বাংলাদেশ টেলিভিশনে আশি-নব্বইয়ের দশকে সংবাদপাঠক হিসেবে বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন সালেহ আকরাম। গত ২২ ডিসেম্বর দিবাগত রাত আড়াইটায় রাজধানীর একটি হাসপাতালে মারা গেছেন তিনি। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। সালেহ আকরামের মৃত্যুশোকের সঙ্গে পুরোনো দিনের স্মৃতিও সামনে চলে এল। তিনি সেই সময়ের প্রতিনিধি, যে সময়টা এখন হারিয়ে খোঁজে অনেক মানুষ।
আশি-নব্বইয়ের দশক ছিল একেবারে অন্য রকম। দেশে তখন টেলিভিশন চ্যানেল ছিল একটিই—বিটিভি। বেতারের চ্যানেলও তা-ই—বাংলাদেশ বেতার। দুটিই সরকারি। মানুষের বেছে নেওয়ার কিছু নেই। সরকারি গণমাধ্যম যা দেখাবে, দেখতে হবে সেসবই। এখনকার ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে রিলস-স্টোরির যুগে অবিশ্বাস্যই বটে। কিন্তু এসব গণমাধ্যমই তৈরি করেছিল কিছু পরিচিত মুখ, কিছু প্রিয়মুখ, পরিচিত কণ্ঠস্বর। বিভিন্ন বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান কিংবা সংবাদ—মানুষ খুঁজে ফিরত তাঁদেরই।
বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের উপস্থাপকের পাশাপাশি সে সময় টেলিভিশনের অনুষ্ঠান ঘোষক কিংবা সংবাদপাঠকেরাও ছিলেন বড় তারকা। ঘড়ির কাঁটা ধরে টেলিভিশনের সামনে মানুষ বসে যেত তাঁদেরই মুখ দর্শনে কিংবা রেডিও চালু করত তাঁদের কণ্ঠ শোনার আশায়। সেই অবিশ্বাস্য, অন্য রকম সময়েরই এক মানুষ সালেহ আকরাম। ভরাট কণ্ঠের সংবাদপাঠক। সংবাদপাঠ ছাড়াও বিভিন্ন প্রামাণ্যচিত্রের ধারাবর্ণনা কিংবা সরাসরি সম্প্রচারিত খেলার ভাষ্যে ছিলেন নিয়মিত মুখ। তারকাখ্যাতিও স্বাভাবিকভাবে তাঁর ছিল।
এ প্রজন্ম হয়তো সালেহ আকরামকে চিনবে না, চেনার কথাও নয়। বিনোদনের মাধ্যম তো আর এখন একটি নয়। স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল কিংবা এফএম রেডিওর যুগও ফুরিয়ে যাওয়ার পথে। দুনিয়া এখন পুরোপুরি ডিজিটাল। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউবে মানুষ এখন বিনোদন খোঁজে। সংবাদ এখন আর শোনার জিনিস নয়, দেখার জিনিস। সালেহ আকরামরা যেমন কণ্ঠ ও উচ্চারণের মাধুর্য দিয়ে সংবাদকে গল্পের মতো করে জনসাধারণের সামনে তুলে ধরতেন, সেটির এখন আর প্রয়োজনই নেই। যেকোনো ঘটনারই কিছু ফুটেজ দেখিয়ে দিলেই হলো। সালেহ আকরামরা যখন খবর পড়তেন, তখন টেলিভিশন রিপোর্টিং বলে কিছু ছিল না। সংবাদপাঠকেরা টেলিপ্রিন্টারের দিকে তাকিয়ে সেখানে লেখা স্ক্রিপ্ট কত ভালোভাবে দর্শক-শ্রোতার সামনে তুলে ধরতে পারেন, ক্যারিশমা বলতে ছিল সেটিই।
কণ্ঠ আর উচ্চারণের ক্যারিশমা দিয়ে যিনি সবার মন জয় করেছিলেন, সেই সালেহ আকরাম পরপারে চলে গেলেন নীরবেই। তাঁর মৃত্যুসংবাদটি চাউর হওয়ার পর অনেকেই স্মৃতিকাতর। তাঁদের খুব করে মনে পড়ছে, রাত আটটার বাংলা সংবাদের আগে বিটিভির সেই সিগনেচার টিউন—‘আমরা তোমাদের ভুলব না’, আর তারপরই ভরাট কণ্ঠের সেই আওয়াজ—‘আসসালামু আলাইকুম! আমন্ত্রণ জানাচ্ছি রাত আটটার বাংলা সংবাদে। আপনাদের সঙ্গে আছি আমি সালেহ আকরাম।’
