‘পড়ছি, ব্যবসাও করছি’ শিরোনামে প্রথম আলোর ‘স্বপ্ন নিয়ে’ পাতায় একটি প্রতিবেদন ছাপা হয় ২০১৭ সালে। পড়ালেখার পাশাপাশি ব্যবসা করছেন, এমন তিন তরুণের কথা ছাপা হয়েছিল সেখানে। হাজারো পাঠকের পাশাপাশি খালিদ বিন আওলাদেরও চোখে পড়ে খবরটি। তিনি তখন বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থী। তখন থেকেই তাঁর মনের ভেতর একটা স্বপ্ন দানা বাঁধতে শুরু করে।
পরে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগে ভর্তি হন খালিদ। ২০১৯ সাল থেকে গার্মেন্ট (পোশাক) ব্যবসার নানা দিক সম্পর্কে জানার চেষ্টা শুরু করেন। বাজারে কী কী ধরনের কাপড় আছে, কোনটা ভালো, নিট ফেব্রিক কী, ওভেন ফেব্রিক কোনটা, নানা বিষয় জানা হয়ে যায়। কীভাবে কাপড় তৈরি হয়, উৎপাদন খরচ কেমন, এসবেরও খোঁজ নেন খালিদ। কিন্তু প্রকৌশলের পড়ার চাপে তখন আর কাজ এগোতে পারেননি।
২০২০ সালে করোনার প্রকোপে যখন দীর্ঘ ছুটি শুরু হলো, তখন সময়টা কাজে লাগানোর চেষ্টা করেন খালিদ। সে বছরই জুলাই মাসে ৩০০ টি–শার্টের অর্ডার নেন তিনি। সেই শুরু।
প্রথমবার অন্যের কারখানা থেকে টি–শার্ট তৈরি করলেও ২০২১ সালে নিজেই একটা ছোটখাটো পোশাক কারখানা চালু করে ফেলেন চুয়েটের চতুর্থ বর্ষের এই শিক্ষার্থী। টিউশনির জমানো টাকায় গড়া এই কারখানার নাম দেন মায়ের নামে—নাহার অ্যাপারেলস। মাত্র তিনজন কর্মী নিয়ে শুরু হয় কার্যক্রম। চট্টগ্রামের সিডিএ এলাকায় ছোট্ট একটা জায়গায় যন্ত্রপাতি কিনে অর্ডার নেওয়া শুরু করেন।
খালিদ বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে উদ্যোক্তা হওয়ার আগ্রহ ছিল। অনেক চিন্তাভাবনা করে ঠিক করলাম, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাত গার্মেন্টসের সঙ্গেই যুক্ত হই। দেশের সবচেয়ে বেশি জনবল এই খাতে কাজ করে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও অর্থনীতিতে অংশগ্রহণ করার জন্য এর চেয়ে ভালো কোনো বিকল্প হতে পারে না।’
খালিদের এই ব্যবসার ট্রেড লাইসেন্স আছে। কিন্তু আমদানি বা রপ্তানির অনুমোদন না থাকায় এখনো দেশের বাইরে ব্যবসা বিস্তৃত করার সুযোগ পাননি। দেশ থেকেই সংগ্রহ করতে হচ্ছে কাঁচামাল। তবে ভবিষ্যতে আরও বড় পরিসরে কাজ করতে চান প্রকৌশলের এই শিক্ষার্থী। খালিদ বলেন, ‘বাংলাদেশে ব্র্যান্ডের দোকানগুলোতে কাপড়ের দাম অনেক বেশি। ভালো মানের কাপড় তাই নিম্নমধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত অনেকেরই সাধ্যের বাইরে। এমন একটি ব্র্যান্ড আমি প্রতিষ্ঠা করতে চাই, যার পণ্য সব শ্রেণির মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকবে। ভবিষ্যতে পোশাক রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয়েরও পরিকল্পনা আছে।’
