। আর একটা শজনেগাছ। মনে পড়ছে? সঙ্গে কারও কারও বাড়িতে দেখতে পাবেন একটা লেবুর ঝাড়। বাড়ির পাশে একটি পুকুর, গোয়ালে গাভি, গোলায় ধান—এটা বাঙালির ইউটোপীয় ভাবনার অংশ। অতীতকে গৌরবান্বিত করার প্রয়াস। আদতে এখনো যেমন মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের হাতে অর্থ, আগেও তাই ছিল। তবে এখন যেমন বিত্তবানের সঙ্গে নিম্নবিত্তের বিরাট ফারাক—অর্থনৈতিক সামাজিক সব দিক থেকে, তখন হয়তো তেমনটা ছিল না। সে জন্যই বলছি, আপনার বাড়ির চৌহদ্দি স্মরণ করুন। বুঝতে পারবেন। কলাগাছ বিভিন্ন কারণেই বাঙালির কাছে গুরুত্বপূর্ণ। হিন্দু সম্প্রদায়ের বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষঙ্গে তো বটেই, হিন্দু-মুসলিম মিলিত ঐতিহ্যের যে উৎসবের অস্তিত্ব ছিল গ্রামীণ সমাজে তাতে শিরনি/শিন্নি দেওয়ার জন্য কলা আর গমের আটার চাহিদা ছিল ওপরের দিকে। এখন চাইলে বড় অনুষ্ঠানে প্যান্ডেল তৈরি করে চেয়ার টেবিলে বসিয়ে সিরামিকস বা মেলামিন কিংবা ওয়ান টাইম প্লেটে খাওয়ানো যায়। কিন্তু একসময় বড় অনুষ্ঠানের জন্য সম্প্রদায়নির্বিশেষে কলাপাতা আর ফুটখানিক লম্বা কলাগাছের বাকলের তৈরি ডোঙাই ছিল একমাত্র অবলম্বন। তবে যেসব জায়গায় তালপাতা কিংবা পদ্মপাতা পাওয়া যেত, সেসব জায়গায় সেগুলোও ব্যবহার করা হতো অনুষ্ঠানে প্লেট হিসেবে। আর খেয়াল করুন, বন্যাপ্রবণ এই বাংলায় কলাগাছ কত কাজে ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া ফল হিসেবে কলা সুস্বাদু, কলার মোচা খাওয়া যায়, সেই সঙ্গে কলাগাছের থোড়ও খাওয়া যায়। সবকিছু মিলে কলাগাছের গুরুত্ব ছিল মানুষের কাছে অপরিসীম। তাই কলাগাছ ছিল বাড়ির ভিটায় অথবা বাড়ির পাশেই, যাতে হাত বাড়ালেই পাওয়া যায়।

ডালের বড়ি দেওয়া হচ্ছে। ছবি: নিবেদিতা নার্গিস

বড়ির কথায় আসি। মসুর, মাষকলাই এবং অড়হর ডালের বড়ি বানানো যায়। চৈতন্য চরিতামৃতে (ষোলো শতকের মাঝামাঝিতে রচিত) ‘ফুল বড়ি’র কথা পাওয়া যায়। এই ফুল বড়ি মসুর ডালে তৈরি হতো। তার মানে বড়ির উপস্থিতি এই অঞ্চলে বেশ প্রাচীন। মসুর-মাষকলাই-অড়হরের ডাল বেটে, ভালো করে ফেটিয়ে নিয়ে বড়ি দেওয়া হয় পরিষ্কার কাপড়ে বা টিনের ওপর। তারপর শুকানো হয় প্রখর রোদে। শুকিয়ে গেলে সংরক্ষণ করে রাখা হয় সারা বছর খাওয়ার জন্য। প্রায় সব ধরনের নিরামিষ তরকারিতে মিশেল দেওয়া যায় এই বড়ি। ডাল বাটার সঙ্গে কখনো কখনো যোগ করা হয় মিহি করে বাটা চালকুমড়ো। চালকুমড়ো মেশানো বড়িকে কুমড়ো বড়ি বলে আর চালকুমড়ো ছাড়া বড়ি শুধু বড়ি হিসেবে পরিচিত। সবজির সঙ্গে মিশেল দিয়ে খাওয়া হয় ডালের বড়ি। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলে ডালের বড়ি তৈরি করার প্রচলন রয়েছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুরে তৈরি হয় অলংকারের নকশার মতো দেখতে গয়না বড়ি। তেলে ভেজে খাওয়া হয় এই গয়না বড়ি।

