মেটালিকার প্রিয় গানটা উঁচু ভলিউমে বাজিয়ে ক্যালকুলাসের হিসাব মেলাচ্ছিলেন জোহায়রা পৃথুলা। হঠাৎ মায়ের চিৎকার, ‘পড়াশোনা হচ্ছে? নাকি গান শোনা?’ বিশ্ববিদ্যালয়ে ওঠার পর প্রায় চার বছর পেরিয়ে গেছে। এখনো পৃথুলা বাসায় বোঝাতে পারেননি, গান শুনতে শুনতে পড়লে তাঁর মনোযোগ আরও বাড়ে।
এই মতবাদ পৃথুলার একার নয়। গান শুনতে শুনতে পড়ালেখা ভালো হয়, এমনটা মনে করেন অনেক শিক্ষার্থীই। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনলাইন বিশ্ববিদ্যালয় সিএসইউ গ্লোবালের পক্ষ থেকে ওয়ান পোলের করা একটি গবেষণায় সম্প্রতি এ-ও উঠে এসেছে যে গান শুনতে শুনতে পড়ালেখা করা শিক্ষার্থীদের সিজিপিএ তুলনামূলক ভালো! সত্যিই কি তা–ই?
এ নিয়ে কিন্তু আগেও বিস্তর গবেষণা হয়েছে। মনোবিজ্ঞানী ফ্রান্সিস রাউশার ১৯৯৩ সালে ৩৬ বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষার্থীকে নিয়ে একটি ‘এক্সপেরিমেন্ট’ করেন। তাঁদের ১০ মিনিট মোজার্টের পিয়ানো সোনাটা শোনানোর পর যুক্তিবিদ্যার একটি পরীক্ষা নেওয়া হয়। আরেক দলের একই পরীক্ষা নেওয়া হয় ১০ মিনিট নীরবতার পর। দেখা যায় একই পরীক্ষায় মোজার্ট শোনা দলটি অন্য দলের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে ভালো করেছে। সেই থেকে ‘মোজার্ট এফেক্ট’ কথাটির চল হয়। মোজার্ট এফেক্ট দাবি করে—ক্ল্যাসিক্যাল সংগীত শুনলে মানুষের যুক্তিবিদ্যার দক্ষতা বেড়ে যায়।
তবে শুধু যে ভালো দিকই আছে, তা নয়। অস্ট্রেলিয়ার ওলংগং বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় দেখা যায়, গানের মধ্যে কথা থাকলে তা মনোযোগ নষ্ট করে। কারণ, পড়াশোনার সময় আমরা আমাদের ‘কার্যকর স্মৃতি’ ব্যবহার করি। একই সময়ে আমাদের মাথায় হাজারটা তথ্যের টুকরো খেলাধুলো করে। পড়াশোনা এমন একটা কাজ, যেখানে তীব্র মনোযোগ প্রয়োজন। সেটার সঙ্গে গান শোনা হলে গানের কথা এই ‘কার্যকর স্মৃতি’কে কিছুটা দমিয়ে দিতে পারে। ফলে কমে যায় মস্তিষ্কের অনুধাবন ও ধারণক্ষমতা।
কিন্তু একই গবেষণার অপর দিকটা আবার অন্য কথা বলছে। যেহেতু গান শোনাটা একটা বিনোদনমূলক কাজ, মন খুশি থাকার কারণে আরও পরিশ্রম করার প্রেরণা আসে গান থেকে। তাই বলা যায়, গান আমাদের মেজাজ ভালো করে বলেই পড়াশোনার ফলটা ভালো পাওয়া যায়।
গবেষণা যা-ই বলুক, শিক্ষার্থীরা কী বলছেন? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস প্রকৌশলের শিক্ষার্থী জোহায়রা পৃথুলার সোজাসাপটা বক্তব্য, ‘ছোটবেলা থেকেই আমার মনোযোগ ধরে রাখতে সমস্যা হয়। পড়ার সময় যখন গান শুনি, তখন পড়াশোনা ব্যাপারটাই অনেক সহজ হয়ে যায়।’ যদিও গবেষণা বলে, দ্রুত তাল–লয়ের এবং উঁচু স্বরে গান শুনলে মনোযোগ কমে, পৃথুলার ক্ষেত্রে নাকি এই সূত্র খাটে না। তিনি জোরে গান শুনতেই বেশি পছন্দ করেন। আহছানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাতুল আহমেদ আবার শুধু সংগীতপ্রেমী নন, নিজেও বাদক। কিন্তু পড়ালেখার সময় গান শোনাটা তিনি সমর্থন করেন না। বললেন, ‘আমার মনে হয়, পড়াশোনা আর সংগীত দুটো আলাদা। পড়ার সময় গান না শুনলেও ল্যাব রিপোর্ট লেখার সময় শুনতাম। কারণ, রিপোর্ট লেখার কাজটা বেশ একঘেয়ে।’
শিক্ষার্থীদের কথা শুনে মনে হলো, গানের ক্ষেত্রে যেমন মানুষের পছন্দ আলাদা, পড়ালেখার ধরনের বেলায়ও তা–ই। কেউ নিস্তব্ধতা ছাড়া মনোযোগ নিবিষ্ট করতে পারেন না। কারও আবার পড়ালেখার আবহ সংগীত হিসেবে গানের সুরটাই পছন্দ। তাই এ প্লাস বি হোলস্কয়ার সূত্রের মতো পড়ালেখার সঙ্গে গান শোনার সম্পর্কটা ঠিক সূত্রে বেঁধে ফেলা যায় না। তবে বছরের পর বছর গবেষণা থেকে এটা মোটামুটি নিশ্চিত করে বলা যায়—গানের সঙ্গে আর কিছু হোক বা না হোক, মন ভালো হওয়ার একটা সম্পর্ক আছে।