৩২ বছর বয়সী হুইটনি ওল্ফ হার্ড বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ বিলিয়নিয়ার নারী উদ্যোক্তা। জনপ্রিয় ডেটিং অ্যাপ টিন্ডারের বিপণন বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ২০১৪ সালে টিন্ডার থেকে বেরিয়ে শুরু করেন নিজের অনলাইন ডেটিং প্ল্যাটফর্ম ‘বাম্বল’। ২০১৭ সালে ফোর্বসের ‘থার্টি আন্ডার থার্টি’ তালিকায় নাম ওঠে তাঁর। ২০১৮-তে টাইম সাময়িকীর বিবেচনায় বিশ্বের ১০০ প্রভাবশালী মানুষের মধ্যেও তিনি ছিলেন। ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের এই সফল উদ্যোক্তা তাঁর নিজের ক্যাম্পাস—সাউদার্ন মেথোডিস্ট ইউনিভার্সিটির সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দেন। পড়ুন সেই বক্তৃতার অংশবিশেষ।
মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলার ব্যাপারে সব সময়ই আমার ভীষণ ভয় ছিল। ভাবলেই দুঃস্বপ্নের মতো লাগত। বলে নয়, লিখে মনের কথাগুলো প্রকাশ করব—এই ভাবনা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি চিত্রনাট্য লেখার ক্লাসে যোগ দিই। ক্লাসটা ভীষণ উপভোগ করতাম। কিন্তু এক সময় জানতে পারলাম, এই কোর্সে পাশ করার জন্য আমাকে ক্লাসের সবার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের লেখা স্ক্রিপ্টটা পড়ে শোনাতে হবে।
এটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমার হাত-পা ভয়ে ঠান্ডা হয়ে গেল। আমি পরীক্ষায় ফাঁকি দেওয়ার জন্য একটা বুদ্ধি করলাম। আমি যে ‘পাবলিক স্পিকিং’-এর জন্য শারীরিক ও মানসিকভাবে সক্ষম নই, এটা প্রমাণ করার জন্য একজন ডাক্তারের থেকে একটা নোটও লিখিয়ে আনলাম। মনে মনে খুব চাইছিলাম যেন আমাকে সবার সামনে কথা বলার পরীক্ষাটা দিতে না হয়। কিন্তু আমার স্ক্রিনরাইটিং কোর্সের শিক্ষক ওই নোট আমলেই নিলেন না। দেখলাম, তিনি আমার ওপর আমার চেয়েও বেশি ভরসা করছেন। তিনি বললেন, ‘তুমি পারবে, চেষ্টা করো।’
তাঁর আস্থা দেখে নিজেকে বোঝালাম, ভয় মোকাবিলা করলাম আর সবার সামনে দাঁড়িয়ে আমার স্ক্রিপ্ট পড়লাম। সেই কোর্সে আমি ‘এ’ পেয়েছিলাম। আর সেদিনের শিক্ষক কেলি হার্ড আজকের এই সমাবর্তন অনুষ্ঠানেও উপস্থিত আছেন। বলে রাখি, আমার এই প্রিয় শিক্ষক আজ আমার শাশুড়ি এবং আমার সন্তানের দাদি। কে জানত, আমার ওপর তাঁর সেদিনের সেই বিশ্বাস আর আস্থা আমাকে এত দূর নিয়ে আসবে! তাঁর কারণেই আমি এখনো জ্ঞান না হারিয়ে, নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে তোমাদের সামনে বক্তৃতা দিতে পারছি।
এখনো প্রতিনিয়ত নানা ধরনের ভয়, প্রতিকূলতা, সংশয় আমাকে চেপে ধরে। কিন্তু আমি আমার শিক্ষকের একটা কথাই মনে করি, ‘নিজের ওপর আস্থা রাখো, নিজেকে বিশ্বাস করো।’ আমি সেটাই করে যাই।
আমাকে যখন বলা হলো, সমাবর্তন অনুষ্ঠানের বক্তা হতে হবে; আমি আর সব নতুন বক্তার মতো ‘সর্বকালের সেরা সমাবর্তন বক্তৃতা’ গুগল করা শুরু করলাম। কয়েক সপ্তাহ রীতিমতো গবেষণা করে খুব চিন্তায় পড়ে গেলাম। আমি কীভাবে অ্যাডমিরাল ম্যাকরেভেনের মতো এত সুন্দর করে বলব, ‘পৃথিবীকে বদলাতে চাইলে সবার আগে নিজের বিছানাটা গুছিয়ে বদলের শুরু করো।’ কিংবা স্টিভ জবসের মতো কীভাবে এত সুন্দর করে স্বপ্ন সত্যি করার তাগিদ দেব? কীভাবে!
