বেঁচে থাকাই তো দারুণ ব্যাপার। জীবন সুন্দর। কিন্তু আধুনিক পৃথিবীতে জীবন যেন দিন দিন হয়ে উঠছে জটিল ও দুর্বিষহ। কোনো না কোনো প্রতিযোগিতায় মগ্ন থাকছি আমরা। জীবনটা উপভোগ্য হয়ে ওঠা দূরে থাক, উল্টো হয়ে উঠছে একটা বিশাল বোঝার মতো। বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার দৌড়ে জাপান কিন্তু খুব একটা পিছিয়ে থাকা কোনো দেশ নয়। তবে জাপানি সংস্কৃতিতে এমন সাতটি জীবনবোধের খোঁজ পাওয়া যায়, যা জীবনের চাপ সামলে পথচলার পাথেয় হয়ে উঠতে পারে যেকোনো মানুষের জন্য। ঐতিহ্যগতভাবেই জাপান দারুণ সমৃদ্ধ এক দেশ। চলুন, আজ এমন সাত জীবনভাবনার সঙ্গে পরিচিত হই।
পৃথিবীতে আমরা কেন আছি, আজ সকালে আপনি কেন ঘুম থেকে জেগে উঠেছেন—এসবের কিন্তু কোনো না কোনো কারণ আছে। মন থেকে আপনি কোন জিনিসটিকে ভালোবাসেন, আপনি কোন কাজ সুন্দরভাবে করতে সক্ষম, এই পৃথিবীর কী প্রয়োজন এবং আপনাকে কোন কাজের বিনিময়স্বরূপ কেউ কোনো কিছু দেবেন—এই চার প্রশ্নের উত্তর খোঁজার মধ্যেই পাবেন আপনার ‘ইকিগাই’। নিজের ভালো লাগার কাজটি খুঁজে বের করে এর মাধ্যমেই পৃথিবীর জন্য, সৃষ্টিকুলের জন্য কিছু করতে চেষ্টা করুন। ভালো লাগার কাজ দিয়ে টুকটাক রোজগারের চেষ্টাও করতে পারেন।
এটি এক নান্দনিক দর্শন। বিষয়টা একটু বুঝিয়ে বলা যাক। ধরুন, আপনি চান চিরতারুণ্য, কিন্তু বাস্তবতা হলো, সময় বয়ে যাবেই। সময়ের সঙ্গে অনেক কিছু বদলেও যাবে। আপনার শরীর আর আগের মতো থাকবে না, আশপাশের মানুষগুলোও বদলে যেতে পারে। এই বদলে যাওয়ার সত্যটাই কিন্তু জীবনের অনন্য সৌন্দর্য। কিংবা মনে করুন, আপনার জীবনের সবকিছু নিখুঁত ও পরিপাটি রাখতে চান। কিন্তু বাস্তবে এটিও প্রায় অসম্ভব। তবে ব্যক্তি, বস্তু বা পরিবেশে বহু খুঁত থাকা সত্ত্বেও সৌন্দর্য হারিয়ে যায় না। ভাঁজ পড়া ত্বক, ধূসর হয়ে আসা চুল, বহু ব্যবহারে দাগ পড়ে যাওয়া আসবাব—সবকিছুকেই দেখুন সৌন্দর্যের দৃষ্টিতে।
নিজেকে চমৎকার মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হয় দিনের পর দিন, বছরের পর বছর। একটু একটু করে পৌঁছাতে হয় উন্নতির দিকে। এটিই হলো ‘কাইজেন’। স্বাস্থ্যকর অভ্যাস গড়ে তোলা, সম্পর্কগুলোকে সতেজ রাখা, নতুন কোনো দক্ষতা অর্জন করা—সবকিছুতেই ‘কাইজেন’ হতে পারে আপনার মূলমন্ত্র।
এর অর্থ হলো ‘বনে স্নান’। প্রকৃতির স্নিগ্ধতায় জীবনের ক্ষতগুলো সারিয়ে তোলা যায়। প্রকৃতির কোলে নিজেকে নিমজ্জিত করার এ ধারাকে অভ্যাস করে তুলুন। তার জন্য কিন্তু আপনাকে বনবাসী হতে হবে না! খোলামেলা মাঠ বা উদ্যানে গেলেও চলবে। সূর্যোদয় দেখুন, সূর্যাস্ত দেখুন। মেঘের গতির সঙ্গে মনকে ভাসিয়ে দিন। চাঁদের দিকে চেয়ে থাকুন। অর্থাৎ প্রকৃতির মাঝে থেকে প্রকৃতিকে মন দিয়ে দেখুন, উপভোগ করুন।
মাটির জিনিস ভেঙে গেলে তা সোনা, রুপা বা প্লাটিনাম মেশানো উপাদানের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার শিল্পকে বলা হয় ‘কিনৎসুগি’। ভাঙা দিকটাকে লুকানো বা ভাঙা জিনিসটাকে ফেলে দেওয়ার বদলে ভাঙা দিকটাকেই আরও উজ্জ্বলভাবে ফুটিয়ে তোলা হয় এখানে। এ যেন সেই জিনিসের এক উজ্জ্বল ইতিহাস হয়ে থাকে। মাটির পাত্রের মতো জীবনেও ক্ষত সৃষ্টি হতে পারে যেকোনো সময়। অতীতের কোনো খারাপ স্মৃতি আপনাকে কুরে কুরে খেতে পারে, কৃতকর্মের জন্য লজ্জাবোধও করতে পারেন। সেসব বিষয়েও প্রয়োগ করুন ‘কিনৎসুগি’। অর্থাৎ অতীতের বিষয়–আশয়গুলো সহজভাবে ভাবুন। খারাপ অভিজ্ঞতা থেকেই আপনি জানেন, জীবনে কখন কোন পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। আর আপনার জীবনের গল্প তো অনন্য। কারও সঙ্গেই মিলবে না। সেই গল্পে থাকতেই পারে নেতিবাচক অধ্যায়। তবু তো আপনি ‘আপনি’ই।
পৃথিবীতে কোনো কিছুই চিরস্থায়ী নয়। এ সত্য উপলব্ধি করলে আপনি বর্তমানকে উপভোগ করতে পারবেন শতভাগ। আজ আপনার প্রিয় মানুষদের সঙ্গে কাটানো মুহূর্ত, তাঁদের হাসি কিংবা বিরক্তি—কোনোটার স্থায়িত্ব সম্পর্কেই আপনি নিশ্চিত নন। তাই তাঁদের সঙ্গে কাটানো সময়ে মনোযোগ দিন তাঁদের প্রতিই। আজকের ফুলের সুবাস, আজকের সূর্যাস্তের মুহূর্ত—কোনো কিছুই স্থায়ী নয়। তাই উপভোগ করুন বর্তমানকে।
এ হলো অন্যের জন্য নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার জীবনচর্চা। সাধারণ সৌজন্যবোধের চেয়ে এটি অনেক বেশি কিছু। একেবারে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করাই হলো এর মূলকথা। কেউ কিছু বললে মন দিয়ে শুনুন, তাঁর প্রত্যাশার চেয়ে বেশি সাহায্য করুন। উষ্ণতার একটি পরিবেশ সৃষ্টি করুন আপনার চারপাশে। জীবন বদলে যাবে।
সূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া