সন্তানদের মানসম্পন্ন স্কুলে ভর্তির জন্য কত চেষ্টাই না অভিভাবকদের থাকে। সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে এ জন্য কোনো কোনো মা-বাবা দূরদেশেও পাড়ি জমান। অথচ অভিনেত্রী রিচি সোলায়মান ঘটালেন উল্টো ঘটনা। তিনি যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে বাংলাদেশের স্কুলে ছেলে-মেয়েকে ভর্তি করিয়েছেন। কেন এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, জানার চেষ্টা করলাম অভিনেত্রীর কাছে।
২০২১ সালের কথা। দুই সন্তানকে নিয়ে অভিনেত্রী রিচি সোলায়মান ও তাঁর স্বামী রাশেকুর রহমান মালিক তখন যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী বাসিন্দা। ছেলেটা স্কুলে পড়ে। মেয়ের বয়স সবে চার বছর। রিচির মনে হলো তাঁর অনেক দিনের ইচ্ছার কথাটা এবার স্বামীকে বলবেন। বিষয়টি ছিল, দুই সন্তানকে কয়েক বছরের জন্য হলেও ঢাকার স্কুলে ভর্তি করাতে চান। দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা দিতে চান।
রিচির ইচ্ছার কথা শুনে শুরুতে তাঁর স্বামী রাজি হলেন না। সিদ্ধান্ত নিয়ে রিচিকে ভাবতে বলেন। বিষয়টি ঠান্ডা মাথায় স্বামীকে বোঝালেন রিচি। পরে অবশ্য রাশেকুর রহমানেরও মনে হলো রিচি ঠিকই ভেবেছেন। কিন্তু পরিবারের অন্য সদস্যরা শুনে কেউ কেউ বলতে থাকেন, ‘নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারতে যাচ্ছে!’
সিদ্ধান্ত পাকা হলো, ২০২১ সালেই ঢাকায় আসবেন। সেই সময়ে তাঁদের ছেলে রায়ান মালিক বেঁকে বসল। বায়ুদূষণ, যানজটের শহর ঢাকায় আসতে সে রাজি নয়। ছেলেকে বোঝানোর পর অবশ্য মায়ের সঙ্গে আসতে রাজি হলো। অন্যদিকে মেয়ে ইলমা মালিকের বয়স তখন মাত্র চার বছর। মায়ের সঙ্গে থাকলেই তার হলো। দুই সন্তানকে নিয়ে রিচি চলে এলেন ঢাকায়।
ঢাকায় বন্ধু, আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে নানা বিষয় নিয়ে কানাঘুষা শুরু হলো। কেউ কেউ ভাবলেন, স্বামীর সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছে বলেই দেশে চলে এসেছেন রিচি। তবে সেসব কথা বেশি দূর গড়াল না। কারণ, রিচির স্বামী ছুটি পেলেই নিয়মিত ঢাকায় আসতেন। আবার রিচিও ছুটি পেলেই সন্তানদের নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যেতেন। এর মধ্যে ছেলে-মেয়েকে ঢাকার একটি মধ্যমে মানের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি করানো হলো। নিকটজনদের কাছে সেই স্কুলে ভর্তি করানো নিয়েও কথা শুনতে হয়েছে।
কাছের মানুষের কাছে প্রতিটি বিষয়ে এ রকম কথা শুনে শুনে অনেকটাই হয়রান রিচি। কেউ ঢাকায় আসার পুরো কথা না শুনেই মন্তব্য করতে ছাড়ে না। কেউ ভুল ব্যাখ্যা করে। জানতে চায়, কেন সন্তানদের ঢাকার স্কুলে ভর্তি করালেন।
