ইলিশ খেতে বাঙালির কোনো উপলক্ষ প্রয়োজন হয় না। ভেজে, ভাপিয়ে, সরসে দিয়ে; আরও কতভাবে যে ইলিশ খাওয়া হয়, তার হিসেব বাঙালি রাখেনি কোনোদিন। শুধু সুস্বাদু বলেই কি ইলিশের জগৎজোড়া খ্যাতি? আজ খাবার নয়। ইলিশের ভিন্ন গল্প শুনিয়েছেন একজন মৎস্য বিশেষজ্ঞ।
নীলচাষ! বাংলার কৃষকের জীবন-জীবিকার এক কালো অধ্যায়, আর নীলকুঠিগুলো নীল অত্যাচারের কেন্দ্রস্থল। ‘দ্য লস্ট অব নীলকুঠি’ গ্রন্থ জানাচ্ছে, ১৭৭৫ সালে লুই বন্ড নামের এক ফরাসি যশোর জেলায় প্রথম নীলকুঠি স্থাপন করেন। নীলচাষের উর্বর ভূমিখ্যাত যশোরের চৌগাছায় কপোতাক্ষ নদের অববাহিকায় সবচেয়ে বড় পুড়াপাড়া কাঠগড়া নীলকুঠি গড়ে ওঠে। চৌগাছার কপোতাক্ষ নদের কুল ঘেঁষে আরও এক অত্যাচারের সাক্ষী হয়ে আছে মহেশপুরের ‘ইলিশমারি নীলকুঠি’।
নীলচাষের উর্বর ভূমিখ্যাত যশোরের চৌগাছায় কপোতাক্ষ নদের অববাহিকায় সবচেয়ে বড় পুড়াপাড়া কাঠগড়া নীলকুঠি গড়ে ওঠে। চৌগাছার কপোতাক্ষ নদের কুল ঘেঁষে আরও এক অত্যাচারের সাক্ষী হয়ে আছে মহেশপুরের ‘ইলিশমারি নীলকুঠি’।
ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ইলিশমারি নীলকুঠির আওতাধীন নারায়ণপুর ও বড় খানপুর গ্রামের চাষিরা নীল কুঠিয়ালদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। নীল বিদ্রোহের চূড়ান্ত রূপ দেখা যায় ১৮৬০ ও ১৮৬১ সালে। সেই কালো নীল কন্ট্রাক্ট বাতিল করতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ। লুই বন্ড থেকে হ্যালিডে নামের নীলকরদের নীলনকশা কিংবা ইলিশমারি নীলকুঠির বিজয়াখ্যান আজকের প্রতিপাদ্য না হলেও, ‘ইলিশমারি’ শব্দটির জন্যই ইতিহাসের এ আখ্যান সামনে আনা।
এখন চোখ রাখি ইলিশের বর্তমান অবস্থার দিকে। পৃথিবীতে মাছের মোট উৎপাদন ১৭৯ মিলিয়ন মেট্রিক টন, যেখানে ইলিশের উৎপাদন মাত্র ০.৭০-০.৭৫ মেট্রিক টন। আর বাংলাদেশে এর উৎপাদন ০.৫৩ মিলিয়ন মেট্রিক টন। উৎপাদনের শীর্ষে একক প্রজাতির যেসব মাছ সারা পৃথিবীতে রাজত্ব করছে তার মধ্যে অ্যানকোভিটা, আলাস্কা পোলক, টুনা, হেরিং, মেরারেল কিংবা গ্রাসকার্প, সিলভারকার্প, তেলাপিয়া অন্যতম।
একক জাতের মাছ উৎপাদনের দিক থেকে ইলিশের উৎপাদন প্রথম ১৪টি মাছের মধ্যে নেই (এফএও, ২০২০)। অথচ এই মাছ নিয়ে কত আয়োজন, কত পরিচয়, কত গর্ব, যা তাবৎ দুনিয়ায় খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তেলাপিয়া একটি সর্বজনীন মাছ, পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই উৎপাদিত হয়। মাছটির আদি বাসস্থান আফ্রিকায়। কিন্তু এই অঞ্চলে কিংবা পৃথিবীর কোনো স্থানেই এই মাছ নিয়ে তেমন কোনো সংস্কৃতির ইতিহাস কিংবা কোনো স্থানের নামকরণ করা হয়েছে বলে আমার জানা নেই।