তবু কেন তাঁরা ডাক্তার হতে চেয়েছেন

মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষা হবে আগামী ১০ মার্চ। ভর্তি প্রস্তুতি থেকে শুরু করে পাঁচ বছরের পড়ালেখা—পুরো যাত্রাটাই বেশ কষ্টসাধ্য। কথায়ই তো আছে, মেডিকেলে পড়ালেখার শুরু আছে, শেষ নেই। এমনকি ডাক্তার হয়ে যাওয়ার পরও পড়ালেখা চালিয়ে যেতে হয়, করতে হয় প্রচুর পরিশ্রম। চিকিৎসাবিদ্যার একজন শিক্ষার্থী কিংবা চিকিৎসক কোথায় পান এত পরিশ্রমের অনুপ্রেরণা?

স্বপ্ন নিয়ের অনুরোধে মডেল হয়েছেন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী রিফাত ও মেধা
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

কত-না কষ্টের দিনরাত পেরিয়ে ডাক্তার হওয়া! রোজকার ‘আইটেম’ পরীক্ষা; এরপর ‘কার্ড’ পরীক্ষা, ‘টার্ম’ পরীক্ষা শেষ করে তবেই না খোলে পেশাগত পরীক্ষার দুয়ার। পেশাগত পরীক্ষাও কি চাট্টিখানি কথা! সেখানেও চারটি ধাপ পেরিয়ে তবেই না ‘ডাক্তার’ হওয়া যায়। মনে পড়ছে, তারুণ্যের রঙিন দিনগুলো ঢাকা মেডিকেল কলেজে ঢোকার পর কেমন ধূসর লাগত। এমবিবিএস পাস করেও কি দম ফেলার জো আছে? দক্ষতা বাড়াতে চাই স্নাতকোত্তর পর্যায়ের পড়ালেখা, চলে দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ।

পড়াশোনা শেষ করেও শান্তি নেই। সব সময় কিসের যেন একটা দৌড়, একটা ছুটে চলা। নেমন্তন্ন? নাহ, সময় নেই। ঈদের মতো আনন্দ-উৎসবেও পরিবারকে সময় দিতে পারেন না সব চিকিৎসক। এমনকি নিজের বিয়ের ছুটির ব্যবস্থাটাও করতে হয় বড্ড কষ্টে। রোগী দেখতে হয় দিনে-রাতে। বহির্বিভাগে, জরুরি বিভাগে কিংবা নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে। রোদের মুখ দেখা গেছে কি না, সেটাও যেন জানার ফুরসত নেই। রোদ ঝলমলে দিনে গ্রন্থাগারে ঢুকে বেরোনোর সময় আবিষ্কার হলো, পুরো শহর বৃষ্টির পানিতে ডুবে গেছে কখন! কাজ সেরে বাড়ি ফিরেও শান্তি নেই। আসতে পারে জরুরি ফোন, যেকোনো মুহূর্তে।

তবু কেন প্রতিবছর হাজারো তরুণ প্রাণ এই জগতে প্রবেশের জন্য উন্মুখ? কোন প্রেরণা তাঁদের একটার পর একটা বাধা পেরোতে সাহায্য করে? চলার পথের কোন সময়টাতে মনে হয়, কষ্টটা সার্থক? সেই প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজছিলাম।

বৈচিত্র্যের খোঁজে

ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শাহনূর শারমিন বলছিলেন, ‘এ এক বৈচিত্র্যময় পেশা। মানুষের সঙ্গে মিশতে হয় খুব কাছ থেকে। প্রতিনিয়ত মানুষের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখের গল্প শুনতে হয়। একঘেয়েমির সুযোগই নেই। একেবারে অন্য রকম জীবন। সৎ থাকার সুযোগও আছে।’ শুরুতে কিন্তু এসব ভাবেননি তিনি। বন্ধুদের সঙ্গ ভালোবাসতেন বলে তাঁদের সঙ্গে হেসেখেলেই মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন। ডাক্তারি পড়তে গিয়ে আনন্দও পেয়েছেন। তবে ভেবেছিলেন, পড়া শেষে পেশা বদলাবেন। মায়ের ইচ্ছায় ক্যারিয়ার গড়লেন মেডিসিন বিষয়ে। পেশাটাকে ভালোবাসলেন সরকারি চাকরিতে গিয়ে। অসুস্থ একজন মানুষকে কোথায় যেতে হবে, সেই নির্দেশনা দেওয়া কিংবা তাঁর আর্থিক খরচ কমানোর প্রচেষ্টাতেও তিনি আনন্দ পান। শত কষ্টেও এ পেশাতেই তাঁর পরিতৃপ্তি, মানুষের হাসিমুখগুলোই জীবনের প্রাপ্তি।