শুধু সংবাদ উপস্থাপনাই নয়, বিটিভিতে আশি ও নব্বইয়ের দশকে অনেক অনুষ্ঠানও উপস্থাপনা করেছেন সালেহ আকরাম। স্যুট-টাই পরা, স্টিলের ফ্রেমের চশমা চোখের সৌম্যদর্শন মানুষটিই এ দেশের একটা প্রজন্মের মানুষের মানসপটে বেঁচে থাকবেন আরও বহু বছর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্র ছিলেন তিনি, জন্ম ফরিদপুর জেলায়। সংবাদপাঠ তাঁর পেশা ছিল না, ছিল শখের বিষয়। এ কারণেই হয়তো সর্বোচ্চ আন্তরিকতা ছিল তাতে। বহু বছর বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়া মানুষটি মৃত্যুর মাধ্যমেই নিজের অস্তিত্ব তুলে ধরলেন সবার সামনে।
সে সময় হুমায়ুন ফরীদি, আফজাল হোসেন, সুবর্ণা মুস্তাফারা হয়তো বিনোদনজগতের বড় তারকা ছিলেন; রাজ্জাক, শাবানা, আলমগীর, ববিতা, জাফর ইকবালরা ছিলেন রুপালি পর্দায়। এই তারকাদের আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তার সঙ্গে হয়তো সালেহ আকরামরা ‘বড় তারকা’ ছিলেন না; কিন্তু তাঁদের ব্যাপক পরিচিতি ছিল। সে সময়ের টিভি দর্শকেরা একনিশ্বাসে বেশ কয়েকজন সংবাদপাঠকের নাম বলে ফেলতে পারতেন—সেরাজুল মজিদ মামুন, আসমা আহমেদ মাসুদ, মাহমুদুর রহমান, শামীম আহমেদ, মুনমুন আহমেদ, রাশিদা মহিউদ্দিন, সালেহ আকরাম, আমিনুল হক, নাফিজ ইমতিয়াজউদ্দিন, আফজাল এইচ খান...এমন আরও অনেকেই। এঁদের বেশির ভাগই সাংবাদিক ছিলেন না। অন্যান্য পেশায় থেকেই তাঁরা মনের আনন্দে সংবাদ উপস্থাপনায় এসেছিলেন। দেশের ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ এসব মানুষের কণ্ঠে প্রচারিত হয়েছে।
বিনোদনজগতের তারকাদের মতো না হলেও একধরনের তারকাখ্যাতি সংবাদ উপস্থাপকদেরও গড়ে উঠেছিল আশি ও নব্বইয়ের দশকে। বিভিন্ন ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে তাঁরা ডাক পেতেন বিনোদনমূলক অংশের জন্য। বিটিভির দর্শকেরা অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করত, সংবাদপাঠের বাইরে তাঁদের সামর্থ্য, তাঁদের প্রতিভা। কেউ কেউ আবৃত্তি করতেন ভালো, কেউ কেউ সরাসরি সম্প্রচারিত খেলার ধারাভাষ্য দিতেন দুর্দান্ত। সালেহ আকরাম যেমন বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানও উপস্থাপনা করেছেন, ধারাবর্ণনা করেছেন বিভিন্ন প্রামাণ্য অনুষ্ঠানেরও। বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে মাইক্রোফোনের নেপথ্যে ঘোষণার কাজগুলো সে সময় বিটিভির সংবাদ উপস্থাপকদের উপস্থিতি থাকত একচ্ছত্রই। আয়োজকেরাও বিটিভির সংবাদ উপস্থাপকদের আমন্ত্রণ জানিয়ে ধন্যই হতেন।
বয়সে ছোট হলেও সালেহ আকরামের সময়ই বিটিভিতে ইংরেজি সংবাদ উপস্থাপনে পরিচিত মুখ ছিলেন মাহমুদুর রহমান। সতীর্থ সংবাদপাঠকের স্মৃতিচারণ করে তিনি বললেন, ‘বহু বছর ধরে তাঁকে চিনি। বিটিভি আর বেতারে বহু আড্ডা হয়েছে সালেহ ভাইয়ের সঙ্গে। উনি উচ্চারণ নিয়ে খুব খুঁতখুঁতে ছিলেন। বিদেশি নাম, শব্দের উচ্চারণ জেনে নিতেন। তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল অসাধারণ। ক্রিকেট ধারাভাষ্য নিয়েও তাঁর খুব আগ্রহ ছিল। এসব নিয়ে বহু আড্ডা হয়েছে।’
বিটিভিতে সালেহ আকরামকে শেষবারের মতো দেখা গেছে সম্ভবত ২০০৬ সালে। তারপর কিছুদিন বুলেটিন পড়েছেন বিবিসির সান্ধ্যকালীন অধিবেশনে। তবে মৃত্যুর আগে বহুদিন ধরেই ছিলেন লোকচক্ষুর আড়ালে। আগেই বলেছি, বিস্মৃতির অতলে থেকেই তিনি চলে গেলেন পরপারে।
সালেহ আকরামের মৃত্যুশোকের সঙ্গে সেই অদ্ভুত সময়ের স্মৃতিও সামনে চলে এল। তিনি সেই সময়ের প্রতিনিধি, যে সময়টা এখন হারিয়ে খোঁজে অনেক মানুষ।