সামনে দাঁড়িয়ে কোল্ডপ্লের কনসার্ট দেখতে কেমন লাগে

অনেকে বলে, কোল্ডপ্লের কনসার্ট সামনে থেকে দেখার সুযোগ একবার পেলেও জীবনটা বর্তে যায়
ছবি: কোল্ডপ্লের ফেসবুক পেজ থেকে

বেলা দুইটা, ২২ নভেম্বর ২০২৩। কুয়ালালামপুরে সকাল থেকে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। শহর থেকে কিছুটা দূরে, বুকিত জলিল জাতীয় স্টেডিয়ামের গেটে দাঁড়িয়ে আছি। ঝুম বৃষ্টির মধ্যে এখানে মানুষের বিশাল ভিড়। ভিড়ের কারণ—এখানেই আজ গান শোনাবে খুব বড় মানের ছোট্ট একটি দল। দলটির নাম কোল্ডপ্লে!
কোল্ডপ্লের গান বিশ্বজুড়ে ছেলে–বুড়ো সবার কাছে জনপ্রিয়। অনেকে বলে, তাদের দেখার সুযোগ একবার পেলেও জীবনটা বর্তে যায়। কনসার্টের টিকিট সংগ্রহ করতে গিয়েই অবশ্য সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। প্রায় ৬ মাস আগে ভোর ৫টা থেকে অনলাইনে ‘লাইন ধরে’ এই টিকিট কাটতে হয়েছে। টিকিট ছাড়ার ২ ঘণ্টার মধ্যেই প্রায় ১ লাখ মানুষের ধারণক্ষমতার স্টেডিয়ামটির সব টিকিট বিক্রি হয়ে যায়। অনেকেই পরে চড়া দামে কালোবাজার থেকে টিকিট কিনেছেন।

বেলা দুইটায় আমরা দাঁড়াই ‘স্ট্যান্ডিং জোন’-এ ঢোকার লাইনে। এরপর মঞ্চের সামনে যাওয়ার জন্য বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত অপেক্ষা। আগে আগে লাইন দিতে পেরেছিলাম বলেই একদম মঞ্চের কাছাকাছি একটা জায়গা পেয়ে যায় আমাদের ১০ জনের দলটা। ঢোকার সময় সবার হাতে দেওয়া হয় লাইট জ্বলা হাতের ব্যান্ড, আর একটা ব্যাজ। এই কষ্টটা এড়াতে চাইলে আসনসহ টিকিটও কাটা যেত। বসার সিটগুলো মূল স্টেজ থেকে কিছুটা দূরে হলেও সেখানে কয়েক ঘণ্টা আগে থেকে লাইনে দাঁড়ানোর প্রয়োজন হয় না। কিন্তু কোল্ডপ্লের কনসার্ট বলে কথা! বসে বসে কি আর এই গান শোনা যায়?
কনসার্ট শুরু হতে তখনো অনেক দেরি। তখনো কুয়ালালামপুরের আকাশে বৃষ্টি থামার কোনো চিহ্ন নেই। রেইনকোট পরে সবাই বসে আছি মঞ্চের সামনে। অপেক্ষার মাঝেই জানতে পারি, কোল্ডপ্লের প্রতিটি কনসার্ট কতটা পরিবেশবান্ধব। জানলাম, টিকিটের টাকা দিয়ে কত ধরনের পরিবেশ উন্নয়নমূলক কর্মসূচিতে অবদান রাখে এই বিখ্যাত ব্যান্ড।

সবার হাতেই দেওয়া হয়েছিল লাইট জ্বলা ব্যান্ড


দীর্ঘ ৩ ঘণ্টা বৃষ্টিতে অপেক্ষা করার পর রাত ৮টায় মঞ্চে ওঠেন প্রথম শিল্পী বুঙ্গা। তিনি মালয়েশিয়ার একজন র‍্যাপার। পাক্কা ৩০ মিনিট মঞ্চ মাতিয়ে রাখলেন তিনি। বুঙ্গা নেমে যাওয়ার পর শুরু হলো অনন্তকালের এক অপেক্ষা—ক্রিস মার্টিনকে দেখার জন্য অপেক্ষা। ডানে–বাঁয়ে উঁকি দিতে দিতে হঠাৎ দেখি সবার হাতের ব্যান্ডে লাল রং জ্বলে উঠল। মাথার ওপর উড়তে শুরু করল হাজারো রঙের কনফেত্তি। মঞ্চের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত দৌড়ে ‘প্যারাডাইস’ গানটা গেয়ে ক্রিস মার্টিন শুরু করলেন আমাদের জীবনের অবিস্মরণীয় এক অভিজ্ঞতা। আমরাও যেন ঢুকে পড়লাম একটা অন্য প্যারাডাইস, অর্থাৎ স্বর্গে।

