করোনাকালে টিকা তৈরি করে আলোচনায় এসেছিল মার্কিন জৈবপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান মডার্না। সেই প্রতিষ্ঠানের সহপ্রতিষ্ঠাতা নুবার আফায়ান। তিনি একজন উদ্যোক্তা, উদ্ভাবক। এমআইটির স্নাতক। এ বছর নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন বক্তা হয়ে হাজির হয়েছিলেন তিনি। পড়ুন তাঁর বক্তৃতার নির্বাচিত অংশ।
ছেলেবেলা কেটেছে লেবাননের বৈরুতে। গর্বিত এক আর্মেনিয়ান পরিবারে আমরা তিন প্রজন্ম একসঙ্গে একটি অ্যাপার্টমেন্টের ৯ তলায় থাকতাম। আমি আর আমার এক দাদি একই জানালার বাতাস ভাগাভাগি করে নিতাম। যে জানালায় তাকালে চোখে পড়ত লাল টালি বসানো বাড়ির ছাদ, একটু দূরেই ভূমধ্যসাগর।
১৯৭৫ সালে যখন গৃহযুদ্ধ শুরু হলো, সরকার কঠিন কারফিউ জারি করল। সে সময় টিভিতে নিয়ম করে তিন ঘণ্টা মার্কিন অনুষ্ঠান দেখাত। ঘরবন্দী দিনগুলোয় ওইটুকু সময় খানিকটা বিনোদন মিলত। বিশেষ করে একটা টিভি সিরিজ আমরা বুঁদ হয়ে দেখতাম। মিউজিকটা শুনলেই যেন বুকে পাগলা ঘোড়া ছুটতে শুরু করত।
ঠিক ধরেছ, মিশন ইম্পসিবল–এর কথা বলছি।
টিভি শো-টা যদি না-ও দেখে থাকো, টক ক্রুজকে ইথান হান্ট চরিত্রে তোমরা নিশ্চয়ই দেখেছ।
‘ইয়োর মিশন…শুড ইউ চুজ টু অ্যাকসেপ্ট ইট,’ এই একই কথা বলে সব সময় বার্তাবাহক যন্ত্রটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ধ্বংস হয়ে যেত। চ্যালেঞ্জ যতই বড় হোক, যত ঝুঁকিই থাকুক, এজেন্টকে কখনোই কোনো মিশনে ‘না’ করতে দেখিনি।
গত ৫০ বছরে আমিও একের পর এক অসম্ভব মিশনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছি। আশা করব, তোমরাও তা-ই করবে।
তোমাদের জন্য চ্যালেঞ্জটা শুরু হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে পা না রেখেই বিশ্ববিদ্যালয়জীবন শুরু করার মধ্য দিয়ে। যখন ক্যাম্পাসে এসেছ, তখনো মাস্ক পরো রে, টেস্ট করো রে, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলো রে, কত হ্যাপা! কেউই জানতাম না, কবে কীভাবে এই সমস্যার সমাধান হবে।
তবে আমরা ঠিকই পথ পেয়েছি। তোমরা তোমাদের কোর্সওয়ার্কে ঝাঁপিয়ে পড়েছ, ভার্চ্যুয়াল বন্ধুত্ব গড়েছ। আমিও আমার সহকর্মীদের নিয়ে মডার্নায় এক অসম্ভব মিশনকে সম্ভব করতে লেগে পড়েছি। সেই মিশন ছিল—এমন একটা টিকা তৈরি, যা জীবন বাঁচাবে, অর্থনীতিকে আবার চলমান করবে। এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে আমরা সফল হয়েছি। এটা পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম, এই চ্যালেঞ্জে সফল হতে হলে আমাদের যা কিছু আছে, সব নিয়ে নামতে হবে। ২০টি চলমান ওষুধ তৈরির প্রকল্প স্থগিত রেখে আমরা করোনা-সমস্যা সমাধানের যুদ্ধে নেমেছিলাম।
দুই মাসেরও কম সময়ের মধ্যে আমরা একজন রোগীকে নিয়ে প্রথম ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে যাই। ১৬ নভেম্বরের মধ্যেই এটা নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল, আমাদের টিকা ৯৪ দশমিক ৫ শতাংশ কার্যকর। ধারণা করা হয়, মহামারির সময়ে মডার্নার টিকা ২০ লাখেরও বেশি মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে।
