মেয়ের কবরের পাশে থাকতে বাবা তৈরি করলেন এই বাড়ি

শেষবার বাবার সঙ্গে যখন গ্রামে এসেছিলেন প্রেরণা, বলেছিলেন এখানে সুন্দর একটা বাড়ি করতে হবে। মেয়ে চলে গেলেও বাবা তাঁর কথা রেখেছেন, মেয়ের স্মরণে গড়ে তুলেছেন ‘প্রেরণা প্রাঙ্গণ’। মেয়ের স্মৃতি দিয়ে সেজেছে সেই বাড়ি। টাঙ্গাইল থেকে ফিরে সেই গল্পই শোনালেন সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম

মেয়ের স্মৃতি ধরে রাখতে বাবা তৈরি করেন এই ‘প্রেরণা প্রাঙ্গণ’।

 মানুষের হৃদয়ের সঙ্গে প্রকৃতির বোঝাপড়া থাকে। নয়তো সামান্য এক অপরাজিতাগাছকে কেন ফুল ফোটাতে পৌঁছাতে হবে দোতলার বারান্দা পর্যন্ত! ‘প্রেরণা প্রাঙ্গণ’ নামের বাড়িটির পূর্ব দিকের উঠানে লাগানো গাছটি অসংখ্য ফুল ফুটিয়েছে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে। যেন বারান্দা থেকে ওরাও দেখতে উন্মুখ একটা চিহ্ন—প্রেরণার কবর। হেমন্তে শিউলি, বর্ষায় বকুল ঝরে পড়ে এই কবরে। মাথার কাছে ফুটে থাকে সাদা জবা।

সব সঞ্চয় দিয়ে বাবা তৈরি করেছেন মেয়ের স্বপ্নের বাড়িটি

বাড়ির মালিক খন্দকার লিয়াকত আলীর বয়স প্রায় ৭০ বছর। কর্কট রোগের চিকিৎসা চলছে তাঁর। সকাল, সন্ধ্যা অথবা গভীর রাতে পায়চারি করেন বারান্দাজুড়ে। এ বাড়ির দোতলার চারপাশে টানা বারান্দা এমনভাবে তৈরি যেন যেকোনো জায়গা থেকেই দেখা যায় প্রেরণার কবর।

বাড়ির বারান্দাটি এমনভাবে তৈরি হয়েছে যেন যেকোনো জায়গা থেকেই প্রেরণার কবর দেখতে পাওয়া যায়

খন্দকার লিয়াকত আলী বললেন, ‘নগরের সব সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়ে গ্রামে এসেছি সন্তানের কাছে। সব সঞ্চয় দিয়ে তৈরি করেছি আমার মেয়ের স্বপ্নের বাড়িটি। অথচ দেখুন, আমার মেয়ের জন্য বরাদ্দ এখন মাত্র সাড়ে তিন হাত জায়গা। আমি বাড়ির যেকোনো জায়গা থেকে দাঁড়িয়ে সন্তানের কবর দেখি। তবু প্রাণের তৃষ্ণা মেটে না।’

প্রেরণার জন্য তৈরি এই ঘর, যেখানে সবকিছুতেই আছে তার পছন্দের ছোঁয়া

খন্দকার লিয়াকত আলীর দ্বিতীয় সন্তান প্রেরণা খন্দকার। বছর তিনেক আগে বাবার সঙ্গে গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে এসে বলেছিলেন, এখানে একটা ডুপ্লেক্স বাড়ি বানাও বাবা। শীতে পিঠা খেতে, বর্ষায় বৃষ্টিতে ভিজতে আমরা আসব ঢাকা থেকে। হইচই করে থাকব গ্রামে কয়েকটা দিন।

প্রকৃতি খুব ভালোবাসতেন প্রেরণা, তাই বারান্দায় এই আয়োজন

এর কয়েক মাস পরই আত্মহত্যা করেন প্রেরণা খন্দকার। তাঁকে দাফন করা হয়েছে গোড়াই ইউনিয়নের ধেরুয়া গ্রামের সেই বাড়ির প্রাঙ্গণে, যেখানে তিনি মাঝেমধ্যে প্রকৃতি দেখতে আসতে চেয়েছিলেন। প্রেরণা নেই কিন্তু স্বপ্নটা পূরণ করতে বাবা ঢাকার ফ্ল্যাট বিক্রি করেছেন। সঞ্চয়পত্র ভেঙেছেন। সোয়া এক কোটি টাকার বেশি খরচ করে প্রত্যন্ত গ্রামের ভেতর তৈরি করেছেন হারানো সন্তানের স্বপ্নের বাড়ি। বাড়ির নাম রেখেছেন ‘প্রেরণা প্রাঙ্গণ’।

বাড়ির প্রধান ফটক পার হয়ে সিঁড়িতে উঠতেই চোখে পড়বে প্রেরণার এই হাস্যোজ্জ্বল ছবি

এ বাড়ির পূর্ব–পশ্চিম দুই দিকে বিস্তৃত ফসলের মাঠ। এক টুকরা ছোট্ট জলাভূমির শান্ত পানিতে ঘাই দিয়ে যায় মাছেরা। সূর্য ওঠে এবং অস্ত যায় বারান্দাগুলো সাক্ষী রেখে। নিচতলায় জাপানি ধরনে সাজানো এক পাশ। রঙিন মার্বেলের বেসিনের পাশে নানা মাপের গাছ।