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কিছু কিছু মাছের নামে হোটেল-রেস্টুরেন্টের নাম পাওয়া যায়, তবে তা নগণ্য। বাংলাদেশে বিভিন্ন মাছের নাম দিয়ে কয়েক কুড়ি এলাকার নামকরণ রয়েছে, যা রজত কান্তি রায়ের ‘মাছের নামে নাম’ লেখায় স্পষ্ট। প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে ইলিশ বা এর জ্ঞাতিগোষ্ঠীর ইতিহাস ৪০-৫০ মিলিয়ন বছর আগের। সিন্ধু সভ্যতায় মাছ ধরার ইতিহাস প্রমাণিত। পশ্চিমবঙ্গের চন্দ্রকেতুগড়ে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনে আনুমানিক চতুর্থ শতকে মাছধরার বিষয়টিও স্পষ্ট। এই দুই অঞ্চলের নদীতে আজও ইলিশের যথেষ্ট আনাগোনা রয়েছে। এই দীর্ঘ যুগ-যুগান্তরের ইতিহাসে বাঙালি পেটপুরে ইলিশ খেয়েছে এবং সাংস্কৃতিক যাপনের বিভিন্ন স্তরে ইলিশ নামে নামকরণ করেছে।
এবার আসি নামকরণের সেসব ইতিহাস কিংবা অর্থগত বিশ্লেষণ নিয়ে। যশোরের চৌগাছা উপজেলার নারায়ণপুর ইউনিয়নে ইলিশমারি ছোট্ট একটি গ্রাম। কেন এই নামকরণ? ওখানকার এক প্রবীণ ব্যক্তি বলেছিলেন, কয়েক শ বছর আগে কপোতাক্ষ নদ অনেক বড় ছিল। কপোতাক্ষসহ আশপাশের নদী থেকে এখানে প্রচুর ইলিশ আসত। কথিত আছে, একবার এখানকার জেলেরা কপোতাক্ষ নদে প্রচুর ইলিশ ধরে বিক্রির জন্য নদীর ঘাটে জমা করেন। কিন্তু সেই মাছের কোনো ক্রেতা পাওয়া গেল না। তাই অনেক ইলিশ নষ্ট হয়ে গেল। তারপর থেকে ইলিশঘাট ইলিশ মরার ঘাট এবং পরবর্তী সময়ে ইলিশমারির ঘাট নামে পরিচিত হলো।
প্রতিটি নামকরণের একটা ইতিহাস থাকে। তবে মাছসংক্রান্ত যতগুলো এলাকার নাম আছে, তার অধিকাংশের শেষে পুর, মারি, খালী, কোল, তলা প্রভৃতি প্রত্যয়, ক্রিয়া, ক্রিয়াবিশেষ্য বা নামবিশেষ্য যুক্ত হয়ে ওই এলাকার নামকরণ করা হয়। যেমন, ভুুরুঙ্গামারি, রৌমারি, চিতলমারি, শোলমারি, ট্যাংরাখালী প্রভৃতি।
সময়ের পালাবদলে নদী দূরে সরে যেতে থাকল। ফলে ঘাটটি আর ওই স্থানে থাকল না। শুরু হলো জনবসতি এবং জনবসতির নামকরণ হলো ইলিশমারি। এই ইলিশমারি গ্রামের কাছাকাছি কাঠগড়া নীলকুঠির আওতাধীন একটি নীলকুঠি স্থাপিত হলো এবং নাম রাখা হলো ইলিশমারি কুঠি। বর্তমানে ইলিশমারি নীলকুঠির কোনো চিহ্ন এখানে নেই, কিন্তু ইতিহাস রয়ে গেছে।
প্রতিটি নামকরণের একটা ইতিহাস থাকে। তবে মাছসংক্রান্ত যতগুলো এলাকার নাম আছে, তার অধিকাংশের শেষে পুর, মারি, খালী, কোল, তলা প্রভৃতি প্রত্যয়, ক্রিয়া, ক্রিয়াবিশেষ্য বা নামবিশেষ্য যুক্ত হয়ে ওই এলাকার নামকরণ করা হয়। যেমন, ভুুরুঙ্গামারি, রৌমারি, চিতলমারি, শোলমারি, ট্যাংরাখালী প্রভৃতি।