নাহার অ্যাপারেলসে কর্মীর সংখ্যা এখন ৪০ জনের বেশি। চট্টগ্রামের আগ্রাবাদের চৌমুহনী এলাকায় চলছে খালিদের পোশাক কারখানার কার্যক্রম। তাঁর কারখানায় বিভিন্ন পোশাক তৈরির সুইং মেশিন যেমন সিঙ্গেল নিডেল, টু নিডেল, ফ্লাড লক, ওভারলক, ইন্টারলক, বারটেক, বাটন হোল, বাটন স্টিচ ইত্যাদি আছে। তৈরি হচ্ছে টি–শার্ট, পোলো শার্ট, অন্তর্বাস, ছেলেদের প্যান্ট, সুইমিং শর্টস, পাঞ্জাবি, ক্রপ টপ, হাফহাতা শার্ট, ফুলহাতা শার্ট, জ্যাকেট, জগার্স ইত্যাদি।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের যন্ত্রকৌশল বিভাগের তৃতীয় বর্ষে পড়েন ওয়াসিফ সাদমান। করোনাকালে বিভিন্ন দলের জার্সি ও টি–শার্ট বিক্রি করতে শুরু করেন তিনি। পরে বন্ধুবান্ধব, পরিচিত অনেকেই ওয়াসিফের কাছে টি–শার্টের ফরমাশ নিয়ে আসতে শুরু করেন। তখন বিভিন্ন পোশাক কারখানার সঙ্গে যোগাযোগ করে টি–শার্ট বানিয়ে দিতেন এই তরুণ। এসব করতে করতেই পোশাক খাত সম্পর্কে তাঁর ভালো একটা ধারণা হয়ে যায়।
পরে টিউশনির জমানো টাকায় নিজস্ব উদ্যোগে টি–শার্টের একটি ফ্যাশন ব্র্যান্ড দাঁড় করান তিনি। নাম দেন আর্টটায়ার। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ভাই খালিদ বিন আওলাদের সঙ্গেও যোগাযোগ করেন। বিভিন্ন বিষয়ে তাঁকে সাধ্যমতো সহযোগিতা করেন খালিদ।
প্রথম প্রকল্পে প্রায় এক হাজার টি–শার্ট বিক্রি করেন তানিম। বিভিন্ন পোশাক কারখানা থেকে তৈরি করে টি–শার্ট সরবরাহ করেছিলেন তিনি। নিজেই কীভাবে পণ্য তৈরি করা যায়, এসব নিয়ে ভাবতে শুরু করেন তিনি।
একসময় ক্ষুদ্র পরিসরে চট্টগ্রামের দেওয়ানবাজারে একটি পোশাক কারখানা চালু করে ফেলেন। কারখানায় আছে কাটিং মেশিন, সুইং মেশিন, প্রিন্টিংয়ের ব্যবস্থা। তৈরি হচ্ছে টি–শার্ট, হুডি ও জ্যাকেট। এ ছাড়া ওয়াসিফের কারখানায় কাস্টমাইজড জার্সিরও ফরমাশ নেওয়া হয়।
ওয়াসিফ বলেন, ‘শুরুতে একাই সবকিছু দেখতাম। শুধু একজন ডিজাইনার ছিল। এখন আমাদের ৪০ জন অংশীদার আছেন, বিক্রির ওপর যাঁরা কমিশন পান। আরও আছেন দুজন ডেলিভারি ম্যান, একজন ডিজাইনার, একজন সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবস্থাপক। কারখানা ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে আছেন দুজন। আমাদের এই ব্যবসায় মৌসুম অনুযায়ী লাভ হয়। যেমন গত শীতে আমরা প্রায় ৩৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ে আড়াই হাজার হুডি, পাঁচ শ জ্যাকেট, দুই হাজার টি–শার্ট বিক্রি করেছি। প্রায় ১২ লাখ টাকার কাপড় বিক্রি করেছি। লাভ ছিল ৪০ শতাংশের মতো।’
প্রকৌশলে পড়ার পাশাপাশি এ ধরনের ব্যবসার কথা মাথায় এল কেন? তানিম বলেন, ‘আমার বাবা-চাচা সবাই ব্যবসা করতেন। এ জন্য কলেজজীবনের পর থেকেই আমার ব্যবসার প্রতি আগ্রহ। মা-বাবা সব সময় অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। পড়ালেখার পাশাপাশি টিউশনি তো অনেকেই করে। কিন্তু টিউশনির অভিজ্ঞতা পরে পেশাজীবনে খুব একটা কাজে লাগে না। তাই আমি শিক্ষাজীবন থেকেই নিজের একটা স্টার্টআপ শুরু করতে চাইছিলাম।’
আর্টটায়ারকে বিশ্বমানের একটি ফ্যাশন ব্র্যান্ডে পরিণত করতে চান ওয়াসিফ। ভবিষ্যতে পোশাক রপ্তানিরও ইচ্ছা আছে।
করোনা ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্বের অর্থনীতিতেই একটা ধাক্কা লেগেছে। যার প্রভাব পোশাক খাতেও পড়ছে। ওয়াসিফ মনে করেন, প্রযুক্তি ও শিল্পের সমন্বয় ঠিকভাবে করতে পারলে পোশাক খাতের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুর্ভাবনার কিছু নেই। সেই লক্ষ্যেই এগোতে চান তিনি।