পুরো বাড়িতেই এমন খোলামেলা আবহ

উল্টো দিক থেকে আসা রোদে সেসব গাছের ছায়া পড়ে ঘরের ভেতর। কাচের পাত্রে ছোট ছোট নুড়ি পাথর জলের ভেতর ডুবে থাকে দিনরাত। হাওয়া ছুটে এসে দুলিয়ে যায় সাদা–সবুজ পর্দাগুলো। সাদা বাড়ির একটা দেয়ালই হলুদ রঙের। সেখানে পরিবারের অনেক ছবি। ডুপ্লেক্স বাড়ির ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার সময় প্রথম চোখ আটকায় প্রেরণার বড় একটি ছবিতে। রোজ সেখানে তাজা ফুল রাখা হয়।

কদিন পরই এ পাঠাগারে বসবে শিশুদের স্কুল

দোতলায় প্রেরণার জন্য একটি ঘর বানানো হয়েছে। সেখানে উত্তরের জানালা লাগোয়া বিশাল এক নিমগাছ ঢুকে আসতে চায় ঘরের ভেতর। বারান্দায় টাঙানো বড় দোলনাটাতে বসলেও চোখে পড়ে প্রাঙ্গণে থাকা বাঁ দিকে প্রেরণার সমাধি।

নিচতলায় একপাশে থাকছে রান্না, খাওয়া ও বসার ব্যবস্থা

দুটি তলা মিলিয়ে মোট ৪ হাজার ২০০ বর্গফুটের বাড়িটি মাঠ, জলাভূমির ভেতর যেন এক স্মৃতির দুর্গ। কাঠামো ও তৈরির রীতি বনেদি বাড়ির মতো শক্তপোক্ত। নিচতলায় এক পাশে রান্না, খাওয়া ও বসার ব্যবস্থা।

সন্তানের স্মৃতি দিয়েই পুরো বাড়িটি সাজিয়েছেন মা–বাবা

চারপাশের বড় বড় দরজাগুলো দিয়ে হাওয়া ছুটে আসে, রোদ এসে চৌকোনা হয়ে পড়ে ঘরের মেঝেতে। আরেক পাশে বানানো হয়েছে পাঠাগার। সেখানকার কয়েক শ বইয়ের ভেতর থেকে মাঝেমধ্যে উঁকি দিচ্ছে হারিয়ে যাওয়া মানুষটির বিভিন্ন স্মারক, সম্মাননা। পাঠাগারের এক পাশে কাচের আলমারির ভেতর রাখা আছে প্রেরণার ব্যবহার করা শখের জিনিসপত্র।

‘ তুমি রবে নীরবে’– প্রেরণা প্রাঙ্গনের প্রবেশদ্বার

সব ফেলে তিনি চলে গেছেন, কিন্তু সেই সন্তানের স্মৃতি দিয়েই পুরো বাড়িটি সাজিয়েছেন মা–বাবা। প্রেরণার মা আসমা খন্দকার বললেন, ‘একেবারে চলে এসেছি শুধু মেয়ের কবরের কাছাকাছি থাকব বলে। রোজ বোধ হয় ৩০ বার করে যাই মেয়ের কাছে।’

সবুজে ঘেরা বাড়ি

প্রেরণার যমজ ভাই প্রত্যয় খন্দকার বললেন, গ্রামের শিশুরা এসে বই পড়ে এই পাঠাগারে। মাঝেমধ্যে বাড়িতে নিয়ে যায়, আবার ঠিকঠাক ফিরিয়ে দেয়। পাঠাগারটি আরও বড় পরিসরে তৈরির ইচ্ছার কথা জানালেন লিয়াকত আলী। এখন চলছে গ্রামের শিশুদের গান শেখানো এবং ছবি আঁকা শেখানোর প্রস্তুতি। আর কদিন পরই এ বাড়ির পাঠাগারে বসবে শিশুদের সেই স্কুল।

এখানেই চিরশায়িত প্রেরণা

চাইলে বই নিয়ে টেবিল–চেয়ারেও বসে পড়া যায়। এখান থেকে দেখা যায় বাড়ির সামনে থাকা জারুল, কাঠগোলাপ, কৃষ্ণচূড়া আর অনেক নিমগাছের। প্রেরণা প্রাঙ্গণ নামের এ বাড়ির ঝকঝকে ছাদ থেকে দেখা যায় প্রায় পুরো গ্রাম।

বড় বড় জানালা দিয়ে হাওয়া ছুটে আসে ঘরে

সাদা রঙের বাড়িটি তৈরি করতে সময় লেগেছে প্রায় দুই বছর। ব্যালকনি থেকে শুরু করে বাইরের সিঁড়িতে বসার জায়গা—সব নকশা করেছেন লিয়াকত আলী আর তাঁর বড় মেয়ে প্রিয়তা খন্দকার। প্রেরণা চলে গেছেন ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে। তারপর শুরু হয় সেই স্বপ্নের বাড়ি তৈরির কাজ।

ছেলে, মেয়ে ও স্ত্রীর সঙ্গে লিয়াকত আলী, পেছনে ছবি হয়ে আছেন আরেক কন্যা প্রেরণা

২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে এখানে বসবাস শুরু করেন লিয়াকত–আসমা দম্পতি। এই সুন্দরের জন্ম প্রেরণাকে হারানোর আঘাত থেকে। তবে শোকগ্রস্ত এই পরিবারের জন্য সম্প্রতি উপহার হিসেবে এসেছে একটি শিশু। লিয়াকত আলীর একমাত্র ছেলে প্রত্যয়ের একটি সন্তান হয়েছে কদিন আগেই (২৯ সেপ্টেম্বর)। শিশুটির নাম রাখা হয়েছে প্রেরণ। প্রেরণা প্রাঙ্গণে আর কদিন পরই এক পা দুই পা করে হাঁটতে শিখবে প্রেরণ।