অনেক ক্ষেত্রে আ, ইয়া, ওয়া প্রভৃতি প্রত্যয় কিংবা সংস্কৃত অপভ্রংশ যুক্ত করেও নামকরণ করতে দেখা যায়। ইলিশের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটি দেখা যায়। যেমন কলারোয়া উপজেলার ইলিশপুর ও কিসমত ইলিশপুর গ্রাম, রাজবাড়ী জেলার বহরপুর ইউনিয়নের ইলিশকোল গ্রাম, কক্সবাজারের চকোরিয়া উপজেলার পশ্চিম বড় ভেওলা ইউনিয়নের ইলিশিয়া বাজার, ভোলা জেলার পশ্চিম ও পূর্ব ইলিশা নামে দুইটি ইউনিয়ন। ইলিশমারি নামে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরে ইসলামপুর ইউনিয়নে একটি গ্রাম রয়েছে।
কলকাতার মুর্শিদাবাদ, বাংলাদেশের রাজবাড়ী জেলাসহ পদ্মা নদীর অববাহিকায় ইলিশমারির চর ও চর ইলিশমারি নামে গ্রামের কথা পাওয়া যায়, যা পদ্মার ভাঙনে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে বলে বিভিন্ন পুস্তকে উল্লেখ করা হয়েছে। ইলিশখালী নামে একটি বড় খাল এবং ইলিশে ইলিশে ভরপুর একটি বড় নদীর নাম ইলিশা, যা ভোলা জেলায় অবস্থিত। ইলিশমারি নামে দুটি নদীর সন্ধান মেলে, যার একটি খোদ ঢাকা জেলায় এবং অপরটি সুন্দরবন এলাকার ১৭৭টি নদীর একটি।
এখন প্রশ্ন হলো পুর, মারি, খালী, কোল, আ বা ইয়া কেন যুক্ত হলো কিংবা এগুলোর অর্থই বা কী? পুর একটি প্রত্যয় যার অর্থ নগর, আবাস বা দুর্গ। আমাদের উপমহাদেশের প্রাচীন গ্রন্থ ‘ঋগবেদে’ পুর শব্দটি নগর ও বাসস্থান অর্থে অন্তত ৩০টি স্থানে ব্যবহৃত হয়েছে। তামিল ভাষায় পুর বা পুরম মানে নগর বা জনপদ। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বহু জনপদের নামের শেষে পুর প্রত্যয়টি ব্যবহৃত হয়ে এলাকার নামকরণ হয়েছে।
অন্যদিকে, পৌরসভা শব্দটি লাতিন শব্দ থেকে এসেছে। পশ্চিমবঙ্গে এ শব্দটি পুরসভা নামে প্রচলিত, যা বাংলা ভাষায় ঐতিহাসিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। পুরসভার পুর প্রত্যয়টি অসংখ্য স্থানের নামের সঙ্গে যুক্ত করে ওই স্থানের নামকরণ করার প্রবণতা পশ্চিমবঙ্গে দেখা যায়। বাংলা একাডেমি অভিধান বলছে, মারি অর্থ মারা। মার ক্রিয়াপদের সঙ্গে ই প্রত্যয় যুক্ত হয়ে ক্রিয়াবিশেষ্য মারি হয়েছে। এটি ইলিশ মারার বা ধরার কোনো ঐতিহাসিক ঘটনাকে নির্দেশ করে।
সুন্দরবনের এক প্রবীণ ইলিশ শিকারি বলেছিলেন, ইলিশমারি নদীটির নামকরণ মূলত সমুদ্র অধিপতি বাবা বদর গাজীর ইঙ্গিতে রাখা হয়েছে। একদল ইলিশ শিকারি ইলিশ না পেয়ে সমুদ্র থেকে শূন্য হাতে ফিরে যাচ্ছিলেন। রাতে সুন্দরবনের অচেনা এক নদীর ধারে নৌকার গিরাপি গেঁথে ঘুমিয়ে পড়লে সত্যপীর বাবা বদর গাজী নৌকার মাঝিকে স্বপ্ন দেখান সে নদীতে মাছ ধরার জন্য। তারপর ওই নদী থেকে ইলিশ শিকারিরা প্রচুর ইলিশ ধরেন। সেই থেকেই এই নদীর নাম ইলিশমারি নদী।