রিচি বলেন, ‘আমার সন্তানেরা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। হয়তো সেখানেই পরবর্তী দিনগুলো কাটাবে। কিন্তু আমি চেয়েছি, তারা একটু বাংলাদেশকে জানুক। তারা শিকড়ের কথা জানুক। বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণাটা নিক। এখানে দাদা-দাদি, নানা-নানিসহ আত্মীয়স্বজনের সম্পর্কের গভীরতা সম্পর্কে জানাতে চেয়েছি। যেখানেই থাকুক, কোনো দিনও যেন শেকড়কে না ভোলে। এভাবে সবাইকে যখন বুঝিয়ে বললাম, তখন সবাই বিষয়টি বুঝল।’
একেকটা দেশে সন্তানেরা একেক রকমভাবে বেড়ে ওঠে। মার্কিন সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য শৈশবেই সন্তানদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চাননি রিচি। তাই বেছে নিয়েছেন দেশের ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক আবহ। তাঁর সন্তানেরা এখন বাংলায় কথা বলে। গান গায়। পয়লা বৈশাখ, শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসের মতো গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলো সম্পর্কে জানছে। স্কুল থেকে দিনগুলো উদ্যাপনে অংশ নিচ্ছে। দেশের গুণীদের সম্পর্কে জানছে।
রিচি সোলায়মান বলেন, ‘আমি শুরুর দিকে চিন্তায় ছিলাম। এখানে এলিমেন্টারিতে পড়াশোনায় চাপ বেশি। অনেক পড়াশোনা করতে হয়। ওরা খাপ খাওয়াতে পারবে কি না। পরে দেখি উল্টো। আমার ছেলে সবকিছুর সঙ্গে আস্তে আস্তে মানিয়ে নিয়েছে। এখন বাংলা তার ভালো লাগে। ছেলেই বলছে, ও লেভেল এখানে শেষ করে তবেই যুক্তরাষ্ট্রে ভর্তি হবে।’
প্রথম দিকে সবাই না বুঝলেও এখন রিচির চিন্তাকে সবাই প্রশংসা করে। রিচি বলেন, ‘আমার স্বামী চাকরি করেন। তিনি ব্যস্ত মানুষ। তাঁর পক্ষে সন্তানদের খুব বেশি সময় দেওয়া সম্ভব ছিল না আর আমি যুক্তরাষ্ট্রে একা। সাহায্য করার মতো কেউ নেই। সেই কারণেও আমি ঢাকাতে আসতে চেয়েছি। এখানে একই সঙ্গে তাদের ভিত্তিটা তৈরি হলো।’
ছেলে রায়ান এখন ক্লাস সেভেনে ও মেয়ে ইলমা কেজি ওয়ানে পড়ে। তাদের নিয়েই কাটে রিচির সময়। এখন স্কুল গ্রীষ্মকালীন ছুটি। এর মধ্যে পুরো পরিবার জাপান ভ্রমণ করেছে। তারপর চলে গেছে যুক্তরাষ্ট্রে। এভাবেই চলছে রিচির দিনকাল।
অভিনেত্রী বলেন, ‘দেশের বাইরের অনেক স্কুলে এখন শুধু মা-বাবার সন্তানের প্রতি কী দায়িত্ব, সেটাই শেখানো হয়, শিশুদের অনেক আগেই শেখানো হয় জন্মনিয়ন্ত্রণের মতো অনেক বিষয়। আমি বলছি না এগুলো শেখানো খারাপ। এটা তাদের সংস্কৃতির সঙ্গে যায়। যে কারণে শেখাচ্ছে। কিন্তু আমি চেয়েছি, আমার মতো করেই আমার সন্তানেরা বড় হোক। ওরা যখন বুঝবে, তখন তাদের মতো করে জীবনযাপন করবে। যেটা ভালো মনে করে, সেটাই করুক। তারপরও একটাই আশা, কোনো দিন যদি আমাদের ছেলে-মেয়েরা ভালো ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার বা যা–ই হোক, কিছু একটা হয়, তখন দেশের প্রতি ভালোবাসা থেকে কিছু একটা ওরা যদি করে, এটাই আমাদের বড় প্রাপ্তি।’