আপনি হয়তো অচেনা কারও কাছে একটা কিছু চাইছেন; আর ওই ব্যক্তি তখন সেই জিনিসটাই ব্যবহার করছেন। চেনা নেই, জানা নেই, কেন তিনি আপনাকে সেই জিনিসটা দেবেন, বলুন তো? কেবল আপনার ভাষার জন্যই। যেমন একটা শব্দ আছে, যা অনুরোধের সময় ব্যবহার করলে ইতিবাচক সাড়া পাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এটি কিন্তু মনগড়া কথা নয়; খোদ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার ফলাফল—
ভাষার শক্তি প্রবল। আবার ক্ষেত্রবিশেষে ভাষা বড্ড দুর্বলও। একই ভাষার শক্তির এমন তারতম্য কিন্তু ঘটে কেবল ভাষার প্রয়োগের কারণেই। সাদামাটা একটি কথা আপনি বলতে পারেন নানাভাবেই। কীভাবে বলা হলো তা শ্রোতার ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলবে, সেটিই ভাবনার বিষয়। রোজকার জীবনে যে কারও সঙ্গে কথা বলার সময় হোক, কিংবা হোক কোনো গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে, ভাষার ব্যবহারে একটু হেরফের হলে পরিবেশটাই বদলে যায়। আপনার ভাবনাগুলো নিশ্চয়ই সুন্দর। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের হোয়ারটন স্কুল অব দ্য ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ার অধ্যাপক জোনাহ বার্জারের মতে, গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ভাবনাকে শব্দে রূপান্তর করা। অন্যের সামনে আপনার সুন্দর ভাবনা ঠিক সেভাবেই উপস্থাপন করতে না পারলে কিন্তু আপনার মনের সেই সৌন্দর্য কেউ উপলব্ধিই করতে পারবে না। আর উপস্থাপনের ওপরই নির্ভর করে আপনার কথার প্রভাব কেমন হবে।
একটা শব্দের কথাই ধরা যাক, শব্দটি ‘কারণ’। আপনি কোনো জিনিস কেন চাইছেন, তা উল্লেখ করলে এই চাওয়ার প্রত্যুত্তরটা ইতিবাচক হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এটি কিন্তু মনগড়া কথা নয়; খোদ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার ফলাফল। এই গবেষণার জন্য গবেষকেরা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠাগারে অপেক্ষা করতেন, কখন কেউ এসে সেখানকার ফটোকপি যন্ত্রটি ব্যবহার করবেন। কেউ ওই যন্ত্র ব্যবহার শুরু করলেই তাঁরা উঠে তাঁর কাছে গিয়ে তাঁর আগেই যন্ত্রটি ব্যবহার করার অনুমতি চাইতেন। তিনভাবে কথাটা বলতেন তাঁরা। প্রথম ধরনটা খুব সাদামাটা, ‘আমি কি ফটোকপি মেশিনটা ব্যবহার করতে পারি?’ দ্বিতীয় ধরনটা ছিল, ‘আমার তো ফটোকপি করা প্রয়োজন। আমি কি মেশিনটা ব্যবহার করতে পারি?’ তৃতীয় ধরনটা ছিল দারুণ, ‘আমার একটু তাড়া আছে তো আমি কি ফটোকপি মেশিনটা ব্যবহার করতে পারি?’
প্রথম ধরনে যতটা ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গেছে, তার চেয়ে ৫০ শতাংশের বেশি পাওয়া গেছে দ্বিতীয় বা তৃতীয় ধরনের প্রশ্নে। কেবল ‘কারণ’টা উল্লেখ করাতেই এই বিশাল তফাৎ। যদিও দ্বিতীয় ধরনটায় খুব চমৎকার কোনো কারণের উল্লেখ নেই। তবু কোনো একটি কারণের উল্লেখ থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ। জোনাহ বার্জার মনে করেন এমনটাই।পণ্যের বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রেও এই ‘কারণ’ উল্লেখ করে দেওয়ার বিষয়টি লক্ষণীয়। মনোবিজ্ঞানী (বিহেভিয়ারাল সায়েন্টিস্ট) নুয়ালা ওয়ালশ এদিকটায় আলোকপাত করেছেন বিখ্যাত ব্র্যান্ড লরেলের স্লোগানের কথা উল্লেখ করে। ‘বিকজ ইউ আর ওর্থ ইট’ স্লোগানের ‘বিকজ’টা পাঁচ দশক ধরে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করে এসেছে।
কোনো বিষয়ে কারও সাহায্য চাইতে হলে সাহায্যের প্রতি জোর না দিয়ে সাহায্যকারীর প্রতি জোর দেওয়ার কথা বলেছেন জোনাহ বার্জার। ‘আমার একটু পানি লাগবে’ না বলে যদি বলেন, ‘আপনি কি আমাকে একটু পানি দেবেন?’, তা বেশি কার্যকর। ‘আমি এই জিনিসটা পছন্দ করি’—এভাবে না বলে যদি বলেন, ‘আপনি যদি অমুক অমুক সুবিধা পেতে চান, তাহলে আমি আপনাকে এই জিনিসটা ব্যবহারের পরামর্শ দেব।’—এটি অনেক বেশি গ্রহণযোগ্যতা পাবে। তবে বাক্যের ভেতর অকারণে ভিন্ন ভাষার শব্দ আনবেন না। আপনি যখন বাংলায় কথা বলছেন, তখন যদি বারবার এমন ইংরেজি শব্দ বলে ফেলেন, যেসবের বাংলা প্রতিশব্দ প্রচলিত আছে, তাহলে কিন্তু ভাষার আকর্ষণ নষ্ট হয়। কথার মাধুর্য হারিয়ে যায়। একটি ভাষায় কথা বলার সময় অন্য ভাষার উচ্চারণভঙ্গিও নিয়ে আসা উচিত নয়। অর্থাৎ ইংরেজির মতো করে বাংলা বললে লোকে বিরক্তই হবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে।
স্বর, বাচনভঙ্গি এবং দেহভঙ্গি রাখুন ইতিবাচক। অনুরোধ করতে গিয়ে আদেশ বা কর্তৃত্বের সুরে কথা বলে বসবেন না যেন। মারমার কাটকাট ভঙ্গিতে কথা বললে কিন্তু সহজ বিষয়ও হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। বিনীত হোন। বিনয় দুর্বলতা নয়; বরং বিনয় দিয়েই আপনার ভাষার শক্তিকে বাড়িয়ে নিতে পারেন।
সূত্র: সিএনবিসি