ফেসবুকে আমি কেন মানুষকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করি?

পাঠকের কাছ থেকে মনোজগৎ, ব্যক্তিজীবন ও সন্তান পালনের মতো সমস্যা নিয়ে ‘পাঠকের প্রশ্ন’ বিভাগে নানা রকমের প্রশ্ন এসেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশন অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক মেহতাব খানম নির্বাচিত একটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন এবার।

পরামর্শ দিয়েছেন মেহতাব খানম

প্রশ্ন: আমার বয়স ২৯ বছর। পেশায় একজন ব্যাংকার। আমার অবসরের বেশির ভাগ সময় ফেসবুকে কাটে। ফেসবুকে থাকা অবস্থায় বিভিন্ন পোস্টের নিচে নেতিবাচক কমেন্ট করে থাকি। কখনো কখনো কমেন্টগুলো বেশি আক্রমণাত্মক হয়ে যায়। বিশেষ করে আমার পছন্দের রাজনৈতিক দল এবং ব্যক্তির পোস্টের নিচে অন্যরা কিছু বললে বেশি নেতিবাচক ও আক্রমণাত্মক কমেন্ট করি। এ ছাড়া কোনো পোস্টে যদি বানানগত ভুল চোখে পড়ে, তখনো ব্যক্তিগত আক্রমণ করি। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় কী?

মোস্তাফিজ, রংপুর

উত্তর: আপনার চিঠি পড়ে ভালো লাগছে এই ভেবে যে নিজের আচরণের ব্যাপারে সচেতন হয়ে এই বিষয়ে সহায়তা চেয়েছেন। আমরা অনেকেই নানা ধরনের আক্রমণাত্মক মন্তব্য করে অন্যের মনে কষ্ট দিয়ে থাকি, কিন্তু সেটির জন্য কিছুটা অনুতপ্ত হলেও তাঁদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করা বা নিজেকে শুধরে নেওয়ার তেমন কোনো চেষ্টা করি না। আপনি অবশ্য জানাননি, সামাজিক মাধ্যমে আপনার ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ দেখে কেউ আপনাকে এটি করা থেকে বিরত থাকতে বলেছেন কি না। যদি তা না হয়, তাহলে আপনি কি নিজের মধ্যেই কোনো সতর্কবার্তা শুনতে পেয়েছেন? যেভাবেই হয়ে থাকুক, আপনার এই বোধোদয় সত্যিই অত্যন্ত প্রশংসার দাবিদার।

জাতিগতভাবে আমাদের সবার আরও শিক্ষিত মানসিকতা অর্জন ও তার চর্চা করার প্রয়োজন রয়েছে। প্রাক্‌-শৈশব থেকেই মনোভাব গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। তখন থেকে সন্তানদের ইতিবাচক শৃঙ্খলার ভেতর দিয়ে বড় করার সঙ্গে সঙ্গে স্নেহ-ভালোবাসার মিশ্রণ ঘটাতে পারলে তারা নিজের ও অন্যের প্রতি নমনীয় মনোভাব পোষণ এবং সেই অনুযায়ী আচরণ করতে শেখে।

আমাদের বিদ্যালয়গুলোতেও খুব ছোট বয়স থেকে জীবনদক্ষতা প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন। পাঠ্যপুস্তকের মুখস্থবিদ্যার চাইতে সুস্থ জীবনাচরণ চর্চা ও সেটির প্রয়োগ অনেক বেশি গুরুত্ব বহন করে। পরমতসহিষ্ণুতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মূল্যবোধ, যা উন্নত বিশ্বের বিদ্যালয়ে খুব সুন্দরভাবে শেখানো হয়।

আমরা শিশুদের ইতিবাচক আচরণ শেখাতে গিয়ে তাদের ভালো দিকগুলোর প্রশংসা না করে নেতিবাচক দিকগুলোর জন্য বকাঝকা করে থাকি। অথচ এই বিষয়গুলো সংশোধন করা তখনই সম্ভব হয়, যদি আমরা কারও প্রশংসা করে, তারপর ইতিবাচকভাবে তাকে কাঙ্ক্ষিত আচরণে সহায়তা করতে পারি। আমার মনে আছে, একটি তিন বছরের শিশুকে তার নামটি জিজ্ঞেস করেছিলাম। শিশুটি আমাকে কোনো পাত্তা না দিয়ে একটি খাতায় আঁকিবুঁকি করছিল। ওর মা তখন রাগ হয়ে ধমকের সুরে বলল, নাম না বললে ম্যাডাম কিন্তু অনেক রেগে যাবেন। অথচ মায়ের বলা উচিত ছিল, তুমি তো অনেক লক্ষ্মী মেয়ে, সুন্দর করে নামটি বললে উনি খুব খুশি হবেন।

জানি না, আপনি শৈশবে পরিবারে বা বিদ্যালয়ে বেশি শাসনের শিকার হয়েছেন কি না, যার ফলে আপনার মধ্যে রাগ, জেদ আর অনেক বিরক্তি কাজ করে। কেউ আপনার মতের বিরুদ্ধে গেলে বা আপনি যেভাবে চান সেভাবে না ঘটলে আপনি কি খুব রেগে যান? আপনার ভেতরের সত্তাটিকে কি আপনি নিঃশর্তভাবে গ্রহণ করতে পারেন, নাকি অবচেতনভাবে নিজের আচরণগুলো নিয়ে নিজেকে প্রায়ই শাসন করছেন? পরবর্তী সময়ে অপরাধবোধে ভুগছেন কি না, ভালো করে ভেবে দেখুন, কেমন?

আমার অনুরোধ থাকবে, অন্যের ও নিজের প্রতি আরও ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করার অনুশীলন করুন। অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। সেই সঙ্গে নিজেকে খুব বেশি দোষারোপ না করে, বরং ভবিষ্যতে আরও সতর্ক থাকার ব্যাপারে নিজের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হোন।

আপনি হয়তো ভাবছেন, অন্যের ভুল বা ভিন্নমত নিয়ে আপনার প্রতিক্রিয়ায় আমি কেন আপনাকে নিজের আচরণগুলোকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে বলছি। গবেষণা বলছে, আমরা যদি আমাদের ভুলত্রুটির জন্য নিজেকে কঠোরভাবে সমালোচনা করা বন্ধ করি এবং নিজের মতামতকে শ্রদ্ধার চোখে দেখতে শিখি, যা অবশ্যই অন্যের কোনো ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে না, তাহলে অন্যদের স্বাধীন মতপ্রকাশের ব্যাপারেও উদার হতে পারব।

ঘোষণা

পাঠকের প্রশ্ন পাঠানো যাবে ই–মেইলে, ডাকে এবং প্র অধুনার ফেসবুক পেজের ইনবক্সে।

ই–মেইল ঠিকানা: adhuna@prothomalo.com (সাবজেক্ট হিসেবে লিখুন ‘পাঠকের প্রশ্ন’)

ডাক ঠিকানা: প্র অধুনা, প্রথম আলো, ১৯ কারওয়ান বাজার, ঢাকা ১২১৫।

(খামের ওপর লিখুন ‘পাঠকের প্রশ্ন’) ফেসবুক পেজ: fb.com/Adhuna.PA