যখন ভাবতে ভাবতে দিশেহারা অবস্থা, তখনই আমি আমার বক্তৃতা গুছিয়ে ফেলি। অনেক দেখে, শুনে, পড়েও আমি অন্য কারও বক্তৃতা অনুসরণ করিনি। আমি কখনোই অন্য কারও দেখানো পথে চলিনি, এবারও তাই। তোমাদেরও অন্য কারও পথ অনুসরণের প্রয়োজন নেই। তুমি নিজেকে তোমার মতো করে তৈরি করো। তুমি তোমার মতো হও। সামনের দিনগুলোতে পদে পদে তোমাকে উপদেশ শুনতে হবে—বড়দের কথা, সহকর্মীর কথা, সিনিয়রদের কথা, পরিবারের কথা। অনেকেই বলবে—‘এর মতো হও’, ‘ওর মতো হও’, কিংবা ‘আমার মতো হও’। কিন্তু আমি বলতে চাই, তুমি নিজের মতো হও।
আমি তোমাদের হাতে আজ কোনো সাফল্যের মন্ত্র ধরিয়ে দিতে আসিনি। আমি শুধু বলব আমার জীবনের ৪টি শিক্ষার কথা, যেগুলো আমি এই পর্যায় পর্যন্ত আসতে গিয়ে পদে পদে শিখেছি।
প্রথমত নিজের ওপর আস্থা রেখে, নিজের মতো করে এগিয়ে যাও। নিন্দুকেরা নানা কথা দিয়ে তোমাকে থামতে চাইবে। আমাকেও চলার পথে অনেক অনেক কথা শুনতে হয়েছে, এখনো হয়। কিন্তু আমি ওসব থেকেই আরও বেশি করে এগোনোর তাগিদ পাই। এই ক্যাম্পাসে আমি যখন প্রথম টিন্ডার নিয়ে আসি, আমাকে বলা হলো—এসব অ্যাপ কোনো দিন চলবে না। এরপর যখন আমার নিজের অ্যাপ বাম্বল আনলাম, তখন বলা হলো—‘টিন্ডার থাকতে আরও একটা ডেটিং অ্যাপ দিয়ে কী হবে?’ ‘এই অ্যাপ কোনো দিন সফল হবে না।’ ‘মেয়েদের হাতে সম্পর্কের হিসাব-নিকাশ বা সিদ্ধান্ত নেওয়া দায়িত্ব দেওয়াটা বোকামি’। আমি এই কথাগুলোকে অনুপ্রেরণা হিসেবে নিলাম, এগিয়ে যেতে থাকলাম, নিজের ওপর বিশ্বাস রাখলাম। আর এভাবেই আজ তোমাদের সামনে এসে দাঁড়ালাম।
পৃথিবীর সবকিছুই ভয়ের মনে হবে, যতক্ষণ না তুমি এর মোকাবিলা করছ। ঠিক যেমনটা মানুষের দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দেওয়া আমার কাছে ভয়ংকর মনে হতো। পালের সঙ্গে মিশে যাওয়া সহজ, স্রোতের সঙ্গে এগিয়ে যাওয়া সহজ, কিন্তু নিজের মতো করে নিজের পথ তৈরি করে নেওয়াই সাহসিকতা। এই সাহস দেখানোর জন্য প্রতিদিন নিজের ভয়গুলোর দিকে চোখে চোখ রেখে তাকাতে হয়, মোকাবিলা করতে হয়।
প্রতিদিনই আমরা কোনো না কোনোভাবে, কারও না কারও জীবনে একটু হলেও প্রভাব ফেলি। চেষ্টা করো সেই প্রভাব যেন ওই ব্যক্তির, ওই প্রতিষ্ঠানের ভালোর জন্য হয়। তোমার প্রভাব যেন ইতিবাচক হয়। সহানুভূতি সুযোগের সৃষ্টি করে। কখনোই অন্যের ভালো করার সুযোগ হেলায় হারিয়ো না। পৃথিবী তোমাকে শেখাবে শক্ত হতে, দৃঢ় হতে, কঠোর হতে—ওসব কানে নিয়ো না। পরিস্থিতি কঠিন হলেও সত্যের সঙ্গে থাকো—সহানুভূতিশীল হওয়ার সবচেয়ে সহজ পথ এটাই। প্রতিটি ভালো কাজ তোমার কাছে ফেরত আসবেই।
স্বপ্ন পূরণের প্রথম শর্তই হলো, ওই স্বপ্ন নিয়ে কাজে নেমে পড়তে হবে। স্বপ্নপূরণের কোনো জাদুর ছড়ি নেই, কোনো মন্ত্র নেই। কিন্তু সব স্বপ্নই সত্যি হওয়া সম্ভব, শুধু শুরুটা করতে হবে। ২০১০ সালে আমি কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ বিক্রির মধ্য দিয়ে আমার প্রথম ব্যবসা শুরু করি। যদিও সেটা বাম্বলের মতো সফল হয়নি। কিন্তু ওই ব্যবসা দিয়ে আমি শিখতে শুরু করেছিলাম, বুঝতে শুরু করেছিলাম। আর সেই শুরুর কারণেই আজ বাম্বল অ্যাপ ডাউনলোডের সংখ্যা ১০ কোটি ছাড়িয়েছে। প্রায়ই রাতে আমি আমার ছেলেকে একটা বই পড়ে শোনাই। ওই বইয়ে একটা খুব সুন্দর উপদেশ বাক্য পেয়েছি—‘যেখানেই যাও না কেন, যা-ই করো না কেন, সাহসী হও, বড় স্বপ্ন দেখো। পৃথিবী তোমার অপেক্ষায় আছে।’ (সংক্ষেপিত)
সূত্র: সাউদার্ন মেথোডিস্ট ইউনিভার্সিটির ইউটিউব চ্যানেল