সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের ছবি তুলতে ১৯৭২ সালে ঢাকায় আসেন তাইজো ইচিনোসে। ২৫ বছর বয়সী এই জাপানি আলোকচিত্রী পথে পথে ঘুরে ধারণ করেন দুই শতাধিক আলোকচিত্র। কোনোটা রঙিন, কোনোটা সাদাকালো। পরের বছরই কম্বোডিয়ায় রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়ে যান তাইজো। তাঁর তোলা সেসব ছবি আড়ালেই থেকে যায়। সম্প্রতি প্রথম আলোর জাপান প্রতিনিধি মনজুরুল হকের মধ্যস্থতায় আলোকচিত্রগুলো মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের কাছে হস্তান্তর করে তাইজো পরিবার। ২০ জুলাই থেকে জাদুঘরের গ্যালারিতে প্রদর্শিত হচ্ছে সেসব ছবি। আলোকচিত্রী তাইজোর গল্প শোনাচ্ছেন নিজাম বিশ্বাস
সংবাদ সংস্থা ইউনাইটেড প্রেস ইন্টারন্যাশনালের (ইউপিআই) অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় আসেন তাইজো ইচিনোসে। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী তখন ভস্মস্তূপ। তাইজোকে মূলত বিহারি ক্যাম্পের ছবি তোলার দায়িত্ব দিয়েছিল ইউপিআই। তবে শুধু বিহারি ক্যাম্পের ছবি তুলেই হাত গুটিয়ে বসে থাকলেন না তাইজো, ছুটে গেলেন দেশের আনাচকানাচে। ক্যামেরায় ধারণ করলেন যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের মানুষের দুঃখ-কষ্ট-বেদনা। সদ্য স্বাধীন একটা দেশ পাওয়া মানুষের আনন্দ-উল্লাস। পাশাপাশি তাঁর ক্যামেরা ধারণ করে রাখল পশ্চিম পাকিস্তানিদের ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন।
সেই সফরে বাংলাদেশে প্রায় দেড় মাস ছিলেন তাইজো। ১৯৭২ সালের মার্চে জাপানে ফিরে যান তাইজো। কয়েক দিন সেখানে থেকে আবার তাঁর কর্মস্থল কম্বোডিয়ায় চলে যান। জাপানে নিজের বাড়িতে রেখে যান বাংলাদেশের দুই শতাধিক দুর্লভ আলোকচিত্র।
ক্যামেরা নিয়ে যুদ্ধ থেকে যুদ্ধে ছুটে যাওয়াটা যেন তাইজোর নেশা। আলোকচিত্রী হিসেবে কাভার করেছেন ভিয়েতনাম যুদ্ধ থেকে লাওস-কম্বোডিয়ার গৃহযুদ্ধ। এক জায়গায় তাইজো লিখেছেন, ‘যুদ্ধের বড় আঘাতটা আসে সাধারণ মানুষের ওপর।’ এই জন্যই হয়তো সরাসরি যুদ্ধের চেয়ে মানুষের গল্পই বেশি বলেছে তাঁর আলোকচিত্র।
১৯৪৭ সালের ১ নভেম্বর জাপানের সাগা অঞ্চলের তাকেও শহরে তাইজো ইচিনোসে জন্মগ্রহণ করেন। ইচিনোসে পরিবারের তিন সন্তানের মধ্যে তাইজো সবার বড়। তাঁর ছোট দুই বোন। স্কুলে পড়ার সময় তাইজো বেসবল দলের সদস্য ছিলেন। পরে শরীরচর্চা ক্লাব চালানোর সময় আলোকচিত্রে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ১৯৭০ সালে জাপানের নিহন বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্ট কলেজ থেকে আলোকচিত্রের ওপর স্নাতক করেন। কলেজে পড়ার সময়ই তিনি খেলাধুলা, বিশেষ করে মুষ্টিযুদ্ধের আলোকচিত্র ধারণে নিজেকে নিয়োজিত করেন। তিনি নিজেও একজন শৌখিন মুষ্টিযোদ্ধা ছিলেন। স্নাতক শেষে তিনি সংবাদ সংস্থা ‘ইউনাইটেড প্রেস ইন্টারন্যাশনাল’-এর টোকিও ব্যুরোতে তিন মাস কাজ করেন।
১৯৭২ সালের আগস্টের মাঝামাঝি কম্বোডিয়ার সরকার তাইজোকে ‘অপছন্দের আলোকচিত্রী’ হিসেবে চিহ্নিত করে। তাঁর ওপর বহিষ্কারাদেশ জারি হলে ভিয়েতনামে চলে যান তিনি। মাসখানেকের মধ্যেই তিনি ‘ইউপিআই নিউজ পিকচার’ প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার পান। তারপর ফ্রিল্যান্স আলোকচিত্রী হিসেবে কাজ শুরু করেন। তাঁর তোলা ছবি জাপানের প্রথম সারির জাতীয় পত্রিকা ছাড়াও ওয়াশিংটন পোস্ট, দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, নিউজউইক–এ ছাপা হতে থাকে।
১৯৭৩ সালে ২৬ বছরে পা দেওয়ার মাত্র কয়েক দিন পর এক বন্ধুকে একটি চিরকুট লিখে ঘর থেকে বের হন তাইজো। চিরকুটে লেখা ছিল, ‘পুঁতে রাখা কোনো মাইনের ওপর ভুলে পা পড়ে গেলে ঘরে ফেরা আর না–ও হতে পারে।’ আসলেই সেদিন কোনো মাইনে তাঁর পা পড়েছিল কি না, আজ আর জানার উপায় নেই। কারণ, সেই যাত্রার পর তাইজো আর ফিরে আসেননি। আশ্চর্যজনকভাবে নিজের মর্মান্তিক ভবিষ্যৎ নিয়ে সঠিক পূর্বাভাস দিয়ে সেই যে গেলেন, তারপর আর তাঁর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
নিখোঁজ হওয়ার প্রায় এক দশক পর পুত্রের ভাগ্যে ঠিক কী ঘটেছে, জানার জন্য কম্বোডিয়া যান ইচিনোসের মা-বাবা। কম্বোডিয়ার যেসব শহর আর গ্রামে একদিন ছিল সন্তানের পদচারণ, সেসব জায়গা চষে বেড়িয়ে একসময় ঠিকই তাঁরা খুঁজে পান ইচিনোসের ভাঙা ক্যামেরা। সেই সূত্রে আরও কিছু তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করে প্রথমবারের মতো তার বাবা-মা নিশ্চিত হন, ছেলে আর জীবিত নেই।