প্রতিভাবান ফুটবলার শেখ মোরছালিন
প্রতিভাবান ফুটবলার শেখ মোরছালিন

শেখ মোরছালিনকে নিয়ে স্বপ্ন দেখাই যায়

প্রতি বাংলা নববর্ষের মতো ১৪৩১ সনেও দেশের ক্রীড়া, চলচ্চিত্র, ডিজিটাল মঞ্চ, ব্যবসা, গবেষণাসহ নানা ক্ষেত্রের তরুণ প্রতিভাবানদের নিয়ে হাজির হয়েছে প্রথম আলোর শনিবারের ক্রোড়পত্র ‘ছুটির দিনে’। বিশেষ এই আয়োজনে ফুটবলার শেখ মোরছালিনকে নিয়ে লিখেছেন জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক ও বর্তমানে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের প্রধান কোচ আলফাজ আহমেদ

২ জুলাই ২০২২। মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের জার্সিতে এক তরুণের গোলে প্রিমিয়ার লিগে পয়েন্ট হারায় চ্যাম্পিয়ন বসুন্ধরা কিংস। কুমিল্লার শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্টেডিয়ামে গুরুত্বপূর্ণ লিগ লড়াইয়ের যে ম্যাচের ফল ছিল ১-১। ড্র।

মোহামেডানের গোলটি করেছিল ১৬ বছরের কিশোর শেখ মোরছালিন, যে কিনা কিংসে খেলার সুযোগ না পেয়ে লিগের দ্বিতীয় পর্বে ধারে মোহামেডানে আসে। ২৫ গজ দূর থেকে মোরছালিনের শট বুঝতেই পারেনি কিংস গোলকিপার আনিসুর রহমান। বল যখন পোস্টে যাচ্ছে, ও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল।

ভবিষ্যতের কথা ভেবে বিকেএসপি থেকে শেখ মোরছালিনকে দলে নিয়েছিল কিংস। কিন্তু নিজেরা সুযোগ দিতে না পারায় মধ্যবর্তী দলবদলে তাকে মোহামেডানে ধার দেয় চ্যাম্পিয়নরা। সেই কিংসের বিপক্ষেই গোল করে প্রথম আলোচনায় আসে মোরছালিন। সে ম্যাচের আগে শেখ জামালের বিপক্ষে মোহামেডানের পাওয়া ৩-১ গোলের জয়েও মোরছালিনের একটি গোল ছিল। পরপর দুটি বড় ম্যাচে দুই গোল করে ঘরোয়া ফুটবলে নতুন প্রতিভা হিসেবে নিজেকে মেলে ধরে এই তরুণ। দ্রুতই সে চলে আসে পাদপ্রদীপের আলোয়।

সিটি গ্রুপ–প্রথম আলো ক্রীড়া পুরস্কারে বর্ষসেরা উদীয়মান ও পাঠক ভোটে বর্ষসেরা হয়েছেন শেখ মোরছালিন

গত বছর জাতীয় দলে এসেই ভারতে অনুষ্ঠিত সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে দারুণ খেলেছে মোরছালিন। সাফের পর বিশ্বকাপ বাছাইয়ে লেবাননের বিপক্ষে দূরপাল্লার শটে চোখধাঁধানো গোল করে। লেবাননের বিপক্ষে তার গোলে বিশ্বকাপ বাছাইয়ে একটি পয়েন্ট পেয়েছে বাংলাদেশ। এখন পর্যন্ত ২০২৬ বিশ্বকাপ বাছাইয়ে ছয় ম্যাচের প্রথম চারটিতে এটিই বাংলাদেশের একমাত্র পয়েন্ট। আর মোরছালিনের কল্যাণেই তা সম্ভব হয়েছে।

কদিন আগেই সিটি গ্রুপ-প্রথম আলো বর্ষসেরা ক্রীড়া পুরস্কারে মোরছালিন পেয়েছে ২০২৩ সালের বর্ষসেরা উদীয়মানের পুরস্কার। সবাইকে চমকে দিয়ে পেয়েছে পাঠকের ভোটে বর্ষসেরার পুরস্কারও। বাংলাদেশে ক্রীড়া লেখক সমিতির বর্ষসেরা উদীয়মান ক্রীড়াবিদের পুরস্কারও সে পেয়েছে। একই প্রতিষ্ঠানের পপুলার চয়েজ অ্যাওয়ার্ডও পেয়েছে। ১৮ বছরের ছেলেটি ক্যারিয়ারের শুরুতেই কতটা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, এসব থেকেই তা পরিষ্কার।

দুটি অনুষ্ঠানেই আমি ছিলাম। মোরছালিনের হাতে পুরস্কার উঠতে দেখে ভালো লেগেছে। একটা আশাও জেগেছে। দেশে নবীন খেলোয়াড় তো অনেকই আছে। যেমন মোহামেডানে শাহরিয়ার ইমনের নাম বলতে পারি। তবে মোরছালিনের প্রতিভা একটু আলাদা। দেশের ফুটবলে তারকা–খরার মধ্যে অনেক দিন পর তার মতো মেধাবী একজন উদীয়মানের আগমন। যাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখাই যায়।