খালী অর্থ শূন্য বা ফাঁকা; আবার খাল অর্থ নালা বা সংকীর্ণ জলধারা। খাল শব্দের সঙ্গে ই প্রত্যয় যুক্ত হয়ে খালী নাম বিশেষ্য হিসেবে স্থানের নামের শেষে যুক্ত হয়। ইলিশাখালী নামকরণের বিশ্লেষণগত অর্থে বলা যায়, এটি একটি খাল, যেখানে প্রচুর ইলিশ ছিল অথবা এর উল্টো অর্থেও প্রচলিত হতে পারে।
চাঁদপুরের পুরাতন ইলিশ ঘাট ৪০০-৫০০ বছরের ঐতিহ্য বহন করে আসছে, যেখানে কলকাতা থেকে সরাসরি স্টিমার এসে ভিড়ত। বরগুনাকে ইলিশের জেলা নামে নামকরণ করে তার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ভোলা সদর উপজেলার পূর্ব ইলিশা এবং পশ্চিম ইলিশা ইউনিয়নের মধ্যভাগ দিয়ে চলে গেছে ১২ কিলোমিটার লম্বা ইলিশা সড়ক, যা শুরু হয়েছে জিরোপয়েন্ট ইলিশ চত্বর থেকে আর শেষ হয়েছে ইলিশা ঘাটে।
কোল বিশেষ্য পদ, যার অর্থ হলো ক্রোড় বা পেট/মধ্যভাগ বা জলভাগের কিনারা। অন্যভাবে, কোল শব্দটি কোলা থেকে এসেছে। বাংলা কোলা শব্দের অর্থ শস্যখেতে অপেক্ষাকৃত নিচু জলাভূমি, যেখানে অনেক মাছ আশ্রয় নেয়; যেভাবে মায়ের কোলে শিশু আশ্রয় গ্রহণ করে। বরিশাল বিভাগের অনেক জেলায় কোলা শব্দটি চাষকৃত জমি অর্থে এখনো ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। ইলিশকোল নামকরণে ইলিশ আশ্রয়ের কাহিনিকে নির্দেশ করে। আ বা ইয়া হলো প্রত্যয়, যা কোনো নামবিশেষ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ওই স্থানের নাম প্রকাশ করে।
কিছুদিন আগে কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতে বেড়াতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম ব্যক্তি-উদ্যোগে তৈরি ‘ইলিশ পার্ক ও রিসোর্ট’ নামে একটি রেস্টুরেন্ট কাম আবাসিক হোটেল। এখানে ইলিশপ্রেমী মানুষকে নান্দনিকভাবে ইলিশ খাওয়ার জন্য ৭২ ফুট লম্বা ও ১৮ফুট চওড়া একটি দীর্ঘাকৃতির ইলিশের রেপ্লিকা তৈরি করা হয়েছে, যার পেটের মধ্যে বসে একসঙ্গে ৪৫ জন মানুষ ইলিশের বিভিন্ন খাবারের স্বাদ নিতে পারবেন। বাংলাদেশের বরগুনা, ভোলা, চাঁদপুর ও ঢাকায় চারটি ইলিশ চত্বর রয়েছে। এই চারটি ইলিশ চত্বরে বিশালাকার ইলিশ মনুমেন্ট তৈরি করা হয়েছে। তার মধ্যে ভোলা পৌরসভা নির্মিত মনোলোভা ইলিশ চত্বরটি রাতের কৃত্রিম আলোকসজ্জায় মনোরম, নান্দনিক ও উপভোগ্য হয়ে ওঠে। স্টিলনেস স্টিলের তৈরি মনুমেন্টটি ইলিশপ্রেমী বাঙালির জন্য যেন একটি ইলিশ-তাজমহল!
