প্রথমে গুটি গুটি পায়ে, পরে নতুনত্ব ও উদ্ভাবনী প্রযুক্তি দিয়ে ব্যবসায় এনেছেন গতি। পথটা সমস্যাসংকুল ছিল, কিন্তু তাঁর ছিল হার না–মানা সংকল্প। ব্যবসার জন্য অচেনা ও নতুন পথে হেঁটেছেন একেবারে একা। বলছি, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের সরঞ্জাম প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান প্রমিক্সকোর প্রধান মৌসুমী ইসলামের কথা।
পরে ব্যবসাটাকে শুধু স্বাস্থ্য সরঞ্জামের গণ্ডিতে বন্দী না রেখে এনেছেন বৈচিত্র্য। তাই তো জীবন রক্ষাকারী যন্ত্রাংশের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় আসবাব, প্লাস্টিক ও প্লাস্টিকসামগ্রী, নির্মাণ ও উৎপাদনমুখী ভারী শিল্পের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। গড়ে তুলেছেন পশু হাসপাতাল ও ডে কেয়ার সেন্টার।
মৌসুমী ইসলামের জন্ম ও বেড়ে ওঠা সাতক্ষীরায়, সেখানেই স্কুল ও কলেজ। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগে পড়াশোনা শেষ করেন। বাবা ইয়াকুব আলী সরদার ছিলেন ফুটবলার। পরে পাটের ব্যবসায় যুক্ত হন। বাবার সূত্রেই মৌসুমী ইসলাম দেখেছেন আমদানি–রপ্তানি ব্যবসা।
১৯৯৯ সালে পারিবারিক ভ্রমণে সিঙ্গাপুরে গিয়ে হরেক পণ্যের বৈচিত্র্যের মধ্যে খুঁজে পান ব্যবসার ধারণা। দেশে ফিরে সেই ধারণা আর স্বপ্ন নিয়ে শুরু করলেন স্বাস্থ্য সরঞ্জাম আমদানির বাণিজ্য। বাবার রেখে যাওয়া ১০ লাখ টাকা ছিল তাঁর পুঁজি। প্রথম দিকে নানা চড়াই-উতরাই থাকলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হয়েছেন পরিণত। ২০১০ সালে গাজীপুরের কালিয়াকৈরে ৩০ বিঘা জমিতে গড়ে তোলেন প্রমিক্সকো শিল্পপার্ক। ২০১৫ সালে শুরু করেন উৎপাদন।
স্বাস্থ্য খাতের সরঞ্জামে আমদানিনির্ভরতা ছিল সব সময়। এ কারণে এই খাতের সব পক্ষকেই বেশ সমস্যায় থাকতে হতো। সংকটটা কাটাতে ধীরে ধীরে আমদানি থেকে বেরিয়ে উৎপাদনে মনোযোগী হন মৌসুমী ইসলাম। দেশের মাটিতেই শুরু করেন নেবুলাইজার, এয়ার পাম্প ম্যাট্রেস, ওজন মাপার স্কেলসহ নানা ধরনের স্বাস্থ্য সরঞ্জামের উৎপাদন। গড়ে তোলেন এক দক্ষ কর্মীবাহিনী। উৎপাদনের প্রথম দিন থেকেই মানের বিষয়ে কোনো ছাড় দেননি। ফলাফল, ২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক মান সংস্থার (আইএসও) সনদ, ২০১৮ সালে ইউরোপে রপ্তানির সিই সনদ, ২০২৩ সালে আমেরিকার এফডিএ সনদ।
দেশে তৈরি স্বাস্থ্য সরঞ্জাম নিয়ে সাধারণের মনে প্রথম দিকে দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকলেও মহামারির পর থেকে তা দূর হয়ে গেছে। করোনার সময় সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে সুরক্ষা পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করে প্রমিক্সকো গ্রুপ। চিকিৎসাসামগ্রীকে জাতীয় শিল্পনীতিতে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়েও কাজ করেছেন মৌসুমী ইসলাম। নতুন পণ্য সৃষ্টি এবং নতুন রপ্তানি বাজার তৈরিতেও অবদান রেখেছেন তিনি।
প্রমিক্সকো শিল্পপার্কের সাতটি ভবনে রয়েছে ১৩টি উৎপাদন ইউনিট। পণ্যের তালিকায় রয়েছে অপারেশন থিয়েটার (ওটি) টেবিল, ওটি লাইট, করোনারি কেয়ার ইউনিট (সিসিইউ) বেড, নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) বেড, ইসিজি মেশিন, প্রসূতি টেবিল, ডেন্টাল চেয়ার, রোগী মনিটর ও রোগী পরীক্ষার টেবিল। আরও তৈরি হচ্ছে ডিসপোজেবল সিরিঞ্জ, নেবুলাইজার, এয়ারপাম্প ম্যাট্রেস, ওজন মাপার স্কেল, ট্রাস্ট মি কনডম, সার্জিক্যাল ও এক্সামিনেশন গ্লাভস, অটোক্লেভ, সাকশন মেশিন, বেবি ইনকিউবেটর, ফটোথেরাপি মেশিন, আইসিইউ সরঞ্জাম, ফিজিওথেরাপির যন্ত্রপাতি এবং একবার ব্যবহারোপযোগী চিকিৎসা সরঞ্জাম (যেমন সিরিঞ্জ, নিডল, ক্যানুলা, গ্লাভস)।
২০২৩ সালে তাঁর ব্যবসায় বার্ষিক লেনদেন ছিল প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে স্বাস্থ্য সরঞ্জাম খাত থেকেই এসেছে ৬৫ শতাংশ, বাকিটা আসবাব ও নির্মাণ খাতের অবদান।
অগ্রাধিকার ও সংবেদনশীল খাত হিসেবে স্বাস্থ্য সরঞ্জাম ব্যবসা বেশ চ্যালেঞ্জের। মৌসুমী ইসলাম মনে করেন, একজন ব্যবসায়ী হয়ে উঠতে এবং সফলতা পেতে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ ও দেওয়ার মানসিকতা থাকার পাশাপাশি প্রয়োজন সংকল্প, সততা, আগ্রহ ও সাহস। নিজের উদ্যোগ ছাড়া কোনো কিছুই সম্ভব নয়।
তাঁর এই ব্যবসা এবং স্বপ্নকে এগিয়ে নিতে কাজ করছেন তাঁরই সন্তান সামান্তা ইসলাম। যুক্তরাষ্ট্রের পেনস্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে উচ্চতর ডিগ্রি শেষে মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি পিএইচডি করছেন। এরই মধ্যে মায়ের ব্যবসা সম্প্রসারণ এবং রপ্তানি বাণিজ্যে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করতে কাজ শুরু করেছেন।
মৌসুমী ইসলামের মতে, ‘যত পেশা আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো উদ্যোক্তা হওয়া। কারণ, কাঁচামাল থেকে পণ্য তৈরি করে বাজারজাত করে সেখান থেকে মুনাফা নিশ্চিত করে কারও হাতে তুলে দেওয়া অনেক কঠিন একটি কাজ।’
সে কাজই করে চলেছেন মৌসুমী ইসলাম।