শিশুর সামাজিক বিকাশে খেয়াল রাখুন এই ৫ বিষয়

সন্তানকে অন্য শিশুদের সঙ্গে মেশার সুযোগ দিন
ছবি: কবির হোসেন

অনেক অভিভাবকই সন্তানের একাডেমিক ফলাফলের দিকে যতটা মনোযোগী, সামাজিক বিকাশের দিকে ততটা না। অনেকে এর গুরুত্বটাই উপলব্ধি করেন না। কেউ আবার সন্তানের সামাজিকতায় খানিকটা ঘাটতি দেখলেও মনে করেন, বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে। অথচ এই পাঠে ফাঁক থাকলেই মুশকিল। সমাজের আর দশজনের সঙ্গে মিলেমিশে চলতে না শিখলে পরবর্তী জীবনে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে; ব্যক্তিগত জীবনেও হানা দিতে পারে সামাজিক পরিসরের এই সমস্যা। তাই শিশুর অভিভাবক হিসেবে তার সামাজিক বিকাশের দিকে খেয়াল রাখাটাও আপনার দায়িত্ব। পরিবারেই হয় শিশুর সামাজিক বিকাশের প্রথম পাঠ। অভিভাবকেরা একটু সচেতন হলেই একটি শিশুর পরিপূর্ণ সামাজিক বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি হয়। এমনটাই বলছিলেন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের শিশু কিশোর ও পারিবারিক মনোরোগবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. টুম্পা ইন্দ্রানী ঘোষ।

আজকাল যৌথ পরিবার খুব একটা দেখা যায় না। সেখানে সবার মাঝে শিশু যেভাবে বেড়ে ওঠে, একক পরিবারে তেমন সুযোগ থাকে না। তারপরও অভিভাবকেরা নিজেদের সামাজিক আচরণ দিয়ে ‘রোল মডেল’ হয়ে উঠতে পারেন। ‘ভাগাভাগি’ বা শেয়ারিংয়ের আনন্দটাও বুঝিয়ে দিতে পারেন।

১. কথা বলুন, প্রশ্ন করতে উৎসাহ দিন

শিশু প্রশ্ন করতে গেলে থামাবেন না। মডেল: রাইয়ান ও সুমাইয়া

আজকের দিনের অভিভাবকের ব্যস্ততা তুলনামূলক বেশি। তবু যতটা সময় শিশুর কাছে থাকেন, তার সঙ্গে কথা বলুন। গল্প করুন। তার কথা শুনুন। সে নিজে থেকে না বললে আপনিই প্রশ্ন করুন। তাকেও প্রশ্ন করতে উৎসাহ দিন। ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’ দিয়ে উত্তর সেরে ফেলা যায়, এমন প্রশ্ন না। বরং এমন প্রশ্নের চর্চা করুন, যার উত্তরে অনেক কথা বলা যায়।

২. সামাজিক পরিসরে

অন্যের সঙ্গে কুশল বিনিময় বা নিদেনপক্ষে সম্ভাষণ না জানানো কিংবা বাড়িতে অতিথি এলে নিজের ঘর থেকে না বেরোনোটাকে শিশুসুলভ আচরণ ভেবে হেসে উড়িয়ে দেবেন না। আবার কথা বলার জন্য কিংবা সামনে আসার জন্য তাকে জবরদস্তি করাও উচিত নয়। বরং তাকে স্বাভাবিক আচরণ করতে উৎসাহ দিন। অতিথি আপ্যায়নের প্রস্তুতিতে তাকে সঙ্গে নিতে পারেন। বলতে পারেন, ‘আজ তোমার চাচ্চু আসবেন। তুমি কি তার জন্য কিছু তৈরি করতে চাও?’ আপ্যায়নের কাজে আপনার সঙ্গে থাকতে পারে শিশু, অতিথিকে এগিয়েও দিতে পারে পানীয়ের পাত্র বা মিষ্টান্নের প্লেট। সব শিশু যে সবটাই করবে, এমন নয়। খানিকটা করলেই হলো। প্রয়োজনে ছোটখাটো উপহার দিয়ে সামাজিক আচরণে তাকে উৎসাহ দিন। দোকানে কেনাকাটা, রেস্তোরাঁয় খাবারের ফরমাশ দেওয়া কিংবা যানবাহনের চালকের সঙ্গে যাত্রাপথ ঠিক করার সময়কার কথার খানিকটাও শিশুকে বলতে দিন।

কিছু কৌশল অবলম্বন করলে শিশুকে বশে আনা সম্ভব, পাশাপাশি শিশুর সঙ্গে আপনার বন্ধন হবে আরও দৃঢ়

৩. শিশুর অনুভূতি, অন্যের অনুভূতি

সব শিশু একই রকম সামাজিক আচরণ করবে না। এটা স্বাভাবিক। জোর করবেন না। শুধু খেয়াল রাখুন, শিশু যাতে ‘অসামাজিক’ হয়ে না যায়। বয়স অনুযায়ী সামাজিকতার গুরুত্ব বুঝিয়ে বলুন। সে কথা না বললে অন্যজন কষ্ট পেতে পারে, এটাও বলুন। অন্যের অনুভূতিকে সম্মান করতে শেখান। বাড়িতে পোষা প্রাণী রাখতে পারেন। প্রাণীর অনুভূতির সঙ্গে মানবশিশুর অনুভূতি মিলেমিশে যাবে। আবেগীয় পরিবেশে বেড়ে উঠবে শিশু। হয়ে উঠবে যত্নশীল ও দায়িত্ববান। মানুষের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার ক্ষেত্রেও এসব গুণ কাজে আসবে। তবে শিশু কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে এড়িয়ে যেতে চাইলে লক্ষ রাখুন, ওই ব্যক্তি শিশুর সঙ্গে নেতিবাচক আচরণ করছেন কি না। কেউ শিশুর ওজন, উচ্চতা, একাডেমিক ফলাফল প্রভৃতি নিয়ে বক্রোক্তি করলে তাঁকে বুঝিয়ে বলুন, যেন তিনি এসব নিয়ে কথা না বলেন। তা ছাড়া কেউ শিশুকে খারাপভাবে স্পর্শ করতে চেষ্টা করছে কি না, সেদিকেও লক্ষ রাখুন। ছেলেশিশু ও মেয়েশিশু যে কারও ক্ষেত্রেই এমনটা ঘটতে পারে।

৪. মুখভঙ্গি ও দেহভঙ্গি

শিশুর সামনে রাগ প্রকাশ করবেন না। অন্যের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলুন। দেহভঙ্গি রাখুন ইতিবাচক। চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলুন। শিশু এই বিষয়গুলোই শিখবে। শিশুর সঙ্গে কথা বলার সময়ও এসব বিষয় খেয়াল রাখুন।

৫. অন্য শিশুর সঙ্গে মেশার সুযোগ

প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলুন। তাঁদের সন্তানদের সঙ্গে নিজের সন্তানকে মেশার সুযোগ দিন। বাড়িতে, বাড়ির নিচে বা ছাদে তাদের সঙ্গে খেলার সুযোগ দিন। শিশুদের নিয়ে ছোটখাটো অনুষ্ঠানের আয়োজনও করতে পারেন। তার পছন্দমাফিক আবৃত্তি, বিতর্ক, ক্রিকেট, ফুটবল বা কারাতের মতো কিছু শেখাতেও পারেন, যাতে অন্যের সঙ্গে কথা বলা বা নিজেকে উপস্থাপনের প্রয়োজন পড়ে।

নিজেদের সব প্রচেষ্টার পরেও যদি শিশুর সামাজিকতায় ঘাটতি থাকে, তাহলে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।