খুব সাধারণ মানুষও কনটেন্ট বানিয়ে সফল হতে পারে: ইউটিউবের সিইও

গুগলের প্রথম মার্কেটিং ম্যানেজার হিসেবে পেশাজীবন শুরু করেছিলেন সুজান ভোজেস্কি। ২০১৪ সাল থেকে তিনি ইউটিউবের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। সম্প্রতি জয় শেঠি পডকাস্টে কর্মজীবনের নানা দিক নিয়ে কথা বলেছেন এই মার্কিন ব্যবসায়ী।

সুজান ভোজেস্কি

আমি ইতিহাস ও সাহিত্য নিয়ে পড়েছি। কলেজে পড়ার সময় যদি আমাকে জিজ্ঞেস করা হতো, ‘তুমি কি প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করতে চাও?’ নিশ্চয়ই ‘না’ বলতাম। এমনকি কেউ যদি বলত, ভবিষ্যতে আমি এই খাতেই কাজ করব, বিশ্বাসই করতাম না। ইতিহাস ও সাহিত্যটা আমি ভালোবাসতাম। কিন্তু কলেজে সিনিয়র হওয়ার পর যখন প্রথম কম্পিউটারবিজ্ঞানের ক্লাস নিলাম, জীবনটা বদলে গেল।

কম্পিউটারবিজ্ঞানের সঙ্গে সাহিত্যের একটা মিল খুঁজে পেয়েছিলাম। সৃজনশীল কাজ, শিল্প, নতুন নতুন প্রকল্পে যুক্ত হতে ভালোবাসতাম বলেই তো সাহিত্যে পড়েছি। দেখলাম, কম্পিউটারবিজ্ঞান এসবেরই একটা বর্ধিত অংশ। এভাবেই প্রযুক্তির প্রেমে পড়ি।

তবে এখনো আমি মনে করি, মানুষের জীবনে ইতিহাস ও সাহিত্যও খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে বর্তমান সময়ে। সবকিছুকে সাদা আর কালো বলে বিচার করা যায় না। ইউটিউবে আমাদের অনেক নৈতিক বিষয় নিয়ে কাজ করতে হয়, মানুষকে নিয়ে কাজ করতে হয়। বিভিন্ন বই ও সাহিত্যের অর্থ উদ্ধারের অভিজ্ঞতা এখনো আমাকে সাহায্য করে।

যখন আমি শুরু করি, ইন্টারনেট তখনো এতটা পরিচিত ছিল না। তাই অনেকে অবাক হয়েছিল। বলেছিল, তুমি কেন প্রযুক্তি খাতে কাজ করতে চাও? বিশেষ করে আমার সহপাঠী যারা ছিল, তারা তো বিশ্বাসই করতে পারছিল না। আমি একজন ক্যারিয়ার কাউন্সেলরের সঙ্গেও কথা বলেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, ‘প্রযুক্তিতে আমি তোমার কোনো ভবিষ্যৎ দেখছি না।’ কিন্তু আমি দেখছিলাম, এটা একটা সম্ভাবনাময় শিল্প। কম্পিউটার মানে শুধু কোডিংয়ে ব্যস্ত থাকা কিছু মানুষ নয়। এখানে সৃজনশীলতার অনেক জায়গা আছে।

সুজান ভোজেস্কি

গ্যারেজে ‍গুগল

আমাদের বাড়ির গ্যারেজ ভাড়া নিয়ে সেখানেই গুগলের জন্ম দিয়েছিল ল্যারি পেজ ও সার্গেই ব্রিন। এ নিয়ে অনেক গল্প শুনতে চায় মানুষ। আমাকে জিজ্ঞেস করে, ল্যারি আর সার্গেইকে গ্যারেজ ভাড়া দেওয়ার সময় তোমার মাথায় কী চলছিল? তুমি কি বুঝতে পারছিলে একটা বড় কিছু হতে যাচ্ছে? আসলে এসব কিছুই নয়। আমি শুধু ভাড়ার টাকাটাই চেয়েছিলাম।

আমার তখন কোনো চাকরি ছিল না। মাথায় ঋণের বোঝা। মাত্রই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়েছি। আমার তো যা-ও মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই ছিল। ল্যারি আর সার্গেইয়ের অবস্থা তখন আরও খারাপ। ওরা ডর্মে থাকত। কোম্পানি শুরু করার মতো কোনো জায়গা পাচ্ছিল না। সে জন্যই ওদের কাছে ভাড়া দিয়েছিলাম। পুরো ব্যাপারটাই বেশ মজার।

