বিজ্ঞাপন দিয়েও বন্ধুদের খুঁজে পেলেন না ৮৫ বছরের মজিদ, আজ চলে যাচ্ছেন অস্ট্রেলিয়ায়

আবদুল মজিদ
ছবি: সংগৃহীত

এ যেন নাটক বা সিনেমার গল্প। এই গল্পের শুরু পত্রিকায় ছাপা হওয়া একটি বিজ্ঞাপন ঘিরে। ৮৫ বছর বয়সের আবদুল মজিদ বিজ্ঞাপন দিয়ে বন্ধুদের খুঁজে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছিলেন। চেয়েছিলেন, শেষ জীবনের কিছুটা সময় প্রিয় সেই সোনালি দিনের বন্ধুদের সান্নিধ্যে কাটাবেন। প্রাণ খুলে দুটো কথা বলবেন। বিজ্ঞাপন ছাপা হওয়ার পর চার মাস ধরে আশা নিয়ে প্রতিদিন তিনি মুঠোফোন হাতে নিয়ে বসে থেকেছেন। প্রিয় মুখগুলো এখনো আছেন কি না, থাকলে কেমন আছেন, সে খবর আসেনি। অবশেষে কিংবা আপাতত আশা ভঙ্গই হলো আবদুল মজিদের। তাই আজ শুক্রবার রাতে তিনি বরিশাল ছেড়ে চলে যাচ্ছেন অস্ট্রেলিয়ায়।

৮৫ বছর বয়সী আবদুল মজিদের সঙ্গে কথা হয় গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে, মুঠোফোনে। কথা বলার সময় তিনি নিজের জামাকাপড় গোছগাছ করছিলেন। তিনি জানান, বৃষ্টির মধ্যে কথা পরিষ্কার বুঝতে পারছেন না। তারপরও কথা চালিয়ে গেলেন। ফোনের ওপাশ থেকে হঠাৎ আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলেন, ‘কাউকে কি পাইছেন? অনেকেই ফোন দিতেছেন, কিন্তু বন্ধুদের তো পাইতেছি না। আপনি কে?’

সাংবাদিক পরিচয় জেনে কিছুটা হতাশা প্রকাশ করে বলেন, ‘চার মাস আগে পয়লা রমজানে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলাম। কিন্তু কোনো সাড়া পাইনি। বিজ্ঞাপনে ফোন নম্বর দিয়েছিলাম, সেই নম্বর দেখে অনেকেই কৌতূহলী হয়ে ফোন দিচ্ছেন। কিন্তু কেউ বন্ধুদের প্রসঙ্গে কোনো তথ্য দিতে পারছেন না। খুব ইচ্ছা ছিল, শেষ বয়সে দু-একজন বন্ধু হলেও তাদের সঙ্গে দেখা করে যেতে পারব। সেই ইচ্ছা পূরণ হবে কি না, জানি না। আল্লাহ সবকিছুর পরিকল্পনাকারী। তিনিই ভালো জানেন।’

চার মাস আগের সেই বিজ্ঞাপনে লেখা ছিল, ‘পুরোনো দিনের বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাই। আলাউদ্দিন সাহেব (এসপিআইটি পাকিস্তান) লন্ডনের মান্নান সাহেবের পুরোনো বন্ধু, রেহেনা ভাবি টাঙ্গাইল। সূচরিতা দিদি, আব্বাস সাহেব রাজশাহী, হান্নান সাহেব পাবনা (সইছে), মনির সাহেব নোয়াখালী, নুরুল ইসলাম তালপুকুরপাড় কুমিল্লা।’

আবদুল মজিদের দেওয়া সেই বিজ্ঞাপন

আবদুল মজিদ বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। নব্বইয়ের দশকে তিনি অবসরের যান। চাকরির সুবাদে আশির দশকে লিবিয়ায় ১০ বছর দায়িত্ব পালন করেন। সেখানেই তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে।