রইল বাকি খাড়া

বড়ি রোদে শুকাতে দেওয়া হয়েছে। ছবি: সোমা ভট্টাচার্য

খাড়া শব্দটি নিয়ে বেশ নাকানিচুবানি খেতে হয়েছে। খাড়া মানে ডাঁটা। শজনে ডাঁটাকে খাড়া নামে ডাকা হয় বাংলাদেশের নড়াইল, বাগেরহাট, খুলনা, যশোরের কিছু অঞ্চলে। শব্দটি অপ্রচলিত এখন। ওই সব অঞ্চলের প্রবীণ মানুষদের মুখে শোনা যায় শব্দটি। আর এই খাড়া শব্দটি বহুলভাবে ব্যবহৃত হয় রাঢ় অঞ্চলে। এই রাঢ় অঞ্চল হলো আমাদের দক্ষিণবঙ্গ লাগোয়া ভারতের পশ্চিমবঙ্গ। হুগলি, বর্ধমান, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, বীরভূম—ওই সব অঞ্চলে বহুলভাবে শজনেকে খাড়া বলা হয়। মূলত ডাঁটাজাতীয় সবকিছুকেই এই অঞ্চলে খাড়া বললেও ‘শজনে খাড়া’ বহুল ব্যবহৃত শব্দ। কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক পিয়ালী পালিত জানাচ্ছেন, ‘খাড়া শব্দটি বিশেষত সাঁওতালরা ব্যবহার করে, বীরভূম অঞ্চলে। আমার ছোটবেলায় শান্তিনিকেতনের আশে পাশে থাকা মাঝি মেঝেনদের শজনে ডাঁটাকে খাড়া বলতে শুনতাম। তারা কোনোমতেই অন্য কোনো শব্দ (শজনে/নাজনে) ব্যবহার করত না। বীরভূম থেকে শুরু করে দুমকা পর্যন্ত তাদের মধ্যে খাড়া শব্দটিই প্রচলিত।’ এই বক্তব্য থেকে ধরে নেওয়া যেতে পারে যে শব্দটি সাঁওতালি ভাষা থেকে এসেছে। আবার সুশীল কুমার মণ্ডল রচিত ‘রাঢ়ের শব্দ ও সংস্কৃতি অভিধান’ এ (প্রভা প্রকাশনী, কলকাতা-১২) খাড়া শব্দটির অর্থ বলা হয়েছে, ডাঁটা, সবজি বিশেষ। উদাহরণ হিসেবে বলা হয়েছে, শজনে খাড়া আর শব্দটি ব্যবহারের জন্য নির্দেশ করা হয়েছে বাঁকুড়া, বর্ধমান অঞ্চলকে। মোটকথা, খাড়া শব্দটি বাংলাদেশের দক্ষিণবঙ্গের কিছু অংশ এবং রাঢ় বাংলায় শজনে বা শজনে ডাঁটার প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। শজনের আরও কিছু প্রতিশব্দ আছে। যেমন রংপুর, দিনাজপুর, নীলফামারীতে সরু লম্বা সবুজ রঙের শজনেকে (মূলত এটিই শজনে) বলা হয় ঝুল বা ঘোড়ার ঝুল। আর নজনে বা একটু বেঁটে ও মোটা শজনেকে বলা হয় রায় খঞ্জন (এটি প্রায় সারা বছরই পাওয়া যায়)। আবার পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে একে ডাকা হয় ছুটি বা ছুট্টি বলে। খুঁজলে শজনের এ রকম আরও প্রতিশব্দ পাওয়া যেতে পারে বিভিন্ন অঞ্চলে।