চাঁদপুর জেলা প্রশাসন ও স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিকে নিয়ে ‘ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর’ নামে ব্র্যান্ড তৈরি করা হয়েছে। ইলিশের এই ব্র্যান্ডিং বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিতে বিভিন্ন সচেতনতামূলক ও সামাজিক কার্যক্রমের পাশাপাশি ইলিশ সাহিত্য নিয়েও কাজ করে যাচ্ছে। চাঁদপুর শহরে একজন প্রখ্যাত হোটেল ব্যবসায়ী তিন তারকা মানের একটি নতুন হোটেলের নামকরণ করেছেন ‘হোটেল গ্র্যান্ড ইলিশ ইন্টারন্যাশনাল’। চাঁদপুরে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটে আলাদাভাবে ইলিশ গবেষণা বিভাগ রয়েছে; যার আওতায় ‘এমভি রুপালি ইলিশ’ নামে ইলিশ ধরার কয়েকটি গবেষণা ভ্যাসেল রয়েছে।
চাঁদপুর জেলা প্রশাসন ও স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিকে নিয়ে ‘ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর’ নামে ব্র্যান্ড তৈরি করা হয়েছে। ইলিশের এই ব্র্যান্ডিং বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিতে বিভিন্ন সচেতনতামূলক ও সামাজিক কার্যক্রমের পাশাপাশি ইলিশ সাহিত্য নিয়েও কাজ করে যাচ্ছে।
চাঁদপুরের পুরাতন ইলিশ ঘাট ৪০০-৫০০ বছরের ঐতিহ্য বহন করে আসছে, যেখানে কলকাতা থেকে সরাসরি স্টিমার এসে ভিড়ত। বরগুনাকে ইলিশের জেলা নামে নামকরণ করে তার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ভোলা সদর উপজেলার পূর্ব ইলিশা এবং পশ্চিম ইলিশা ইউনিয়নের মধ্যভাগ দিয়ে চলে গেছে ১২ কিলোমিটার লম্বা ইলিশা সড়ক, যা শুরু হয়েছে জিরোপয়েন্ট ইলিশ চত্বর থেকে আর শেষ হয়েছে ইলিশা ঘাটে।
এই দুই ইউনিয়নের প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজ, মসজিদ, মাদ্রাসা থেকে শুরু করে অনেক ব্যক্তিগত পর্যায়ের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নামের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে ইলিশ। ভোলার ইলিশা রোডে যেতে যেতে চোখে পড়ল একটি বাস, যার নাম ইলিশা পরিবহন প্রা. লি.। আর শহরের মধ্যেই মেসার্স ইলিশা অ্যাগ্রো ট্রেডিং নামের একটি দোকান পেলাম। ঢাকা-ভোলা নৌরুটে তিন তলা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বেশ কয়েকটি লঞ্চ চলে, যেখানে বড় বড় অক্ষরে এমনভাবে ইলিশা শব্দটি লেখা থাকে, দেখলে মনে হয় লঞ্চটির নামই বোধ হয় ইলিশা।
শুধু কি তা-ই; বরিশাল-মাওয়া-ঢাকা রোডে ইলিশ পরিবহনের অর্ধশতাধিক বাস দেড় দশকের বেশি সময় ধরে মানুষের সেবা দিয়ে রাজত্ব করে বেড়াচ্ছে। আরও একটি চমৎকার তথ্য হলো, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরে একটি যুব সংঘের নাম ইলিশমারি যুব সংঘ এবং রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দিতে তিনটি মন্দিরের নামের সঙ্গে ইলিশকোল সংযুক্ত রয়েছে। কক্সবাজারের পশ্চিম বড় ভেওলা ইউনিয়নের ইলিশিয়া জমিদার বাড়িটি কয়েক শ বছরের ইতিহাস বহন করে আসছে। একটা রিকশা, একটা বাড়ি কিংবা অটোরিকশার নামের সঙ্গে যখন বাঙালি ইলিশ শব্দটি জুড়ে দেয়, তখন তাদের ইলিশীয় আবেগকে মহান বলে মনে হয়।