‘আমি তো এটাই চেয়েছিলাম’

ছোট্ট একটা মেয়ে যন্ত্রণাক্লিষ্ট মানুষের জন্য কিছু করতে চাইত সব সময়। বাবার সঙ্গে স্কুলে যাওয়ার পথে একদিন মারাত্মক দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তির সেবায় ছুটে আসতে দেখল সাদা অ্যাপ্রোন পরা একজন মানুষকে। অন্যরা যেখানে বীভৎসভাবে আহত ব্যক্তির দিকে তাকানোর সাহসটাও পাচ্ছিল না, সেখানে এভাবে একজনকে স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসতে দেখে মেয়েটি বাবাকে জিজ্ঞেস করল, ‘উনি কে?’ উত্তর শুনে সে বুঝে নিয়েছিল, এই পেশাতেই মানুষের কষ্টে পাশে দাঁড়ানো সম্ভব। বাবা অবশ্য ধারণা দিয়েছিলেন, এতে কতটা কষ্ট সইতে হবে। কন্যা নওশিন শারমিলি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, সব কষ্ট সয়ে নেবেন। প্রার্থনা একটাই—সৃষ্টিকর্তা যেন সেই সুযোগটুকু দেন। নিজের জীবনের এমন গল্পই শোনালেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের এই শিক্ষানবিশ চিকিৎসক। এখনো কষ্ট হলেই তাঁর মনে হয়, আমি তো এই জীবনটাই চেয়েছিলাম। আত্মতৃপ্তি নিয়েই নিজেকে কাজে নিয়োজিত রাখেন। আর পড়ালেখা? সে তো মানুষের জন্যই।

আস্থা, বিশ্বাস, ভরসা

মানুষের কষ্ট লাঘবের সুখের স্মৃতি আছে হাজারো চিকিৎসকের। এবার বরং ভিন্ন কিছু শুনি। রাজধানীর পান্থপথে অবস্থিত স্কয়ার হাসপাতাল লিমিটেডের নিউরোসার্জন এ এম রেজাউস সাত্তার বলছিলেন এমন এক রোগীর কথা, যিনি আর এ পৃথিবীতেই নেই। মানুষটির বিশ্বাস ছিল, এই চিকিৎসকের স্পর্শেই সুস্থ হয়ে যাবেন। রোগী সুস্থ হননি, কিন্তু জীবনের প্রতিটি পলে, অনুপলে তাঁর এই আস্থার গভীরতাকে তিনি অনুভব করবেন। রেজাউস সাত্তার অবশ্য নিজের ইচ্ছায় চিকিৎসক হননি। মা-বাবার ইচ্ছায় হয়েছেন। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জনের পর অবশ্য চিন্তাচেতনা বদলে গেছে। নিজ ইচ্ছাতেই হয়েছেন নিউরোসার্জন। রাতবিরাতে হুটহাট জরুরি অস্ত্রোপচারের ডাক আসে। সময়মতো অস্ত্রোপচার করলে রোগী সুস্থ হয়ে যান—এ বিষয়টাই তাঁকে অনুপ্রাণিত করে।

মেডিকেলের কঠিন শিক্ষাজীবনে এই বন্ধুত্ব, টুকটাক খুনসুটিই তাঁদের সম্বল। স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেলের কলেজের শিক্ষার্থী প্রমেশ, আফরোজা, মেধা ও রিফাত

বাসা ছেড়ে বহু দূরে

রাজধানীতে বেড়ে ওঠা শিমু আক্তার চিকিৎসক হয়েছেন পরিবারের চাওয়ায়। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে প্রচুর পড়ালেখার অভ্যাস থাকায় এমবিবিএস পর্যায়ের পড়ালেখাকে সহজভাবেই নিয়েছিলেন। কিন্তু সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজের হলে প্রথম দিকে বেশ কষ্টেই ছিলেন। শেষ দিকে অবশ্য জীবনকে উপভোগ করেছেন দারুণভাবে। পড়ালেখার চ্যালেঞ্জ প্রথম অনুভব করেন স্নাতকোত্তর পর্যায়ে প্রবেশের সময়। অচেনা মানুষও সম্মান করেন একজন চিকিৎসককে—বিষয়টা তাঁর ভালো লাগে।

