বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহত হয়েছিলেন ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষার্থী মহসিন বিন মোজাম্মেল। লিখেছেন তাঁর অভিজ্ঞতা।
১৮ জুলাই ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির প্রধান ফটকের সামনে শুরু হয় আন্দোলন। আমার জন্য এই আন্দোলন কখনোই কোটার জন্য ছিল না। পরিচিত ভাই-বোন, বন্ধু, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের যখন রক্তাক্ত করা হলো, দেখে ঘরে বসে থাকতে পারিনি। পথে নেমেছি। সেদিন কথা হয়েছিল—আমরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীরা মিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যাত্রা করব। বিভিন্ন জটিলতায় সেটা হয়ে ওঠেনি।
ঘটনার দিন অর্থাৎ ১৮ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকা তো দূরের কথা, নিজের ক্যাম্পাসের গেটেও পুলিশ আমাদের দাঁড়াতে দিচ্ছিল না। ধীরে ধীরে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ল। গেটের সামনে আর জায়গা ছিল না। তখন ব্র্যাকের মূল ফটক খুলে দিয়ে শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসের ভেতরে আশ্রয় নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। উপস্থিত শিক্ষার্থীরা নিরাপদে ভেতরে ঢোকার পর স্টাফরা গেট বন্ধ করে দেন। তখনই শুরু হয় পুলিশের আক্রমণ। ক্যাম্পাসের বাইরে থেকেই তারা ছুড়তে শুরু করে টিয়ার শেল, সাউন্ড গ্রেনেড। ফাঁকফোকর দিয়ে আসছিল ছররা গুলিও।
একসময় শুরু হয় পাল্টাপাল্টি ধাওয়া। কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটির সামনে আমার দুই জুনিয়র গুলিবিদ্ধ হন। ওদের ক্যাম্পাসে নিয়ে এসে চিকিৎসা দেওয়াই তখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ওদিকে রামপুরা ব্রিজ থেকে পুলিশের আরও একটা দল এগিয়ে আসতে শুরু করেছে, আমরা পড়ে গিয়েছি মাঝখানে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই গুলি লাগে আমার গায়ে। পরে জেনেছি, প্রায় ৫০টা ছররা গুলি লেগেছিল।
প্রথমে আমাকে বাড্ডার এআইএমএস মেডিকেলে নেওয়া হয়। চোখে ব্যান্ডেজ, শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ড্রেসিং করে দেওয়া হয়। সেখান থেকে যাই হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে। কঠিন ওই সময়ে ঝুঁকি নিয়ে যে চিকিৎসক ও নার্সরা পাশে ছিলেন, তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা বলে বোঝাতে পারব না।
হারুন আই কেয়ারে চোখের এক্স-রে করে জানতে পারি, চোখে দুইটা ছররা গুলি আছে। শ্যামলীর আইডিয়াল আই কেয়ারে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে একটি ছররা গুলি বের করা সম্ভব হলেও বেশি ঝুঁকি থাকায় দ্বিতীয়টা বের করা হয়নি। পরে ওমেগা হাসপাতালে একজন প্লাস্টিক সার্জনের তত্ত্বাবধানে শরীর ও চেহারায় সার্জারি করে আরও কিছু গুলি বের করা হয়েছে।
চোখে একটাসহ এখনো ২৫টা ছররা গুলি আমার শরীরে আছে। আন্দোলনের সময়টায় অ্যাম্বুলেন্সে করে এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে যাওয়াও বেশ আতঙ্কের ছিল। কারণ, শিক্ষার্থী দেখলেই তাঁদের নানা হয়রানিতে ফেলা হচ্ছিল।
চোখের চিকিৎসা সম্পন্ন করাই এখন বড় কাজ। কয়েক দিন আগে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছি। এখন অন্য হাসপাতালের খোঁজ নিচ্ছি। দেশে সম্ভব না হলে হয়তো বিদেশে গিয়েই চিকিৎসার চেষ্টা করতে হবে।
আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা কাতারে। ২০২০ পর্যন্ত পরিবারে নিয়ে ওখানেই থাকতাম। গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে মাস দেড়েকের জন্য বাংলাদেশে আসা হতো। ইচ্ছা ছিল স্থাপত্য নিয়ে পড়ব। কাতারে সে সুযোগ না থাকায় ২০২০ সালে দেশে এসে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হই। ধীরে ধীরে ব্র্যাক এবং দেশের প্রতি টান ও ভালোবাসা বাড়তে থাকে। দেশকে নতুন করে চেনার সুযোগ হয়।
আন্দোলনের আগে দেশের সম্পূর্ণ ইতিহাস বা রাজনীতি নিয়ে অনেক জানাশোনা ছিল, তা নয়। বরং আন্দোলন শুরুর পরই পড়াশোনা করে জানার চেষ্টা করেছি। স্থপতি হয়ে দেশের জন্য কাজ করার লক্ষ্য নিয়ে লেখাপড়া করছিলাম। এখনো সেটাই পরিকল্পনা। সুস্থ হয়ে সারা জীবন দেশের জন্য কাজ করতে চাই। তবে সবার আগে চাই যে দেশের সামগ্রিক ‘সিস্টেমে’ একটা বদল আসুক। ন্যায়ের ভিত্তিতে সমাজ প্রতিষ্ঠিত হোক। আরও অনেক কিছুর পরিবর্তন দরকার। আপাতত শুরু তো হোক।