খাবার হোটেল-রেস্টুরেন্টের নামের সঙ্গে ইলিশ শব্দটির সংযোজন বাঙালির একটি স্বাভাবিক আচরণ। পদ্মার মাওয়া লঞ্চঘাটে গেলে অনেকগুলো খাবারের রেস্টুরেন্ট পাওয়া যাবে, যার প্রধান আকর্ষণ ইলিশ। এসব খাবার হোটেলের মধ্যে একটি বড় মানের হোটেল ‘মাওয়া ইলিশ হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট ও সুইটমিট’ দেখা যাবে। গত বছর খোদ ঢাকা শহরের বিজয়নগর এলাকায় ইলিশ হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট নামের একটা রেস্তোরাঁয় গিয়েছিলাম। ওহ! কী দারুণ তাদের ইলিশীয় আয়োজন আর রেসিপির স্বাদ।
ইলিশ এমনই এক মহাশয়, যাকে ঘিরে যেমন শতাধিক পদের রেসিপি তৈরি হয়েছে, তেমনি কতগুলো বিখ্যাত পুস্তকের নামের সঙ্গে ইলিশ যুক্ত হয়ে ইলিশকে করেছে মৎস্যকুলের সাহিত্যসম্রাট। যেমন ইলিশ, ইলিশপুরাণ, ইলিশ-মঙ্গলকথা, কল্পেগল্পে ইলিশ, যাপনে-উদযাপনে ইলিশ, ইলিশের বাড়ি, ইলিশজোড়, ইলিশমারির চর, তোমার ইলিশ আমার ইলিশ, চাঁদের বুড়ির পান্তা ইলিশ, কালো ইলিশ, ভূতে নিল ইলিশ মাছ, ইলিশ রেসিপি, ইলিশরান্না, নকশা: ১০০ রান্না ইলিশ প্রভৃতি।
‘ইলিশমারি নীলকুঠি’ প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে অত্যাচারের যে গল্প শুরু হয়েছিল, তার দেয়াল ভেঙে ইলিশ নিজ গুণে সারা পৃথিবীতে বিরল সব ইতিহাস তৈরি করেছে। একটি মাছের নামে এত নাম, এত আয়োজন আর এত সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গ তাবৎ দুনিয়ায় আর দুটি খুঁজে পাওয়া যাবে না। ছোট্ট একটি বাড়ি কিংবা রাস্তার পাশে মন্দিরের নামের সঙ্গে ইলিশ শব্দটির সংযোজনে হৃদয়ে যে আবেগ অনুরণিত হয়, তা ধর্ম-বর্ণ ও শ্রেণিবৈষম্যের অনেক ঊর্ধ্বে।
‘ইলিশমারি নীলকুঠি’ প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে অত্যাচারের যে গল্প শুরু হয়েছিল, তার দেয়াল ভেঙে ইলিশ নিজ গুণে সারা পৃথিবীতে বিরল সব ইতিহাস তৈরি করেছে। একটি মাছের নামে এত নাম, এত আয়োজন আর এত সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গ তাবৎ দুনিয়ায় আর দুটি খুঁজে পাওয়া যাবে না। ছোট্ট একটি বাড়ি কিংবা রাস্তার পাশে মন্দিরের নামের সঙ্গে ইলিশ শব্দটির সংযোজনে হৃদয়ে যে আবেগ অনুরণিত হয়, তা ধর্ম-বর্ণ ও শ্রেণিবৈষম্যের অনেক ঊর্ধ্বে।
শত শত বছরের ইলিশ নামকরণের এসব ইতিহাস বাঙালিকে এক মহান ঐতিহ্যের সারথি তৈরি করেছে। ইলিশ নামে নামকরণের ইতিহাসের এই পদযাত্রা বাঙালি আগামী দিনেও তাদের স্বাভাবিক রীতির মধ্যে দিয়ে বয়ে নিবে যাবে, সেটা আশা করা যায়।
লেখক: মৎস্য বিশেষজ্ঞ, খুলনা।