হঠাৎ করেই হাসিমুখগুলো বিষণ্ন হয়ে গেল...

চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি অনেকেই
ছবি: সংগৃহীত

গল্প-আড্ডা, রং খেলা, গান, নাচ, দেশসেরা ব্যান্ডের পরিবেশনা—সবই ছিল আনন্দ আর উচ্ছ্বাসে মাখা। কিন্তু অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে স্পিকারে যখন বাজল, ‘পুরোনো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়,’ হঠাৎ করেই হাসিমুখগুলো বিষণ্ন হয়ে গেল। ভেজা চোখে অনেকে প্রিয় বন্ধুকে জড়িয়ে ধরলেন। বিদায়ী ব্যাচের শিক্ষার্থীরা তো বটেই, বাকিদের চোখও তখন অশ্রুসিক্ত। শুক্রবার এমন চিত্রই দেখা গেল চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) ৪৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা সমাপনী উৎসবে।

বলা হয় শিক্ষা সমাপনী উৎসব চুয়েটের সবচেয়ে বড় আয়োজন। এবারের উৎসবের শিরোনাম ছিল আদ্যন্ত ’১৮। আর স্লোগান—‘আদি থেকে অন্তহীন, আদ্যন্ত অমলিন।’

দুই দিনের এ উৎসবের প্রথম দিনে বিকেল সাড়ে চারটায় আনন্দ শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে হয়েছিল সূচনা। বাঁশি ও ঢোল বাজিয়ে, ফেস্টুন হাতে, স্লোগানের তালে শোভাযাত্রায় অংশ নেন প্রায় ৩০০ শিক্ষার্থী। এরপর ফ্ল্যাশমব ও রং খেলায় মেতে ওঠেন শিক্ষার্থীরা। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শেষ হয় প্রথম দিনের আয়োজন। ছিল নাচ, গান, নাটকসহ নানা সাংস্কৃতিক আয়োজন।

শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে শুরু হয়ে পরদিন ভোর পর্যন্ত চলে কনসার্ট। কনসার্টে মঞ্চ মাতিয়েছে ‘শিরোনামহীন’, ‘উন্মাদ’, ‘আর্বোভাইরাস’, ‘সহজিয়া’, ‘ক্যাপসিকাম’, ‘বাংলা ঢোল’, ‘অ্যাটারনে’সহ বেশ কয়েকটি ব্যান্ড।

সন্ধ্যা থেকে শুরু হয়ে পরদিন ভোর পর্যন্ত চলে কনসার্ট

উৎসব শুরুর আগে থেকেই ক্যাম্পাসজুড়ে ছিল অন্য রকম উন্মাদনা। ক্যাম্পাসের বাস্কেটবল মাঠের পাশে নান্দনিক স্থাপত্যশৈলীর একটি বাঁশের ঘরে আড্ডা দিতে দেখা যায় অনেককে। ঘরটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘র‍্যাগ হাট’। প্রতিবারই শিক্ষা সমাপনী উৎসবের সময় বিদায়ী বর্ষের শিক্ষার্থীরা এ রকম ঘর তৈরি করেন।

সপ্তাহখানেক আগে থেকেই চলতে থাকে মহড়া। ক্লাস, ল্যাব শেষে শিক্ষার্থীরা চলে যেতেন ছাত্র–শিক্ষক কেন্দ্রে। গত বছর ডিসেম্বরেই গোলচত্বর এলাকায় আঁকা হয়েছে দেয়ালিকা। সেখানে স্থান পেয়েছে ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের পুরো ক্যাম্পাসজীবনের চিত্র।

কথা হলো মেকাট্রনিকস ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের বিদায়ী বর্ষের শিক্ষার্থী ইমনুল হকের সঙ্গে। বললেন, ‘সবুজ স্বর্গে পাঁচ বছরের যাত্রা আজ শেষ হলো। বলা যায়, জীবনের সোনালি অধ্যায়ের সমাপ্তি, যা সামনের অধ্যায়ের রসদ হিসেবে কাজ করবে। আজকের এই দিনের স্মৃতি আমাকে নিয়ে যাবে সোনালি অতীতে। যেখানে খুঁজে পাব চুয়েটের বন্ধুত্বের ঘ্রাণ কিংবা সিনিয়র-জুনিয়রের খুনসুটির মুহূর্ত।’

