মেডিকেল ফিজিকস বা চিকিৎসা পদার্থবিজ্ঞানকে বলা যায় পদার্থবিজ্ঞানের একটি ফলিত শাখা। এই শাখার মূল উদ্দেশ্য হলো বিভিন্ন রোগনির্ণয়, প্রতিরোধ ও চিকিৎসাপ্রক্রিয়ায় পদার্থবিজ্ঞানের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করা।
একটি জরিপ অনুযায়ী, ক্যানসার চিকিৎসার ৬০-৭০ শতাংশ রোগী কোনো না কোনো পর্যায়ে রেডিওথেরাপির আওতায় আসেন। রেডিওথেরাপি একটি জটিল প্রক্রিয়া, যা বাস্তবায়নের জন্য রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট, মেডিকেল ফিজিসিস্ট ও রেডিওথেরাপি টেকনোলজিস্ট—একটি দল হিসেবে কাজ করেন। এখানে প্রত্যেকের দায়িত্ব খুব সূক্ষ্মভাবে নির্ধারিত। মেডিকেল ফিজিসিস্টরা ক্যানসার চিকিৎসার এই জটিল প্রক্রিয়া সঠিকভাবে কার্যকর করার পেছনে বড় ভূমিকা রাখেন।
আন্তর্জাতিক মেডিকেল ফিজিকস সংস্থা (আইওএমপি) প্রতিবছর ৭ নভেম্বর দিনটিকে আন্তর্জাতিক মেডিকেল ফিজিকস দিবস (আইডিএমপি) হিসেবে পালন করে। মেডিকেল ফিজিসিস্ট পেশার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোই এর উদ্দেশ্য। বিখ্যাত নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী মারি কুরির জন্মদিন ৭ নভেম্বর, তাই এই দিন বেছে নেওয়া। রেডিওঅ্যাকটিভিটি নিয়ে গবেষণার মাধ্যমে এই পদার্থবিদ আধুনিক রেডিয়েশন চিকিৎসার ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন।
মেডিকেল ফিজিসিস্ট হিসেবে কাজ করতে চাইলে ফলিত পদার্থবিজ্ঞান ও জীববিজ্ঞানের জ্ঞান ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা থাকা জরুরি। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী, মেডিকেল ফিজিকসে দুই বছরের মাস্টার্স ডিগ্রি করে এ পেশায় প্রবেশ করা যায়। বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন মেডিকেল ফিজিকসে মাস্টার্স প্রোগ্রাম চালু হয়েছে, যা তরুণদের জন্য একটি বড় সুযোগ। এ ছাড়া উচ্চশিক্ষার জন্য ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র ও এশিয়ার বিভিন্ন উন্নত দেশে বৃত্তির সহায়তায় পিএইচডি বা পোস্টগ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি লাভের সুযোগ আছে।
রেডিয়েশন থেরাপি, নিউক্লিয়ার মেডিসিন ও ডায়াগনোস্টিক রেডিওলজি—এই তিন বিভাগে মেডিকেল ফিজিসিস্টদের বড় ভূমিকা আছে। রেডিয়েশন থেরাপি বিভাগে তাঁরা বিভিন্ন যন্ত্র নির্বাচন, বিকিরণ উৎসের সঠিক ব্যবহার, মাননিয়ন্ত্রণ ও সুরক্ষা কর্মসূচিতে যুক্ত থাকেন। পাশাপাশি তাঁরা ব্র্যাকিথেরাপির সময় বিকিরণ উৎসের সঠিক মাননিয়ন্ত্রণ ও নিশ্চিতকরণ এবং রেডিয়েশন অনকোলজিস্টদের পরামর্শে রেডিওথেরাপি রোগীদের সঠিক চিকিৎসাপরিকল্পনা তৈরি করেন।
মেডিকেল ফিজিসিস্টরা রোগীর শারীরিক অবস্থার ওপর ভিত্তি করে সিটি স্ক্যান ও অন্যান্য ইমেজিং প্রযুক্তির সহায়তায় প্রয়োজনীয় স্থানে সুনির্দিষ্ট রেডিয়েশনের মাত্রা বণ্টন করেন, যাতে আশপাশের সুস্থ কোষের ক্ষতি না করে ক্যানসার কোষ ধ্বংস করে। সঠিক চিকিৎসা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মেডিকেল ফিজিসিস্টরা বিভিন্ন চিকিৎসা সরঞ্জামের নকশা করেন। রেডিওথেরাপি বিভাগ ছাড়াও নিউক্লিয়ার মেডিসিন ও ডায়াগনস্টিক রেডিওলজি বিভাগে মেডিকেল ফিজিসিস্ট ও রেডিয়েশন কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করেন। সাধারণভাবে, মেডিকেল ফিজিসিস্টরা ইমেজিং, বিকিরণ চিকিৎসা ও বিকিরণ সুরক্ষার সব বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত দিক দেখভাল করেন।
বিশ্বজুড়ে ক্যানসার চিকিৎসার চাহিদা ও জটিলতা বাড়ার কারণে দক্ষ মেডিকেল ফিজিসিস্টের প্রয়োজনীয়তাও বাড়ছে। আমাদের দেশেও এখন ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীদের সব ধরনের উন্নত চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। প্রয়োজন শুধু সঠিক চিকিৎসক, দক্ষ মেডিকেল ফিজিসিস্ট ও মানসম্মত হাসপাতাল।
তাই ক্যানসার চিকিৎসায় মেডিকেল ফিজিসিস্টদের অবদানের স্বীকৃতি দেওয়া এবং তাদের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো খুব প্রয়োজন, যেন এ পেশার প্রতি তরুণেরা আরও বেশি করে আগ্রহী হন। তাহলে দেশেই আমরা আরও উন্নতমানের স্বাস্থ্যসেবা পাব।
লেখক: মেডিকেল ফিজিসিস্ট ও রেডিয়েশন কন্ট্রোল অফিসার, ল্যাবএইড ক্যানসার হাসপাতাল অ্যান্ড সুপার স্পেশালিটি সেন্টার; সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ মেডিকেল ফিজিকস সোসাইটি (বিএমপিএস)