গয়না বড়ি। ছবি: নিবেদিতা নার্গিস

বর্তমান বিশ্বে ‘মিরাকেল ট্রি’ নামে খ্যাত শজনেগাছ বাঙালি খাদ্যসংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। খাদ্য হিসেবে এর ফুল, ফল, পাতার ব্যবহার ব্যাপক। শজনে পাতা ‘নিউট্রিশনস সুপার ফুড’ হিসেবে পরিচিত বলে এর গুঁড়া বিক্রি হয় পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর শপিং মলে। তা ছাড়া ভারতীয় বাংলাদেশসহ পুরো উপমহাদেশে আয়ুর্বেদ চিকিৎসায় শজনেগাছের কাণ্ড ও শিকড়ের ব্যবহার রয়েছে। শজনে বীজ দিয়ে তৈরি হয় সৌন্দর্যবর্ধক তেল, সে তেল সুপারশপে খুঁজলেই পাবেন। এমন একটি উপকারী গাছের কদর বাঙালি করবে না, সে কি হয়? প্রাচীনকাল থেকেই সে কারণে বাঙালি শজনেগাছকে জায়গা দিয়েছে তার ভিটার কোণে, আপন করে।

ইতিমধ্যে আমরা থোড়, বড়ি এবং খাড়া—এই তিনটি খাবারের পরিচয় পেয়ে গেছি। কিন্তু কেন এই তিন খাবার থেকেই প্রবাদটির উৎপত্তি হলো? সাধারণ বাঙালি চিরকালেই অন্নের অভাবে দগ্ধ হয়েছে। না, সাধারণ বাঙালি খাবারের অভাবে মরেনি। কিন্তু তার রান্নাঘরে বৈচিত্র্যের অভাব ছিল। ঘুরিয়ে–ফিরিয়ে একই ধরনের তরকারি তাদের খেতে হয় প্রতিদিন। সেই থোড় না হলে বড়ি না হলে খাড়া না হলে শাক। রান্নাঘরের এই বৈচিত্র্যহীনতা বোঝাতে বাঙালি কখন থেকে এই প্রবাদের ব্যবহার শুরু করে, তার কোনো ঐতিহাসিক সূত্র পাওয়া যায় না বটে, কিন্তু প্রবাদটি যে রান্নাঘরের চৌহদ্দি পেরিয়ে আমাদের যাপিত জীবনের বৈচিত্র্যহীনতার ব্যাপকতা প্রকাশ করে, সেটা বোঝা যায় খুব ভালোভাবেই।

‘থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়’ প্রবাদটি যতই বৈচিত্র্যহীনতার কথা বলুক না কেন, আমরা কদলী বালার গুণমুগ্ধ, কুমড়ো বড়ির স্বাদমুগ্ধ আর শজনে ফুলের রূপমুগ্ধ।

শজনে ফুল। ছবি: লেখক

‘এখানে আকাশ নীল—নীলাভ আকাশ জুড়ে সজিনার ফুল
ফুটে থাকে হিম শাদা—রং তার আশ্বিনের আলোর মতন;…’

(এখানে আকাশ নীল, জীবনানন্দ দাশ)

সহায়তা:
১. সুশীল কুমার মণ্ডল, রাঢ়ের শব্দ ও সংস্কৃতি অভিধান, প্রভা প্রকাশনী, কলকাতা-১২।
২. মিলন দত্ত, বাঙালির খাদ্যকোষ, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা-৭৩, ২০১৫।
৩. ফেসবুক গ্রুপ নুনেতে ভাতেতে।