ইলেকট্রনিকস ও টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী ঊর্মি দে বলেন, ‘ক্যাম্পাসের নানা রঙের ভালোবাসাময় দিনগুলো ভোলা সম্ভব না। ক্লাসরুমের আড্ডা, ক্যানটিনের হাসি-ঠাট্টা, কাশেম মামার চায়ের দোকানের লাল চা, ক্যাম্পাসের যেকোনো উৎসবে বন্ধু, জুনিয়রদের সঙ্গে হাসি–আনন্দে মেতে থাকা সবকিছুই আজ মনে হচ্ছে স্বপ্নের মতো।’ একই বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী মোহনা দের বক্তব্য, ‘আমরা যখন ক্যাম্পাসজীবনে প্রবেশ করি, তখন ভাবতেও পারিনি জীবনের কতটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠবে এই কয়েকটা বছর। ছেড়ে যাওয়ার দিন যত এগোতে থাকে, সবার মধ্যে একটা মিশ্র অনুভূতি কাজ করে। একদিকে নতুন জীবনের আমেজ অন্যদিকে হলজীবন, বন্ধুবান্ধব, আর তাঁদের সঙ্গে কাটানো অসংখ্য সুন্দর মুহূর্ত ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট। যাওয়ার আগে শেষবারের মতো সবাই মিলে স্মৃতি রোমন্থনের জন্যই এই আয়োজন।’

এক দেয়ালচিত্রে উঠে এসেছে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়জীবন

উৎসব নিয়ে উদ্দীপনার শেষ ছিল না অনুজদের মধ্যেও। অনেকেই ক্যাম্পাসে আসার পর এ নিয়ে অনেক গল্প শুনেছেন। এবার উৎসবে শামিল হওয়ার সুযোগ পেয়ে প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা তাই ভীষণ খুশি। প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী অনুরাশা রাফানা বলেন, ‘ক্যাম্পাসে আসার পর এটিই আমাদের পাওয়া প্রথম শিক্ষা সমাপনী উৎসব। শুরু থেকেই উৎসবের প্রতিটি পর্ব বেশ ভালো লেগেছে।’

উৎসবে শামিল হতে এসেছিলেন প্রাক্তনরাও। আনন্দ আয়োজনের ফাঁকে ফাঁকে তাঁদের কেউ কেউ আনমনা হয়ে পড়ছিলেন। হয়তো মনে পড়ে যাচ্ছিল পুরোনো স্মৃতি। ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের তুর্জয় ধর যেমন বললেন, ‘অনুজদের শিক্ষা সমাপনী উৎসবে এসে আমাদের ফেলে আসা দিনগুলোর কথা খুব মনে পড়ছে। সারা দিন গোটা ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়ানো, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, সাদা দেয়ালের ক্লাসরুম থেকে শুরু করে খেলার মাঠ, মুক্তমঞ্চ, চুয়েট বাস—সবকিছুই মিশে আছে হৃদয়ে। গত সমাপনী উৎসবে আমার সব সহপাঠী ছিল। আজ কেউ নেই। সবাইকে খুব বেশি মনে পড়ছে।’

পুরো আয়োজন নিয়ে উৎসবের আহ্বায়ক আদিব ইবনে মান্নান বলেন, ‘গত ডিসেম্বর মাসেই ফ্ল্যাশমব, মশাল মিছিল, কনসার্ট ও আতশবাজির মাধ্যমে উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করেছিলাম। গত বৃহস্পতিবার থেকে চূড়ান্ত পর্ব শুরু হয়। সফলতার সঙ্গেই বিদায়ের মুহূর্তকে রঙিন ও আনন্দময় করে তুলতে পেরেছি।’