আমরা যখন ইউটিউব কিনে নিই, তখনো মানুষ ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না, ইউটিউব দিয়ে কী হবে? এমনকি আমরা কেনার এক সপ্তাহ আগেই পত্রিকায় একটা নিবন্ধ বের হয়েছিল। যেখানে বলা হয়েছিল, ‘বোকা না হলে কেউ ইউটিউব কিনবে না’। এটাই ছিল শিরোনাম। তারা জানত না, খুব সাধারণ মানুষও কনটেন্ট বানিয়ে সফল হতে পারে। আমার সৌভাগ্য, এসব বিষয়ে আমার ধারণা ছিল। কারণ, এর আগে গুগলে আমি ‘গুগল ভিডিও’ নিয়ে কাজ করেছি। দুটি বিষয় আমাকে ইউটিউবের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী হতে সাহায্য করেছে। প্রথমত, আমি জানতাম, মানুষ তার গল্প অন্যকে জানাতে চায়। সে কারণেই আমরা কাউকে টাকা আয় বা ভিউয়ের নিশ্চয়তা না দেওয়ার পরও বহু মানুষ এখানে ভিডিও আপলোড করে। মানুষ যে নিজের গল্প শোনাতে চায়, এটা মোটামুটি সবাই জানে। কিন্তু যেটা জানে না, তা হলো মানুষ অন্যের গল্প শুনতেও চায়।

এটা এমন একটা সময়, যখন ভিডিও বললেই মানুষ কল্পনায় একটা স্টুডিও দেখতে পেত। ভাবত, বিশাল খরচাপাতি ছাড়া ভিডিও বানানো যায় না। হঠাৎ করে কেউ যখন তার শোবার ঘরে বা উঠানে কনটেন্ট বানানো শুরু করল, গণমাধ্যমের সঙ্গে জড়িত অনেকেই ব্যাপারটা ভালোভাবে নেয়নি। কারণ, এই কনটেন্ট নির্মাতারা পেশাদার নন। কিন্তু মানুষ তো এই ভিডিওগুলোই পছন্দ করছিল। প্রথম যে ভিডিওটা খুব আলোড়ন ফেলল, সেটা হলো দুই শিক্ষার্থী তাদের ডর্মে বসে গান গাচ্ছে। পেছনে তাদের আরেক রুমমেট বসে বসে হোমওয়ার্ক করছে। এটা দেখে সবাই খুব মজা পেল। এই ভিডিও মিলিয়ন ভিউ পেয়েছিল। আর আমি বুঝেছিলাম, যে কেউ কনটেন্ট নির্মাতা হতে পারে।

জীবনের একটি দিন

খুব সকালে ঘুম থেকে উঠতে আমি পারি না। আহা, যদি পারতাম! যতটা দেরিতে উঠলে একেবারে শেষ মুহূর্তে হলেও বাচ্চাদের সময়মতো স্কুলে পৌঁছে দেওয়া যায়, আমি ঠিক ততটাই দেরিতে ঘুম থেকে উঠি। তবে প্রতিদিন সকালে ব্যায়ামটা আমার করতেই হয়। নাহলে সারা দিন ঘুম ঘুম পায়। খোলা আকাশের নিচে কিছুক্ষণ ব্যায়াম করে প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কটা ঝালিয়ে নেওয়া আমার জন্য খুব জরুরি।

আর তারপরই শুরু হয়ে যায় কাজ। করোনার পর থেকে কখনো বাসায় বসে, কখনো অফিসে গিয়ে কাজ করছি। ইউটিউব এখন কী করছে, সেটা আমার কাজের বিষয় নয়। আমি বরং মাথা ঘামাই বছরখানেক পর ইউটিউব কী করবে, তা নিয়ে। ভবিষ্যতের দিকে তাকানোর জন্যই অবশ্য আমাকে বর্তমান সম্পর্কে জানতে হয়। কোথায় কোথায় আমাদের ঘাটতি আছে, সেদিকে নজর রাখতে হয় সব সময়। যদিও ইউটিউবে বিশ্বের নানা প্রান্তের মেধাবী মানুষেরা কাজ করেন। তবু এমন কিছু কিছু জায়গা থেকে যায়, যেখানে কেউ নজর দেয়নি। যা হয়তো আমাদের বড় ঝুঁকিতে ফেলে দিতে পারে। সে জন্যই সব সময় সজাগ থাকতে হয়।

দিন শেষে বাড়ি ফিরি। সন্তানদের সঙ্গে রাতের খাবার খাই। চেষ্টা করি ঘুমানোর আগে বই পড়তে। তবে একটা অভ্যাস আমি করেছি—বাড়ি ফেরার পর আর কোনো ই–মেইল দেখি না। অফিস ও পরিবারকে সময় দেওয়ার মধ্যে সামঞ্জস্য রাখার চেষ্টা করি সব সময়। সন্তানরা যখন ডে–কেয়ারে ছিল, তখন থেকেই। এ ক্ষেত্রে অবশ্য একটা সুবিধা ছিল। ডে–কেয়ারের নিয়ম হলো, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সন্তানকে নিয়ে যেতে হবে। এক মিনিট দেরি হলেও এক ডলার জরিমানা। এই নিয়মের ফলে আমি আমার জীবনটাকেও রুটিনে বেঁধে ফেলতে পেরেছিলাম। কতক্ষণের মধ্যে অফিসের কাজ শেষ করব, কখন বাসায় সময় দেব, সব একটা শৃঙ্খলার মধ্যে চলে এসেছে।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মো. সাইফুল্লাহ