ব্যান্ডটির প্রাণশক্তিতে আমরা সবাই হতভম্ব। বৃষ্টির মধ্যে একমুহূর্তের জন্যও থামল না গান। বেশ কয়েকবার শ্রোতাদের ধন্যবাদ জানালেন বৃষ্টিতে তাঁর জন্য এতক্ষণ অপেক্ষা করার জন্য। এমনকি তাৎক্ষণিকভাবে বানিয়ে গাইলেন ‘মালয়েশিয়ান রেইন’ নামের ছোট্ট একটি গান। পুরো তিন ঘণ্টায় একবারের জন্যও সারা দিনের ক্লান্তি উঁকি দেওয়ার সুযোগ পায়নি।

বৃষ্টি তাঁদের দমাতে পারেনি একটুও


কনসার্টের প্রস্তুতি নেওয়ার সময় একজন বলেছিল, কোল্ডপ্লের কনসার্টে খারাপ সিট বলতে কিছু নেই। এ কথায় বিন্দুমাত্র ভুল নেই। সামনে থেকে সৌন্দর্য যেমন, দূর থেকে দেখলেও নতুন মাত্রায় অভিজ্ঞতা পাবেন শ্রোতারা। একের পর এক ছোটবেলা থেকে শুনে আসা প্রিয় গানগুলো গেয়ে শোনালেন জাদুকরেরা। বৃষ্টির জন্য যেন নতুন এক রূপ পেয়েছিল পুরো কনসার্ট। প্রিয়জনের পাশে দাঁড়িয়ে ‘ইয়েলো’ গান শোনার সময় দেখলাম চারদিকে তারার মতো সবার হাতের ব্যান্ডটি জ্বলজ্বল করছে। তবে শুধু এখানেই জাদু শেষ নয়; অন্ধকারে জ্বলজ্বল করা বিশাল বেলুন কিছুক্ষণ পরে ছুড়ে দেওয়া হলো শ্রোতাদের মাঝে। স্টেডিয়ামের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে সেই বেলুন ছোড়াছুড়ি করল অনেকেই।
আগে যদি কোল্ডপ্লের কোনো কনসার্টের ভিডিও দেখে থাকেন, তবে নিশ্চয়ই জানেন, আতশবাজি ছাড়া তাদের কনসার্ট অসম্পূর্ণ। আতশবাজিতে আকাশ ছেয়ে যাওয়ার আগে ভক্তদের কাছে বিশেষ এক অনুরোধ করলেন ক্রিস মার্টিন। তাঁদের সবচেয়ে জনপ্রিয় গানের একটি—‘স্কাই ফুল অব স্টারস’ শুরু করার আগে সবাই যেন মুঠোফোনটা নিজেদের পকেটে রাখি। স্মার্টফোনের কথা ভুলে গিয়ে এইটুকু সময় যেন নিবিড়ভাবে আমরা শুধু তাঁকেই দিই। সত্যি বলতে, কনসার্টের সেরা মুহূর্ত ছিল এটাই। গানটির কোরাসের সময় বন্ধুদের হাত ধরে দেখলাম কুয়ালালামপুরের আকাশে আতশবাজি—সত্যিই মনে হচ্ছিল স্কাই ফুল অব স্টারস (আকাশভরা তারা)।
‘ফিক্স ইউ’ গানটি দিয়ে শেষ হলো ৩ ঘণ্টার শো। শুনতে শুনতে মনে হলো জীবনের সব দুঃখবোধ হয়তো সত্যিই হারিয়ে গেছে। আবার দেখা হওয়ার প্রত্যয় নিয়ে মঞ্চ থেকে বিদায় নেন পাঁচ জাদুকর। না ভেজা চোখ নিয়ে সেদিন স্টেডিয়াম থেকে বের হতে পারিনি আমরা কেউ।
স্টেডিয়াম থেকে একবারে এক লাখ মানুষ বের হওয়ার ভিড় মানেই বিরাট হ্যাপা। হোটেলে ফিরতেই লাগল প্রায় তিন ঘণ্টা। তবে ট্যাক্সির স্বল্পতা থাকার কারণে এই সময় গণপরিবহন ব্যবহার করাটাই শ্রেয়। এই কারণে মালয়েশিয়া সরকার শুধু ওই দিনের জন্য মেট্রো–সুবিধা রাত একটা পর্যন্ত চালু রেখেছিল। সারা দিন বৃষ্টিতে ভিজে পরদিন জ্বর, ঠান্ডা, কাশি, সব একসঙ্গে ভর করলেও একবারও মনে হয়নি কনসার্টটা না দেখলেই ভালো হতো, বরং জীবনে যদি আবার কখনো সুযোগ হয়, এমন কনসার্ট দেখব অবশ্যই। আবার জ্বর-ঠান্ডা-কাশি চেপে ধরলেও!