কীভাবে সম্ভব হয়েছিল, বলতে গেলে আরও একটা বক্তৃতা দিতে হবে। কিন্তু আমি বলতে চাই, কেন তোমাদেরও প্রত্যেকেরই একটা না একটা ‘ইম্পসিবল মিশনে’ নেমে পড়া উচিত। কারণ তোমাদের সেভাবেই গড়া হয়েছে।
যখন পৃথিবী প্রচণ্ড সংকটের মধ্য দিয়ে যাবে, তখন একে রক্ষা করার মিশন তো তোমাদেরই। সিনেমার সেই এজেন্টের মতোই কখনো এই মিশনকে ‘না’ বোলো না। বিজ্ঞান কল্পকাহিনিকে সত্য করার মতো অনন্য প্রযুক্তি তোমাদের হাতে আছে।
প্রশ্ন হলো, কীভাবে পৃথিবীর এজেন্ট হয়ে উঠবে। ইতিমধ্যেই দারুণ একটা শুরু করে ফেলেছ, এমআইটিতে পড়েছ। মেধা, আগ্রহ, লক্ষ্য, অধ্যবসায়—২১ শতকের একজন এজেন্টের যা থাকা উচিত, তোমাদের সব আছে। আর হ্যাঁ, অসাধারণ সামাজিক দক্ষতা, এটিও এমআইটি স্নাতকদের বড় শক্তি।
বিজ্ঞান, গণিত, প্রকৌশল, প্রযুক্তির প্রশিক্ষণ তোমাদের আছে, আর কী চাই? যদি যথাযথ সহায়তা পাও, যেকোনো অসম্ভব চ্যালেঞ্জ তোমরা মোকাবিলা করতে পারবে।
গণিতবিদ ও লেখক লুইস ক্যারল বলেছিলেন, ‘বাস্তবতার যুদ্ধে কল্পনাই একমাত্র অস্ত্র।’ অজানার ভয়ে নিজেকে লুকিয়ে রাখার জন্য এমআইটি তোমাকে তৈরি করেনি, বরং উল্টোটা। এখন তুমি নক্ষত্র ছোঁয়ার জন্য প্রস্তুত, এমনকি আক্ষরিক অর্থেও। এমআইটির ৪০ জনেরও বেশি এখন নাসায় মহাকাশচারী হিসেবে কাজ করছে, বিশ্বাস না হলে তাঁদের জিজ্ঞাসা করে দেখো!
প্রথম যখন এমআইটি পৌঁছাই, মনে হতো আমি এখানকার কেউ নই। উচ্চারণে একধরনের আঞ্চলিকতা ছিল। হকি বা ল্যাক্রোস খেলে নয়, আর্মেনিয়ার লোকনৃত্য শিখে আমার অবসর কাটত।
প্রথম বর্ষের শেষ দিকের কথা। এক বিকেলে করিডোর ধরে হাঁটছি। হঠাৎই একটা পোস্টারে চোখ আটকে গেল। একজন মার্কিন আদিবাসীর ছবি। আঙুল তাক করে যিনি বলছেন, ‘ওহে পথিক, কাকে তুমি অভিবাসী বলো?’
বলে বোঝাতে পারব না, এই এক পোস্টার আমাকে কীভাবে নাড়া দিয়েছিল। মার্কিন আদিবাসীরা ছাড়া, আমরা সবাই-ই তো আসলে অন্য কোথাও না কোথাও থেকে এসেছি। এই উপলব্ধি আমাকে শেখাল, হ্যাঁ, আমিও এমআইটির একজন। আমরা সবাই এক পরিবার। পরিচিত, চেনা গণ্ডি ছেড়ে যাঁরা নতুন কোথাও পা রাখে, তাঁদের যদি অভিবাসী বলা হয়, তাহলে তো এমআইটিতে আসা আমরা সবাই-ই অভিবাসী; যে যেখানেই বড় হই না কেন।
এমআইটির অভিবাসীরা, অসম্ভব মিশনের মুখোমুখি হয়ে তোমরা সবাই একটা অন্তত বাড়তি সুবিধা পাবে। আর তা হলো, তোমরা সবাই-ই কোনো না কোনো ‘কমফোর্ট জোন’ ছেড়ে এসেছ। একটা নতুন জগতে পা রেখেছ। যে নিরাপত্তার বলয় তোমাকে ঘিরে রেখেছিল, তুমি সেটা অতিক্রম করেছ। টিকেও গেছ। অতএব মিশনে কীভাবে জয়ী হতে হয়, তুমি জানো।
টিভি শো-র কথা বলে বক্তব্য শুরু করেছিলাম। শেষ করব সিনেমার কথা বলে—সর্বশেষ মিশন ইম্পসিবলের যে ছবিটা বেরোল, এই সিনেমা তোমাদের সামনের সব চ্যালেঞ্জ মনে করিয়ে দেয়। জটিল ভূরাজনীতি, জলবায়ুর হুমকি, প্রযুক্তিগত চাপ। এআই, যা পৃথিবীকে সহজ করতে পারে, আবার জটিলও।
তবে স্নাতকেরা, আমি আমার চোখের সামনে একদল এজেন্টকে দেখতে পাচ্ছি, যাঁরা এই মিশন সফল করতে প্রস্তুত। দেখিয়ে দাও, ‘মিশন ইম্পসিবল টিম’কে কেন সংক্ষেপে এমআইটি বলে!