আবদুল মজিদ বলেন, ‘আমরা সবাই অনেক দিনের সহকর্মী ছিলাম। আমরা লিবিয়াতে ১০ বছর কর্মরত ছিলাম। একসঙ্গে অনেক সময় কেটেছে। নব্বইয়ের দশকের শেষে আমি অস্ট্রেলিয়ায় চলে যাই। সে সময় তো মোবাইল ছিল না। তারপর ৩০ বছর আমাদের দেখা নেই। আমাদের বন্ধুত্ব ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। আমাদের আন্তরিকতা খুবই ভালো ছিল। একটা পরিবারের মতো ছিলাম। মন চেয়েছিল, তাদের সঙ্গে দেখা করে কথা বলতে।’

নব্বইয়ের দশকে আবদুল মজিদ লিবিয়া থেকে দেশে এসে আবার চলে যান অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে। সেখানে তাঁর দুই মেয়ে ও এক ছেলে থাকেন। অস্ট্রেলিয়া থেকেই চার মাস আগে দেশে ফিরেছিলেন আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করতে। এসেই বন্ধুদের খোঁজ করতে থাকেন। এর মধ্যেই তাঁর সময় কেটে যায়। তিনি বলেন, ‘এমন ঘটনা তো দেখি। বিজ্ঞাপন দিয়ে বন্ধু বা আত্মীয়দের খুঁজে পায়। যে কারণে আমিও চেষ্টা করেছিলাম। কী আর করার, পাওয়া গেল না। আমি ঢাকায় যাব। আগামীকাল (আজ) রাতের ফ্লাইটে অস্ট্রেলিয়ায় যাচ্ছি। আপনারা যদি কাউকে খুঁজে পান, আমাকে জানাবেন। বিজ্ঞাপনের নিচে আমার ও আমার ভাতিজার নম্বর দেওয়া আছে। আমাকে না পেলে ভাতিজাকে ফোন করলেও হবে।’

আবদুল মজিদের ভাতিজার নাম সালাউদ্দিন আহমেদ। গতকাল তিনি জানান, চার মাস আগে বিজ্ঞাপন দিলেও দুই দিন ধরে ফোনের জ্বালায় অতিষ্ঠ। অনেকে শুধু শুধু ফোন দিয়ে বিরক্ত করছেন। সালাউদ্দিন বলেন, ‘আমার চাচা সহজ–সরল মানুষ। মনটা ভালো। না হলে এই যুগে বন্ধু খুঁজতে কেউ ২০ হাজার টাকা খরচ করে? আমরা ‘‘না’’ করছিলাম, কিন্তু তিনি শোনেননি। এটা ইমোশনাল একটা ব্যাপার। এই বয়সে তাঁর মন খুলে কথা বলার কেউ নেই। তিনি আমাদের পরিবারের সিনিয়র। তাঁকে সবাই আমরা সম্মান করি। তিনি দেশে এলে আমাদের সঙ্গেই থাকেন।’

আজ সকালে সালাউদ্দিনের সঙ্গে মুঠোফোনে আবার কথা হয়। জানান, এখনো কাউকে খুঁজে পাননি। তাঁর চাচা আজ চলে যাচ্ছেন। কিছুটা মন খারাপ। তিনি বলেন, ‘বন্ধুদের খোঁজাখুঁজির ব‍্যাপারে চাচার সঙ্গে প্রতিদিন কথা হতো। আমি এটাও বলেছি, তাঁদের কারও বয়স ৮৫ বছর, কারও ৮০-এর বেশি। তাঁরা এখন বেঁচে না-ও থাকতে পারেন। এসব শুনে চাচা মন খারাপ করেন। তাঁদের কাউকেই পাইনি। আমার নম্বর দেওয়া আছে। আমি দেশে আছি। কোনো খবর পেলে চাচাকে জানিয়ে দেব।’