হাতখরচের টাকায় চলচ্চিত্র বানিয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থীরা

কাবেরী ছবির একটি দৃশ্য
কাবেরী ছবির একটি দৃশ্য

ছোটবেলা থেকেই চলচ্চিত্রের প্রতি ঝোঁক। নিজস্ব একটা বন্ধুমহল ছিল, ছিল সেকেলে মুঠোফোন। প্রাথমিকের গণ্ডি পেরোনোর পর তা দিয়েই শুরু হয় মজার মজার ভিডিও বানানো। একসময় ভর্তি হন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগে। শামীম রানা এখন ক্যাম্পাসের চলচ্চিত্র সংসদের সভাপতি। তাঁর পরিচালনায়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদের উদ্যোগে সম্প্রতি নির্মিত হয়েছে একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। ৫০ মিনিট দৈর্ঘ্যের ছবিটির নাম কাবেরী। ছবির পরিচালনা থেকে শুরু করে প্রযোজনা, পরিবেশনা, নির্মাণ, সবই করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী। অভিনয় করেছেন ঋতুপর্ণা দত্ত, ইউনুস রানা, সায়হাম সালামসহ ১২ শিক্ষার্থী।

সিনেমাও যখন বন্দী

২০১৯ সালে শুরু হয়েছিল ছবির কাজ। সে বছরই শুটিংয়ের ৮০ ভাগ কাজ শেষ হয়ে যায়। পরের বছর বাকি কাজ নিয়ে সবাই যখন প্রস্তুত হচ্ছেন, তখন করোনার ধাক্কায় থমকে যায় সব। প্রায় এক বছর সবাই ঘরবন্দী থাকায় ‘লাইট-ক্যামেরা-অ্যাকশন’ বলার সুযোগই আর হয়নি।

সে সময়ই অপূরণীয় একটি ক্ষতি হয়ে যায়। কাবেরীর কলাকুশলীদের কেউ বৃত্তি নিয়ে বিদেশে, কেউবা পড়াশোনা শেষ করে ক্যাম্পাসের বাইরে চলে যান। কোভিডের পর নতুন করে নতুন দল নিয়ে যাত্রা শুরু করে কাবেরী।

ছবির পোস্টার

শিক্ষার্থীদের নিয়ে, শিক্ষার্থীদের গল্প

কাবেরীতে উঠে এসেছে ক্যাম্পাসের বন্ধুদের গল্প, আড্ডা আর সুখ-দুঃখের নানা চিত্র। কলাকুশলীর বেশির ভাগেরই ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর অভিজ্ঞতা এই প্রথম। কাবেরী চরিত্রে অভিনয় করেছেন সমাজতত্ত্ব বিভাগের ঋতুপর্ণা দত্ত। তিনি বলেন, ‘প্রথম কাজ হিসেবে শুরুতে একটু ভয় করছিল। কিন্তু দলের সদস্য আর সহশিল্পীদের সহায়তায় একটু একটু করে সব সহজ হয়ে গেছে।’

শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন বিভাগের হওয়ায় সবার সময় মেলাতে গিয়ে বেশ হিমশিম খেতে হয়েছে পরিচালককে। একজনের অবসর তো আরেকজনের ক্লাস। একজনকে হয়তো বলেকয়ে আনা গেছে, আরেকজনের তখন অ্যাসাইনমেন্ট, টিউটোরিয়াল কিংবা পরীক্ষার ব্যস্ততা। এই সমস্যা সমাধানে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের দিন, অর্থাৎ শুক্র ও শনিবারে শুটিংয়ের সিদ্ধান্ত হয়।

বিপত্তি ছিল সেখানেও। বিরতি দিয়ে দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে শুটিং করতে গিয়ে বাজেটে টান পড়ে। আবার যেহেতু অনিয়মিতভাবে শুটিং হয়েছে, অনেকেই মাঝপথে হাল ছেড়ে দিচ্ছিলেন প্রায়। সিনেমার নির্মাণ আদৌ শেষ হবে কি না, সেই প্রশ্নও তোলেন কেউ কেউ। তবে শুরু থেকেই প্রত্যয়ী ছিলেন সিনেমার প্রযোজক, নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষার্থী ফাইয়াজ রাকিন নূর। তাঁর উৎসাহ-অনুপ্রেরণায় একটু ঢিমেতালে হলেও কাজ চলেছে ঠিকই।

ছবির নির্মাতা ও কলাকুশলীলা

মোমবাতি জ্বালিয়ে শুটিং

সিনেমা নির্মাণের মাঝপথ থেকেই বাজেট নিয়ে সংগ্রাম করতে হয়েছে। টাকার অভাবে যখন প্রয়োজনীয় লাইট আনা যাচ্ছিল না, তখন মুঠোফোনের ফ্ল্যাশ, কুপি ও মোমবাতি দিয়ে চালিয়ে নিতে হয়েছে শুটিং। প্রত্যেকে বিনা পারিশ্রমিকে কাজ তো করেছেনই, নিজের পকেটের টাকাও এ প্রকল্পে খরচ করেছেন।

এ বিষয়ে সিনেমার পরিচালক ও রচয়িতা শামীম রানা বলেন, ‘বাজেট না থাকলেও প্রত্যেকের মধ্যে ভালোবাসা ছিল। দলের কয়েকজন পেশাগতভাবে টিভি-মিডিয়ায় কাজ করে, সেখান থেকে একটা সম্মানী তারা পায়। যখন বলেছি, আমার কোনো বাজেট নেই, তোমাদের ওভাবে টাকা দিতে পারব না, তোমরা কি কাজ করবে? একবাক্যে রাজি হয়ে গেছে সবাই।’

২০২২ সালের জুন থেকে শুরু করে ২০২৩ সালের ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত চলেছে কাবেরীর নির্মাণকাজ। দীর্ঘ সময় ধরে চরিত্রের মধ্যে থাকতে থাকতে চরিত্রের নামেই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন কুশীলবদের কেউ কেউ। ৪০-৫০ জনের দলের সম্মিলিত কর্মযজ্ঞ কাবেরী, সেই দলে ছিলেন বিভিন্ন বয়স, বিভাগ আর এলাকার মানুষ। কেউ বড়, কেউ ছোট, কেউবা একই ব্যাচ। কাজের সূত্রে সব ব্যবধান দূর হয়ে গেছে।

হাউসফুল

গত ২৮ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদে কাবেরীর সাতটি প্রদর্শনী হয়। প্রতিটিতেই ছিল উপচে পড়া ভিড়। মাত্র ৫০ টাকার বিনিময়ে প্রায় ৩ হাজার দর্শক প্রদর্শনীগুলো উপভোগ করেন। যাঁদের সিনেমা দেখার প্রতি আগ্রহ আছে, শুধু তাঁরাই যেন হাজির হয়, পাশাপাশি বিশৃঙ্খলাও যেন না হয়, সে উদ্দেশ্যেই টিকিটের ব্যবস্থা রেখেছিল কাবেরী দল।

কাবেরী দেখে পছন্দ করেছেন দর্শক। নবীন নির্মাতাদের কিছু ভুল-ত্রুটি থাকলেও বন্ধুরা সেসব ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতেই দেখেছেন।

নির্মাতা জানান, এরপর জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে ছবিটি দেখানোর পরিকল্পনা আছে, ওটিটি প্ল্যাটফর্মেও মুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করা হবে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তৈরি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এই ছবি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে চান তাঁরা। সে লক্ষ্যেই অনলাইনে মুক্তি দেওয়ারও প্রস্তুতি নিচ্ছেন।