কোথাও কোমরসমান পানি, কোথাও গলাসমান, সঙ্গে তীব্র স্রোত। এর মধ্যেই তিন কিলোমিটার পথ পাড়ি দিলেন। পথে যেতে যেতে দেখলেন দুর্গত মানুষের অসহায়ত্ব। ছাগলনাইয়ার শিলুয়ায় যাওয়ার অসহনীয় দুর্ভোগের কথা শোনাচ্ছেন কাজী সুলতানুল আরেফিন
আমি ঢাকাতে ছিলাম। ২১ আগস্ট ফেনীতে পৌঁছাই। সেখান থেকে ছাগলনাইয়ার পথ ধরে দেখি মূল সড়কে যান চলাচল বন্ধ। আমার মতো আরও কয়েকজনকে পেলাম। সবাই মিলে
কাকুতিমিনতি করে একজন পিকআপ চালককে রাজি করাই। আমাদের নিয়ে এগিয়ে চলেন তিনি। ছাগলনাইয়ার পাঠাননগর অবধি পৌঁছানোর পর পিকআপেরও আর এগোনোর উপায় থাকে না। সেখান থেকে আমাদের গ্রাম শিলুয়া আরও ৩ কিলোমিটার।
মরলে পরিবারের কাছে মরব—এই পণ করে পানিতে নেমে পড়ি। কোমরসমান পানি, সঙ্গে স্রোত। স্রোতের বিপরীতে যেতে হচ্ছে। রীতিমতো যুদ্ধ করে এগিয়ে চলা। এভাবে এক ঘণ্টায় মোটে এক কিলোমিটার এগোতে পারলাম। সেই জায়গাটার নাম কন্ট্রাক্টর মসজিদ। সেখানে একটু জিরিয়ে আবার এগোতে থাকি।
কোমরসমান পানিতে বাড়ির দিকে এগোতে এগোতে কত কিছুর যে সাক্ষী হলাম। চোখের সামনে দুই কিশোর ভারসাম্য হারিয়ে ভেসে যেতে দেখে চিৎকার করে গাছ জড়িয়ে ধরতে বলি। গাছ ধরে কোনোমতে জীবন রক্ষা করে তারা। গাছের সঙ্গে একটি গরু আটকা থাকতে দেখলাম। স্রোতে কারও একটা ছাগল ভেসে যাচ্ছিল। আমার গা ঘেঁষে একটা বিষধর সাপ চলে গেল। জীবন বাঁচাতে সেও মরিয়া, আমিও।
অধিকাংশ বসতবাড়ির একতলায় পানি উঠে গেছে। অনেকে পাকা মসজিদ-মাদ্রাসার ছাদে আশ্রয় নিয়েছে।
কন্ট্রাক্টর মসজিদ থেকে আমাদের বাড়ির কাছাকাছি ইটভাটা অবধি প্রবল স্রোত আর বুকসমান পানি ঠেলে আসতে লাগল আরও এক ঘণ্টা। এদিকে হেঁটে যাওয়া বিপজ্জনক। কিন্তু বিকল্পও নেই। আমার বাড়ির রাস্তায় এসে দেখি গলাসমান পানি। কোনোমতে নাক উঁচিয়ে মাথা তুলে অনুমান করে করে বাড়ির দিকে এগোই। আমাদের বাড়িটা একটু উঁচু জায়গায়। তারপরও চৌহদ্দি ডুবে গেছে। কসরত করে ভেতরে ঢুকে ঘরের দরজায় দাঁড়াই।
মুহুরী নদী আমাদের বাড়ি থেকে তিন কিলোমিটার। নদীতে পানি বাড়লেও তার প্রভাব আমরা খুব একটা টের পেতাম না। সর্বশেষ মনে আছে ছোটবেলায় বাড়ির পাশের রাস্তায় হাঁটুসমান পানি দেখেছিলাম। ৪০ বছরের জীবনে সেই শেষ। কিন্তু এবার যা দেখছি, এ এক ভীতিকর পরিস্থিতি।
আমাদের বাড়িটা দোতলা। চোখের সামনে ধীরে ধীরে পানি বাড়তে দেখলাম। সেই পানি ঘরে ঢুকে গেল। দ্রুত একতলা থেকে বিছানা, কাপড়চোপড় আর খাবারদাবার যা ছিল দোতলায় তুলে নিই। আর কোনো আসবাব সরাতে পারলাম না। মুহূর্তে পানিতে তলিয়ে গেল।
আশপাশের বাড়ি থেকে মানুষ এসে আমাদের বাসায় আশ্রয় নিল। আসলে গ্রামে যেসব দোতলা বাড়ি আছে, সবই এখন বন্যা-আশ্রয়কেন্দ্রের মতো হয়ে গেছে। ২১ আগস্ট রাতটা অস্থিরতায় কাটল।
২২ আগস্ট সকাল হতেই রাস্তায় মাথার ওপরে পানি। দোতলার ৩ রুমে আমরা প্রায় ৩০ জনের মতো আছি। কেউ কেউ ছাদেও গিয়ে বসে আছে। সামন্য কিছু শুকনা খাবার আছে, মিলেমিশে অল্প অল্প করে খাচ্ছি। মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই। এমন পরিস্থিতি কোনো দিকেই কারও খোঁজ নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
জানি না পানি আরও বাড়লে কী হবে?