মোহামেডান ওকে কিংস থেকে না নিলে গল্পটা হয়তো ভিন্ন হতে পারত। মোরছালিনের এই উত্থান হয়তো হতো না। আমি তো বলব বসুন্ধরায় থাকলে বেঞ্চে বসে বসেই প্রতিভাটা নষ্ট হয়ে যেতে পারত। মোহামেডানে আসার পরই সে খেলার সুযোগ পেয়েছে, তার প্রতিভার বিকাশ হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ান কোচ শন লেন চলে যাওয়ার পর মোহামেডানের দায়িত্ব নেন (শফিকুল ইসলাম) মানিক ভাই। কিংসের বিপক্ষে মোরছালিনকে সুযোগ দেন তিনি। আমি তখন মোহামেডানের সহকারী কোচ।

সেই সুবাদে মোরাছালিনকে কাছ থেকে দেখেছি। অনুশীলনে শেখানোর চেষ্টা করেছি। দ্রুত শিখতে পারে ছেলেটি। শুনেছি বৃত্তির টাকা দিয়ে সে ফুটবলের জন্য বুট কিনেছে। শুনে ভালো লেগেছে। ফুটবলের প্রতি আগ্রহ থাকতে হবে, যেটা ওর আছে। ফরিদপুর থেকে উঠে আসা ছেলেটির ভালো দিক অবশ্যই দূরপাল্লার শট। যা সচরাচর দেখা যায় না। শটে নিখুঁত নিশানাও আছে। মোরছালিন ৫টি শট মারলে ৩-৪টি বারে থাকেই। এ জন্যই ও আলাদা। শারীরিকভাবেও বেশ ভালো। দেশসেরা ক্লাব বসুন্ধরা কিংসে আছে। ভালো অনুশীলন পাচ্ছে। ভালো খাবার পাচ্ছে। তরুণ বয়স। সবই ওর পক্ষে।

মিডফিল্ডার হিসেবে খেলে ও। তবে আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডার হিসেবেও তাকে ব্যবহার করা যেতে পারে। ওর যে খেলার স্টাইল, তাতে উইং মিডফিল্ডে খেলানো যাবে না। ‘নাম্বার সেভেন’ বা ‘নাম্বার এইট’ হিসেবে মিডল মিডফিল্ডে খেলালে ভালো। মোরছালিন ওই মানেরই খেলোয়াড়। আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডার হিসেবে খেললে ওর আরও ভালো খেলার সম্ভাবনা আছে। জাতীয় দলে ওকে স্ট্রাইকার হিসেবেও খেলানো হয়েছে। কিন্তু স্ট্রাইকারে খেলতে হলে ওকে আগে রানিং-স্পিড আরও বাড়াতে হবে। আমার চোখে ওর স্ট্যামিনা আর স্পিডে ঘাটতি আছে। এগুলো বাড়াতে হবে। ওকে স্ট্রাইকারের নিচে খেলালেই ভালো হবে বলে আমার ধারণা।

শেখ মোরছালিন

মোরছালিনকে নিয়ে যতটা আলোচনা, সেটা জাতীয় দলে ওর খেলা দেখে। জাতীয় দলে ৯ ম্যাচে ৪টি গোল করে ফেলেছে। কিন্তু ঘরোয়া ফুটবলে এখনো সে সেভাবে আলোচনায় নেই। গত বছর বসুন্ধরায় বেশির ভাগ ম্যাচ বসেই ছিল। এবার তো চোটের কারণে মৌসুমের শুরু থেকেই মাঠের বাইরে। টানা কয়েক মাস বাইরে থাকা মানে ইঙ্গিতটা ভালো না। ফিট থাকলেও সে বসুন্ধরা কিংসের একাদশে এখনো নিয়মিত হতে পারেনি। আগে তাকে এই জায়গাটা অর্জন করতে হবে। এটা তার জন্য একটা চ্যালেঞ্জই।

 চোট সারিয়ে ফিরে আসাও কঠিন। এ ধরনের পরিস্থিতিতে ভাগ্য সহায় থাকতে হয়। পাশাপাশি অনেক পরিশ্রম করতে হয়। মোরছালিনকে সেটা বুঝেই এগোতে হবে। ক্লাব দলে নিজেকে অপরিহার্য করাও জরুরি। নইলে বেশি দূর এগোনো যাবে না। এটা পরিশ্রম করলে হয়ে যাবে আশা করি। তার জন্য এখন পরিশ্রমের বিকল্প নেই। আর অবশ্যই শৃঙ্খলা মানতে হবে। একজন উঁচু মানের ফুটবলার হতে চাইলে ব্যক্তিজীবনে শৃঙ্খলার বিকল্প নেই। গত বছর সে কিছুটা শৃঙ্খলা ভেঙেছে। সঙ্গদোষেই সম্ভবত। এখন সব পেছনে ফেলে নিজেকে রাখতে হবে কক্ষপথে। মোরছালিন তা পারবে, এমন আস্থা রাখতে চাই।

অনুলিখন: মাসুদ আলম