সময়ের সীমা নেই

রাজধানীর আহছানিয়া মিশন ক্যানসার ও জেনারেল হাসপাতালের সার্জারি ও ক্যানসার সার্জারি বিভাগের রেজিস্ট্রার তৃষা খন্দকার সময়ের পরও কাজ করেন। কিন্তু কেন? জানা গেল, প্রচণ্ড শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীরা আসেন। আর্থিক দিকটাও বিবেচ্য। হলি ফ্যামিলি মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি লাভের পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্নাতকোত্তর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই রোগীকে নিজের আপনজন ভেবে সেবা দেওয়ার দীক্ষা পেয়েছেন। তাঁর দুই ঘণ্টার বাড়তি শ্রমে একজন রোগীর একটা দিন কম থাকতে হবে হাসপাতালে—এ কথা ভেবে তাঁর বিশ্রামটা কম হলেও শান্তি হয়।

কেমন আছেন সেরা শিক্ষার্থী?

২০০৯ সালের মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন মুহম্মদ আবু নাহিদ। সরকারি কর্মকর্তা হওয়ার পর তাঁর উপলব্ধি, অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তাকে সাধারণ মানুষ ভয়জড়ানো শ্রদ্ধার চোখে দেখেন, কিন্তু চিকিৎসা কর্মকর্তাকে তাঁরা মন থেকে সম্মান করেন। কিডনি প্রতিস্থাপনের মতো জীবন বদলে দেওয়া নানা শল্যচিকিৎসার সুযোগ আছে বলে ইউরোলজি বিষয়টা তাঁর ভালো লাগে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বিষয়েই স্নাতকোত্তর করছেন।

সেনাবাহিনীর চিকিৎসক

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেজর কাজী আবু সাঈদ নিজের ইচ্ছাতেই চিকিৎসক হয়েছেন। তবে ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়তে গিয়ে প্রথম দিকে হতাশ হয়ে পড়ছিলেন। অগ্রজদের সাহায্যে কঠিন জীবনে খাপ খাইয়েছেন। যন্ত্রণাক্লিষ্ট মানুষের বিপদের ভরসা হয়ে পেয়েছেন তাঁদের ভালোবাসা, তাঁর কাছে যা ‘অমূল্য’ সম্পদ। পেশাগত জীবনে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল ছাড়াও কাজ করেছেন পার্বত্য এলাকায়, দেশের সীমান্তে। সীমানা পেরিয়ে মানবতার দূত হয়ে জাতিসংঘের শান্তি মিশনে যাওয়ার কথা এ বছর। নিউরোসার্জন হিসেবে বিশেষায়িত সেবা দেওয়ার পথেও নিজেকে এগিয়ে নিয়েছেন, পার করেছেন এফসিপিএস ডিগ্রি অর্জনের প্রথম দুটি ধাপ।

নতুন যাঁরা

২০২১ সালে যশোর মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছেন মেহেরপুরের আব্দুস সাদিক। বড় চাচাকে অসুস্থ অবস্থায় দেখে একদিন চিকিৎসক হয়ে তাঁর সেবা করার শপথ নিয়েছিলেন। বৃহত্তর মানবকল্যাণের ভাবনাও ছিল। স্বপ্নপূরণের পথে হাঁটতে পেরে রোমাঞ্চ অনুভব করেন তিনি, উৎসাহ পান কঠিন জীবনটাতেও।

পরিবারের প্রথম চিকিৎসক হতে চলেছেন যশোরের অর্পিতা ইসলাম। ২০২২ সালে মাগুরা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছেন। অন্য পেশা তাঁর পছন্দের তালিকাতেই ছিল না। বাবা-মেয়ের স্বপ্নটা একই ছিল। এ পর্যন্ত আসতে বাবার আত্মত্যাগের কথাটা বিশেষভাবে বললেন অর্পিতা। সাদা অ্যাপ্রনটার মায়াতেই সব চাপ সামলে নিয়েছেন এ পর্যন্ত।

জীবনজুড়ে এমন অনুপ্রেরণাতেই উজ্জীবিত থাকেন চিকিৎসকেরা। জীবন বিলিয়ে দেন মানবতার সেবায়।

লেখক: ক্লিনিক্যাল স্টাফ, নিউরোমেডিসিন বিভাগ, স্কয়ার হাসপাতাল লিমিটেড, পান্থপথ, ঢাকা